শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

আণবিক বোমা : হিরোশিমা ও নাগাসাকি

প্রকাশের সময় : ৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী

মানবসভ্যতার সবচেয়ে কলংকিত দিন দুটি হল ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট। ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা শহরে এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতির মুখোমুখি ছিল। হিটলারের উপর আক্রোশ মেটাতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্দেশে হিরোশিমায় ‘লিটল বয়’ নামে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে মারা যান ১ লাখ ৪০ হাজার নিরীহ মানুষ আর আহত হন লক্ষ লক্ষ মানুষ। যারা আহত হয়ে বেঁচেছিলেন তারা হয়েছিলেন জীবন্তলাশ। তাদের মানুষ বলে চেনা মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। তিন দিন পর পুনরায় জাপানের নাগাসাকিতে যে দ্বিতীয় আণবিক বোমা ‘ফ্যাটম্যান’-এর বিস্ফোরণ। সে বিস্ফোরণেও মারা যান প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। ক্ষমতাশক্তির বর্বরতার এক উদাহরণ হয়েই ৬ এবং ৯ আগস্ট সভ্যতাবিরোধীদের ধিক্কার দেবে যতদিন পৃথিবী থাকবে।
৬ আগস্ট হিরোশিমায় হাজির হয়ে থাকেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। হিরোশিমার জিরো পয়েন্টে যেখানে মার্কিন বিমান বোমা নিক্ষেপ করেছিল, সেখানেই বসে শোকাবহ দিনটিকে স্মরণ করতে শোক স্মরণ সভা। ওই শোক স্মরণসভার পরমাণু বোমার বিলুপ্তি চান বিশ্বের লাখো মানুষ। তারা বলেন, যে বোমার কাজ শুধু মানুষের প্রাণ হরণ ও সভ্যতাকে ধ্বংস করা তা আমরা চাই না।
আন্তর্জাতিক স্তরে যেসব দিবসকে আমরা স্মরণ করে থাকি, সেইসব দিনের মধ্যে ৬ ও ৯ আগস্টই সবচেয়ে শোকাবহ এবং মানবসভ্যতা রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার দিন। ক্ষমতাধররা মানুষের প্রিয় পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে চায়। তাই এখন আর অস্ত্র নয়, পৃথিবী রক্ষার্থে আলিঙ্গনের যে প্রয়োজন, সেই শান্তির বাণী প্রচারের দিন এসেছে।
পারমাণবিক বোমায় আহত হয়ে যারা সেদিন বেঁচেছিলেন, যাদের জাপানি ভাষায় বলা হত ‘হিববুশ’ অর্থাৎ জীবন্তলাশ। সেই জীবন্তলাশ আজ গোটা পৃথিবীজুড়ে বাড়ছে। পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে না হোক, বোমা বিস্ফোরণে ও আগ্নেয়াস্ত্রের ঝলকানিতে। তাই বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের স্বার্থে গোটা বিশ্ব থেকেই এখন অস্ত্র নির্মাণের কারখানার বিলুপ্তি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অস্ত্র এখন খেলনা। তাই সামরিক শক্তির জন্য নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র এখন লাভ করা সাধারণ মানুষের কাছে কত যে সহজ তা আর বলতে হয় না। প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে অসামরিক শক্তির শক্তি প্রদর্শন করতে মানুষ নিধন। আজ স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে, মানুষের ভবিষ্যৎ কোথায়? আজ প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের কান্না ছাড়া হাসির আনন্দধ্বনি শোনার সম্ভাবনা নেই। গোটা বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর মিছিল। যুদ্ধ আর যুদ্ধ। যে দিন থেকে বিজ্ঞান অস্ত্র তৈরির জ্ঞান বিকাশ ঘটাতে শুরু করল সেদিন থেকেই অহংকারী মানুষ বুঝে গেল ক্ষমতা এখন হাতের মুঠোয়। কাছাকাছি থেকে দৈহিক শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তার দিন ফুরিয়েছে। আজ মানুষ বুঝে গেছে মানসিক লক্ষ্য ফলপ্রসূ করা কত সহজ। আসলে মানুষ সূচনালগ্নেই পেয়ে গিয়েছিল একটি দারুণ জিনিস, সেটি হল মস্তিষ্ক। এ মস্তিষ্কের জোরেই আজ সে হতে চায় বিশ্বের নকল অধীশ্বর। বর্তমান যুগের একটা প্রধান সমস্যা হল প্রযুক্তি দ্রুত পাল্টাচ্ছে ঠিক, সে সঙ্গে চিন্তাপদ্ধতি তত দ্রুত পাল্টাচ্ছে না। ফলে দক্ষতা বাড়লেও প্রজ্ঞা হারিয়ে গেছে। তাই প্রজ্ঞাহীন মানুষের হাতে থাকা বিশ্বে মানবজাতি কতদিন টিকে থাকবে তা বলা অসম্ভব।
এই যে প্যালেষ্টাইন আর ইরাকের বিধবাদের সংখ্যা পেলাম তা তিন দশকে ১০ লক্ষ। আফগান সংঘাত নিশ্চয় আরো বিধবা তৈরি করবে। শুধু ইরাক বা আফগানিস্তান কেন, গোটা বিশ্বের যা অবস্থা বৈধব্য এখন নিশ্চিত হয়ে পড়েছে বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে। এ যেন পুরুষহীন বিশ্ব তৈরির পরিকল্পনা চলেছে। তারপর? মানবজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ঠিক, কিন্তু ভাবনাটা সে দিকে এগোচ্ছে না কেন? আসলে, এ ব্যাপারে যুদ্ধবাজদের মাথাব্যথা নেই। কারণ অহমিকা, ঔদ্ধত্য, মর্যাদাহানির আশঙ্কা এবং মতাদর্শগত অসহিষ্ণুতা তাদের বিচার শক্তিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যন্ত্রণা আর আতঙ্কের দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটবে কি এই পৃথিবী নামক গ্রহে? মানুষের মধ্যে শুধু যে নিষ্ঠুরতা আর যন্ত্রণা সৃষ্টির ক্ষমতা আছে, মহত্ত্ব আর উৎকর্ষতার সম্ভাবনা নেই সে কথা বলাটা সঠিক বিচার নয়। পৃথিবী নামক গ্রহকে আনন্দময় ও সুন্দর করে গড়ে তোলা সম্ভব যদি মানুষ তার মনুষ্যত্বকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করতে পারে। অকালমৃত্যু, দারিদ্র্য ও নিঃসঙ্গতা দূর হবে। দূর হবে আতঙ্কের রাত। মৃত্যু, দারিদ্র্য, নিঃসঙ্গতার বিভীষিকা তো রাত যত ঘন হয় ততই বাড়ে। সত্যি সত্যি মানুষ হঠকারীর মতো নিজেকে ধ্বংস না- করে, যুদ্ধ আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে তাহলে আরো লক্ষ বছর পৃথিবী সুন্দর ও মঙ্গলময় থাকতে পারবে।
এখন আমাদের যে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে, সেটি হল সব ধরনের বিদ্রোহ ও যুদ্ধ থেকে সরে আসা আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ বন্ধ করা। যে কোনো রাষ্ট্র হোক বা উগ্রপন্থী জঙ্গি সংগঠন হোক, ঠা-া যুদ্ধে, অঘোষিত যুদ্ধে গণহত্যা ঘটাতে অস্ত্রশস্ত্র বাবদ যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে, সে অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা। এ বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই, অপুষ্টিতে ভুগছে, শিশুমৃত্যু বাড়ছে, তা রোধ করা।
নিশ্চয় অস্ত্র নির্মাণ শিল্পের মালিক বলবেন, ওই শিল্পের সঙ্গে শ্রমিকস্বার্থ জড়িত। নিরস্ত্রীকরণ হলে ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। যুক্তি কিন্তু সঠিক বলা যায় না। বাস্তবোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে যুদ্ধভিত্তিক অর্থনীতিকে অনায়াসেই শান্তিভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপায়িত করা যায়। যুদ্ধ বা হিংসা যে ক্ষতি করে তা শুধু মানসিক নয়, আর্থিকও।
শুরু করেছিলাম আণবিক বোসা ‘লিটলবয়’ ও ‘ফ্যাটম্যান’ বিস্ফোরণের ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার ঠিক আগে পরমাণু বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট বুঝেছিলেন পরমাণু বোমা তৈরি করা সম্ভব। সেই সময় পরমাণু বিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নাৎসিদের পরাস্ত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেই পরমাণু বোমা বানানোর কাজ শুরু করেন। অবশ্য জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরমাণু বোমা নির্মাণের কাজে সাহায্যকারী বিজ্ঞানীদের বেশিরভাগ মনে করেছিলেন জাপানিদের বিরুদ্ধে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ, এমনিতে জাপান পরাজয়ের মুখে পৌঁছে গেছে। তাই পরমাণু বোমাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসাবে ব্যবহার না করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে কোনো মরুভূমিতে ফাটানো হোক। কিন্তু অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের শুভ চিন্তাকে গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। রাজনীতিবিদরাই ঘটান মৃত্যুর মিছিল। বর্তমানেও চলছে রাজনীতিবিদদের অন্তর্দৃষ্টির অভাব।
দেখা গেছে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের পর সেইসব ভয়াবহ মৃত্যুর মিছিল দেখেও কোনো কোনো দেশের নেতাদের মতামতের মধ্যে সুদূরপ্রসারী প্রজ্ঞা প্রতিফলিত হয়নি বরং দেশপ্রেমের সমার্থক হয়ে আছে ঘৃণা এবং যুদ্ধই শান্তির একমাত্র রক্ষাকবচ। ফলে ভ্রান্তপথে পরিচালিত হচ্ছে পৃথিবী নামক গ্রহ। আগামী দিনগুলো বরং মহাবিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে।
সম্প্রতি পত্রিকার একটি হেডলাইন ও সারিবদ্ধভাবে শায়িত মৃতদেহের ছবি দেখে আতঙ্কিত হতে হয়। হেডলাইন ছিল-‘মার্কিন বাহিনীর অভিযানের ফলে আফগানিস্তানে সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুর হার ক্রমর্ধমান।’ কখনো তালিবানের বোমা হামলায়, কখনো বা ন্যাটো বাহিনীর অভিযানে মৃত্যুর মিছিল। বিশ্বজুড়েই মানবজাতি আজ চরম দুঃখজনক পরিস্থিতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে গণহত্যার অস্ত্র নির্মাণজনিত বিপদের মূল্যায়ন করতে বিশ্বের রাজনীতিকদের বৈঠকে বসা, সেই বৈঠকে বিজ্ঞানীদেরও আমন্ত্রণ জানানো এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এই বৈঠকে যারা মিলিত হবেন তারা কোনো জাতি বা ধর্মমতের সদস্য হিসাবে পরিচয় প্রদান করবেন না বরং মানুষ হিসাবে, মানব প্রজাতির সদস্য হিসাবেই নিজেদের বক্তব্য পেশ করবেন।
অবশ্য বলতে হয় রাজনৈতিক সচেতনতা তো মানুষের থাকবে। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজেদের এক জৈবিক প্রজাতি হিসাবেও ভাবা দরকার। এই জৈবিক প্রজাতির ইতিহাস আছে। কোনো অবস্থায় এই জৈবিক প্রজাতির অবলুপ্তি ঘটুক তা কাম্য নয়।
আমাদের আগে মনে রাখতে হবে আমরা মানুষ। জীবনই আমাদের কাম্য, মৃত্যু নয়। কেন আমরা জীবনকে মনে রাখতে পারছি না? কারণ আমরা নিজেদের মধ্যকার বিবাদকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। তাই বলতে হচ্ছে, যদি আমরা অন্য সবকিছু ভুলে মানুষের পরিচয় দিতে পারি এবং প্রচ- গতিতে মহাবিশ্বে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর এক জীব বলে ভাবতে পারি, তাহলে অপেক্ষা করছে গোটা পৃথিবীর বুকে মনুষ্যহীন এক জগৎ। কারণ হল যদি সার্বিক যুদ্ধ শুরু হয় এবং যুদ্ধে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার হয় তাহলে পৃথিবী নামক গ্রহ তেজস্ক্রিয়তার ছেয়ে যাবে। ধ্বংস হবে পৃথিবী। নিউক্লিয়াস বোমার তেজস্ক্রিয়তার উপাদানের ক্ষমতা এত বেশি যে সারা পৃথিবীর মানুষের শারীরিক ক্ষতি যেমন করবে সেইসঙ্গে জননকোষকে ধ্বংস করে দেবে। সুতরাং, ভবিষ্যতে যাতে আর বিশ্বযুদ্ধ না বাধে এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে আমাদের বিশ্বশান্তির কথা ভাবতে হবে। সেই ভাবনাতেই মানবতার জয় ঘোষিত হবে। সেই সঙ্গে বলতে হয় মানুষের মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হলে প্রকৃত শিক্ষার আজ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ইতিহাস শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। ইতিহাস শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরতে হবে। শিল্পকলা, আবিষ্কার বা অভিযান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর জ্ঞানের ব্যাপারে বেশি করে গুরুত্ব দিতে হবে। উগ্র স্বাদেশিকতার প্রচার যাতে না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সামগ্রিকভাবে মানবজাতির স্বার্থরক্ষা সংক্রান্ত চিন্তার অভ্যাস গড়ে তোলা। কোনো অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা যাতে সৃষ্টি না হয় সে দিকটা দেখা উচিত। যদি তাই হয় তাহলে সর্বত্রই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব বিকশিত হবে। মানুষ বাঁচবে। পৃথিবী বাঁচবে। এ পৃথিবীতে বিজ্ঞান যদি সঠিক পথে এগুতো তা হলে মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থাকত না। কিন্তু বিজ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার না করে ধ্বংস সাধনে ব্যবহার করায় আজ আমরা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর চিন্তা করছি।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন