রাস্তা মানে যান চলাচলের পথ। ফুটপাত মানে হেঁটে চলার পথ। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকায় বাস্তবতা ভিন্ন। রাস্তার সিংহভাগই ব্যবসায়ীদের দখলে। ফুটপাত মানেই হাট-বাজার, ফুটপাত মানেই সারি সারি হকার। নর্থ সাউথ রোড, ইংলিশ রোড, ধোলাইখাল, আলুবাজার, বংশাল, বাবুবাজার, লক্ষীবাজার, শাঁখারীবাজার, রায়সাহেব বাজার, পাটুয়াটুলি, নয়াবাজারসহ পুরান ঢাকার বেশিরভাগ এলাকার রাস্তা বেদখলে। রাস্তার উপর মালামাল রেখে বছরের পর বছর ধরে চলছে পাইকারি ব্যবসা। তাতে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। দিনরাত যানজট লেগেই থাকছে। রাস্তায় যেখানে দখলে সেখানে ফুটপাথ বলে কিছু থাকার কথা নয়। সদরঘাট, ইসলামপুর, ইমামগঞ্জ, লালবাগ থেকে শুরু করে আলুবাজার, বংশাল হয়ে গুলিস্তান, পল্টন ও মতিঝিল পর্যন্ত সব এলাকার ফুটপাথ হকারদের দখলে। নিরাপদে পায়ে হাঁটার কোনো উপায় নেই। অথচ সেদিকে পুলিশ, প্রশাসন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কারো কোনো নজর নেই। যুগ যুগ ধরে এ অনিয়মকে মেনে নিয়েই চলছে সবকিছু।
এদিকে, ফুটপাথ ও সড়ক দখলমুক্ত করতে সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত ৭ সেপ্টেম্বর সোমবার অভিযানকালে ফুটপাত ও সড়কে পাওয়া নির্মাণসামগ্রী ও অবৈধ স্থাপনা জব্দ করে তাৎক্ষণিক নিলামে তোলা হয়। এই অভিযানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ওই দিন সকালে গুলশান-২ এর ৮৬ নং রোডে একটি ভ্রাম্যমাণ টিম নিয়ে হাজির হন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। সেখানে গিয়ে দেখতে পান, ওই রোডে একটি নির্মাণাধীন ভবনের কাজের জন্য ফুটপাত দখল করে রড রাখা হয়। সেখানে উপস্থিত নির্মাণাধীন ভবনের তত্ত¡বধায়ক কাউকে না পেয়ে প্রথমে নিলামের ডাক দেন ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল হামিদ মিয়া। নিলামে খবর শুনে সেখানে ছুটে আসেন সাইট ইঞ্জিনিয়ার পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি। এ সময় তাকে কর্মকর্তারা ভৎর্সনা করেন। সেই সঙ্গে ফুটপাতে রড রাখার দায়ে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এরপর ফুটপাতে থাকা রডসহ যাবতীয় মালামাল পরে স্পট নিলামে তুললে এতে পাঁচজন অংশ নেন। এর মধ্যে মাহমুদ মোল্লা নামে একজন সব রড ও রড কাটার মেশিন ৪৯ হাজার টাকায় কিনে নেন। সঙ্গে ট্যাক্স-ভ্যাট বাবদ আরও ৭ হাজার টাকা পরিশোধ করেন তিনি। মেয়র আতিক উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বারবার সতর্ক করেছি। কেউ কথা কানে নেয়নি। সবাই নিজের মত করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। তাই এখন থেকে জরিমানার মাধ্যমে জবাব দেওয়া হবে সকল অনিয়মের। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এখনও যারা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছেন তাদের প্রতি অনুরোধ প্লিজ ভালো হয়ে যান। তিনি বলেন, আমাকে তো ৩২ লাখ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করতে হচ্ছে। আমি তো এমন দুর্ভোগ সহ্য করবো না যা আমার নাগরিকদের ভোগায়। নাগরিকদের স্বার্থে এখন থেকে আমি কঠোরভাবে এসব মনিটরিং করব। এই ঘটনার পর অভিজাত এলাকা গুলশানে রাস্তার উপর আর কোনো মালামাল রাখার খবর পাওয়া যায়নি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ফুটপাথ থেকে মালামাল উচ্ছেদের পর স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রসঙ্গ এসেছে। পুরান ঢাকার রাস্তা, অলি-গলি, ফুটপাথ সবই যুগ যুগ ধরে বেদখল হয়ে আছে। এখানে কেনো অভিযান হয় না-এমন প্রশ্ন অনেকেরই। ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, আমরা এগুচ্ছি। সব ধরণের অনিয়ম দূর করার জন্য আমাদের মেয়র মহোদয়ের নির্দেশে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে সবই হবে।
ঢাকার আদালত পাড়ার কারণে অনিচ্ছা সত্তে¡ও অনেককে পুরান ঢাকায় যেতে হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়েও যেতে হয় অনেককে। প্রতিদিন সকাল থেকে পুরো রাজধানীর হাজার হাজার মানুষের গন্তব্য পুরান ঢাকা। এ গন্তব্যে যেতে পথিমধ্যে যানজট আর ভিড়ের যন্ত্রণা সকলেরই জানা। গুলিস্তানের পর থেকে শুরু হয় এ যন্ত্রণা। গুলিস্তান থেকে নর্থসাউথ রোড, ইংলিশ রোড, বংশাল, আলুবাজার, নয়াবাজার, তাঁতীবাজার, রায়সাহেব বাজারসহ আদালত পাড়ার চারিদিকে সব রাস্তার সিংহভাগই ব্যবসায়ীদের দখলে। রাস্তার উপর মালামাল রেখে দেদারছে চলছে ব্যবসা। আলু বাজারের এক ব্যবসায়ীর দোকানের সামনেই রাখা বাথরুমের ফিটিংস সামগ্রী। তিনি নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, এজন্য পুলিশকে প্রতিদিন টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে পুলিশ ঝামেলা করে। বংশাল থানার সামনে গিয়ে দেখা গেছে, পুলিশের গাড়ি দিয়ে রাস্তার বেশিরভাগ জায়গা দখলে রাখা হয়েছে। সেখানে সারাদিনই যানজট লেগে থাকে। থানার সামনেই রাস্তার উপর স্টিলের আলমারি রাখা হয়েছে। কোনোটার রঙ করা হচ্ছে। কোনোটার ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। একজন কর্মচারি বলেন, পুলিশকে টাকা না দিলে রাস্তা দখলের সুযোগ মেলে না। থানার সামনে বলে পুলিশ কোনো খাতির করে না।
ধোলাইখালের পুরো রাস্তাই লোহা ব্যবসায়ীদের দখলে। ফুটপাথ ছাপিয়ে রাস্তা দখল করে চলছে ওয়েলডিংয়ের কাজ। পুরাতন গাড়ির যন্ত্রাংশও রাখা হয়েছে রাস্তার উপরই। একজন ব্যবসায়ী বলেন, ধোলাইখালের ব্যবসা মানেই রাস্তার উপরে হতে হবে। রাস্তার উপর ছাড়া এখানে ব্যবসা জমে না। ওই ব্যবসায়ী জানান, পুরান ঢাকার মধ্যে ধোলাইখালের ফুটপাথ ও রাস্তার রেট সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে, পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক হয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকা থেকে ল²ীবাজার পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে অবৈধভাবে বসেছে শতাধিক অস্থায়ী অবৈধ দোকান। এমনিতেই এ এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। আবার অন্যদিক দিয়ে বাণিজ্যিক এলাকা। রাস্তায় মানুষ ও যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ লেগেই থাকে। প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন পথচারিরা। এ এলাকায় সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাস্তা দখল করে রমরমা ব্যবসা চলে বলে জানান এখানকার হকাররা। এজন্য থানা পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ ও ফাঁড়ি পুলিশকে পৃথকভাবে চাঁদা দিতে হয়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা গভর্নমেন্ট মুসলিম হাইস্কুলের সামনে থেকে ল²ীবাজার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গার্লস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে ও সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সামনে পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে ফুটপাত দখল করে আছে হরেক রকমের অসংখ্য দোকান। এসব দোকানে কেনাকাটা করতে প্রতিনিয়ত ভিড় করছেন ক্রেতারা। বিশেষ করে মেয়েরা বেশি ভিড় করে থাকেন। এসব ফুটপাতের দোকান বিকাল হলে সকালের তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। পর্যাপ্ত জায়গা না পেয়ে সড়কে চলাচল করছেন পথচারী ও আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এসব দোকানের ময়লা-আবর্জনা সড়ক ও ফুটপাতে ছড়িয়ে আছে।
এদিকে, রাজধানীর গুলিস্তানের ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে চুটিয়ে ব্যবসা করছে হকাররা। তাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে যান চলাচল। যানজটের সৃষ্টি হয়ে আটকে থাকছে গাড়ি। অথচ সেদিকে পুলিশের কোনো নজর নেই। হকাররা জানায়, রাস্তা দখল করে দোকান বসানোর জন্য পুলিশকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের হয়ে লাইনম্যানরা এই টাকা আদায় করে। সে কারণেই রাস্তায় দায়িত্বরত পুলিশ সবকিছু দেখেও দেখে না। যানজটে গাড়ি আটকে থাকলে তারা গাড়িগুলোকে সরাতে ব্যস্ততা দেখালেও রাস্তা দখলমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেয় না। শুধু ফুটপাত ও রাস্তা নয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৮টি মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গা এখন দখলদারদের কবলে। এসব পার্কিং স্পেসে দোকান বরাদ্দ দেওয়ায় সেসব ব্যবহার হচ্ছে বাণিজ্যিক কাজে। এতে মার্কেটের কাজে আনা গাড়িগুলোকে রাখতে হয় রাস্তার ওপরে। স্বাভাবিকভাবেই মার্কেটগুলো ঘিরে তৈরি হচ্ছে তীব্র যানজট। বিপাকে পড়ছেন গাড়ি নিয়ে আসা ক্রেতা-ব্যবসায়ীরা।
ফুটপাথ ও রাস্তা দখলমুক্ত করতে রাজধানীতে ঢাকঢোল পিটিয়ে চালানো হয় অভিযান। লাখ লাখ টাকা খরচ করে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। গত ৫ বছরে একাধিকবার অবৈধ দখলে থাকা রাস্তা, ফুটপাথ ও মার্কেটের স্পেস উদ্ধারের উদ্যোগ নিলেও দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযানে গিয়েও ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। আবার আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়েও বের হয়ে গেছেন অনেকেই।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, পুরান ঢাকায় আর্থিকভাবে প্রভাবশালীরাই এক সময় বসবাস করতেন। সে কারণে তারা রাজনৈতিকভাবেও প্রভাবশালী। সেখানে জনসংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু ব্যবসার ক্ষেত্র সেভাবে প্রসারিত হয়নি। যে কারণে যতো দিন যাচ্ছে সমস্যা ততোই বাড়ছে। রাস্তা, ফুটপাথ, অলিগলি দখলের মাত্রাও বাড়ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযান ও নিলামে মালামাল বিক্রির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, দক্ষিণের মেয়রকেও একইরকম উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবার উপর আইন প্রয়োগ করতে হবে না। একটা নজির স্থাপন করলেই বাকিগুলো নিয়মের মধ্যে এসে যাবে। তিনি বলেন, দক্ষিণের মেয়র রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও জনগণের সেবা নিশ্চিতে খুবই আন্তরিক। দায়িত্ব নিয়ে তিনি এরই মধ্যে অনেক চমক দেখিয়েছেন। আমার বিশ্বাস তিনি পারবেন এই দখলদারিত্ব থেকে পুরান ঢাকাকে মুক্ত করতে। তাতে জনগণের দুর্ভোগ কমবে। যাতায়াত বাড়বে। অর্থনীতি আরও সচল হবে। সিটি করপোরেশনেরও রাজস্ব বাড়বে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন