জাহাঙ্গীর আলম সরকার
(পূর্বে প্রকাশিত এর পর)
আজ বুদ্ধিজীবী মহলে এ কথা খুব বেশি আলোচিত হচ্ছে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- সম্পর্কিত শিক্ষা ব্যবস্থা যদি সংযোজন করা যায় প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে তা ফলদায়ক হতে পারে। বর্তমানে ছবি আঁকা প্রাথমিক স্তর থেকে বাধ্যতামূলক। যার কারণে শিশুরা এদিকে বেশ মনোযোগী হচ্ছে। কিন্তু সব শিশুর ঝোক ছবি আঁকাতে থাকবে এমনতো কথা নেই। তাই অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়েও ভাবতে হবে। সঙ্গীত, নাট্যকলা, আবৃত্তি ইত্যাদি বিষয় ধীরে ধীরে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সংযোজন করা যেতে পারে। শিক্ষা ব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক কর্মকা- বিষয়ক সিলেবাস যুক্ত করতে হলে এ বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষক হয়তো প্রথম দিকে তেমন পাওয়া যাবে না। তবে সেজন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকলে তাও সমাধান করা সম্ভব।
মনে রাখতে হবে শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চাই পারে মানবীয় গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধন করতে। সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে তাই এর চর্চা ও ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়া এর উৎকর্ষ বিকাশ সম্ভব নয়। প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো দীর্ঘ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। যেখানে সংস্কৃতির চর্চা হবে অবাধে।
আমরা সঙ্গীত বিষয়ক ভাবনাতে যদি থাকি, বলতে পারি সঙ্গীত এমন একটি মাধ্যম যার ব্যবহার আধুনিক বিশ্বে নতুনভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। মানুষের বিনোদন চর্চার বড় হাতিয়ার ছাড়াও সঙ্গীত আজ চিকিৎসা বিদ্যা এমনকি কৃষি কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এর এমনই অপ্রতিরোধ্য শক্তি যার প্রভাব সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বিধায় প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালিত হোক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রগতিশীল গুণী ও প্রকৃত শিক্ষিত ফ্যাকাল্টিস দ্বারা। বাঙালির ধর্ম তার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। একুশ শতকের এ সময়ে অনেক দেরিতে হলেও আমাদের স্বকীয়তা বাঁচিয়ে রাখার এ পথটিই অনন্য। হাজার হাজার ধর্ম শিক্ষালয় হয়েছে। দোষের কিছু নয়, কিন্তু মনে রাখা দরকার যতদিন না বাঙালি সংস্কৃতির সংশ্রবের মধ্য দিয়ে ফিল্টারিং হয়ে ধর্ম শিক্ষা সমাজে বিস্তৃতি লাভ করবে ততদিন দু’টি ধারা সর্বদাই একে অপরকে অপছন্দ করবে। তবে সমান্তরালে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিম-লের সকল বিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক প্রসার না ঘটালে ভবিষ্যতে এই দুই ধারার মধ্যে ভারসাম্য বেড়ে গেলে কারো জন্যেই তা মঙ্গল বয়ে আনবে না। বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু সেই ভারসাম্যহীনতারই ফলাফল, যা অনিবার্যভাবেই কারো মঙ্গল বয়ে আনছে না। মানবিকতাই মানব ধর্ম, যা সকল পাঠ্যধর্ম দ্বারা সিদ্ধ। কিন্তু মানবিকতা অর্জনের জন্য যে সকল কম্পোজিট শিক্ষা একজন মানুষকে শিখতে হয় শুধুমাত্র ধর্ম শিক্ষা দ্বারা সেটা পূরণ হবার নয়। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সাহিত্য সাংস্কৃতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ধর্মীয় শিক্ষা এরকম ‘দশে মিলে এক’ হলে সেখানে মানবিক শিক্ষা অর্জিত হতে পারে।
সঙ্গীতের শক্তি অসীম। যেখানে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি বিপরীতধর্মী কিংবা শত্রুশক্তি হিসাবে ক্রিয়াশীল থাকে সেখানেও সাঙ্গীতিক শক্তি চূড়ান্ত সত্যের পক্ষে, মানবতার পক্ষে, সমবেদনা ও সহমর্মিতা দেখাতে সক্ষম হয়। জর্জ হ্যারিসন বা প-িত রবিশংকর কর্তৃক বাংলাদেশের মক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে খোদ আমেরিকায় কনসার্ট করে শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বিশ্ববাসীর দরবারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থান তুলে ধরার প্রচেষ্টা সঙ্গীতের বিশ্বশক্তিমত্তার এক অনন্য স্বাক্ষর।
যুদ্ধ যখন অনিবার্য ভেবে কোন জাতির মুক্তির একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়ায় তার অস্তিত্বের সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ায়, হয়ে দাঁড়ায় আত্মপরিচয় বিনির্মাণের অবিকল্প পটভূমি-আর সেই জাতি যদি হয় মেধা মননে হৃষ্ট, ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের দীর্ঘ ইতিহাসে গৌরবান্বিত তাহলে তার বাসনা পূরণের মাধ্যম হিসাবে সংগীত কেবল প্রেরণার উৎস হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তা হয়ে উঠে অস্ত্রের সমকক্ষ কখনোবা তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী।
সংগীত যুদ্ধের মাঝেও শান্তিকে পূজা করে আর বিচিত্রের মাঝে এককে পূজা করে। সৃষ্টিকর্তা সকলকে সমভাবে এ বিদ্যা দেন না। এর জন্য সাধনা করতে হয়। যাকে যতটুকু দেন সে যদি তা মূল্যবান মনে করে ধরে না রাখে তবে সৃষ্টিকর্তা তার থেকে তা আবার কেড়েও নেন। সঙ্গীতকে ধারণ করতে হয়। যথাপোযুক্ত মর্যাদা দিয়ে প্রেমের সাথে কেউ যদি এ বিদ্যা ধারণ না করে তবে তার কাছে এ বিদ্যা থাকে না। আমাদের জানা শোনার মাঝেই এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। কাজেই এর গুরুত্ব অনুভব করতে হবে আর পরম শ্রদ্ধার সাথে তা লালন করতে হবে তা না হলে এ পাখি ঘরে থাকবে না। যতটা ভালবাসি আমাদের নিজেদের জীবনকে তার চেয়ে বেশি ভালবাসলে সঙ্গীত তাকে আঁকড়ে থাকবে।
এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গীত শেখার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা সঙ্গীত সম্পূর্ণরূপে গুরুমুখী শিক্ষা। এ শিক্ষা যারা গুরুর থেকে নেননি, তাদের মধ্যে সঙ্গীতের প্রতি সে ভালবাসা, শ্রদ্ধা জন্মায় না। সঙ্গীতের প্রতি ভক্তি আসে না। সে নিজেকে একক ভাবতে শুরু করে। সঙ্গীতের কোন ঘরানা বা শ্রেণীর উত্তরসূরি সে নয়। তাই গর্ব তার মাঝে জন্ম নেয়। অহংকার তাকে একরোখা করে তোলে। আমাদের দেশে সঙ্গীত শেখার বড় কোন প্রতিষ্ঠান না থাকলেও ইদানীং পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা শিখে আসছে। বিশ্বভারতী ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিখে আসা সঙ্গীত শিল্পীদের পদচারণায় আমাদের সঙ্গীত ভুবন এখন খানিকটা মুখরিত। এর মাঝে কিছু আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও বিভিন্নভাবে গান চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মাঝেও কিছু প্রতিভার ছোঁয়া দৃশ্যমান।
স্বাধীনতা অর্জনের এতগুলো বছর পরেও আমরা এখন পর্যন্ত কোন পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় পাইনি। প্রগতি ও উন্নয়ন যদি ত্বরান্বিত ও স্থায়ী করতে হয় তবে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন আছে। আমাদের দেশে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সঙ্গীত শেখার ব্যবস্থা থাকলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। পুরো দেশকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে কয়েকটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় চালুর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এখনই শুরু করতে হবে। যেখানে সংস্কৃতির সাথে জড়িত সকল বিভাগের পড়াশুনা হবে। সকল বিভাগের প্রয়োজন মতো পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা প্রয়োজন তা সবই করতে হবে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত এমন কোন বিষয় থাকবে না যা সেখানে চর্চা হবে না। গান, নাটক, শিল্পকলা, চারুকলা, সিনেমা, আবৃত্তি, নৃত্যকলা, সাহিত্য চর্চা, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি সকল বিষয় যা যা সংস্কৃতির অনুষঙ্গ তা সবই সেখানে পড়ানো হবে।
পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সাংস্কৃতিক শিক্ষা অব্যাহত থাকলে তা থেকে দেশ ও জাতি অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই উপকার পেতে থাকবে। সংস্কৃতি চর্চার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সরকার জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় যে সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ অশুভ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য ভূমিকা রাখবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
লেখক: উপ-পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন