শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

সত্যের মা মরে গেছে

প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফাহিম ফিরোজ
‘সত্যের মা মরে গেছে’- এ কথা সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। কথাটি তখনই শুনি যখনই কেউ বড় ধরনের কোনো মিথ্যা কথা বলে, সত্যকে পাশ কাটিয়ে যায়, কিংবা পাত্তা দেয় না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের বিভিন্ন ঘটনা থেকে বুঝতে পারি, ‘সত্যের মা বোধ হয় মরেই গেছে’। বর্তমানে এই কথাটি বিভিন্ন আড্ডা-আলোচনায় বেশি শোনা যায়। এর একটা কারণও রয়েছে। জনসংখ্যা আমাদের দিন দিন বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে নানা সমস্যাও। ফলে সত্য থেকে মিথ্যার গতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সমাজে নানা সংঘাত, এমনকি প্রাণনাশ এবং রক্তরক্তির ঘটনাও।
১. অনেক দিন ধরেই গ্রামের একজন অতিবয়স্ক মুরব্বির সঙ্গে আমার জানাশোনা। বয়সের কারণে অন্যরা তাকে একটু বিশেষ সম্মান করে থাকে। ওই ব্যক্তি একটু লোভী প্রকৃতির। টাকার মোহে তিনি নিজের পিতার কবরের জায়গাটাও বিক্রি করে দেন। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই নিন্দামুখর হয়ে ওঠে। কিন্তু তাকে যখন বিষয়টি জানানো হয় সঙ্গে সঙ্গে তিনি উত্তর দেন এটা মিথ্যা কথা।
২. এদেশের অতিথি আপ্যায়নের সুনাম রয়েছে আবহমানকাল ধরে। বিদেশ থেকে এদেশে ঘুরতে আসা ব্যক্তিবর্গও এ কথা স্বীকার করেন। গত বছরের একটি ঘটনার কথা বলি। ২৮ জনের একটি কবি-সাহিত্যিকের দল ভারত থেকে মুন্সীগঞ্জের একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসে। এদের জন্য নজিরবিহীন আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। প্রকৃতিসহ অনুষ্ঠানের বিস্তর প্রশংসা করেন তারা। যাওয়ার সময় বলেন, ভারতের মিডিয়ায় এসব কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা লিখবেন। আমরাও আশায় বুক বেঁধে বসেছিলাম। ভারতীয় মিডিয়ায় আমাদের প্রশংসা তো দূরের কথা, এই বিশাল অনুষ্ঠান নিয়ে তারা কিছুই লেখেননি। এমনকি মাত্র একজন লেখক ছাড়া অন্যরা কেউ আয়োজকদের কাছে ফোনও করেননি।
৩. আমাদের গ্রামের বাড়ি মফস্বলে। ক’বছর আগে সেখানে একটি পশু হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে। এই হাসপাতাল নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে সাদা রঙের কম মজবুত ইট। এটা অনেকের চোখেই পড়েছে। কিন্তু অজানা আশঙ্কায় কেউ মুখ খোলেনি। কয়েক মাস আগে সরকারি নির্মাণ কাজে একটি জেলায় রডের বদলে বাঁশ ব্যবহারের সচিত্র খবর ছাপা হয়েছে। এভাবে ভবন নির্মাণ যে সম্পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ এতে কোনো সন্দেহ নেই।
৪. বহুদিন ধরে দেখে আসছি, ট্যানারির আবর্জনাসহ নানা কারণে বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত হচ্ছে। এ পানি হোটেলে ব্যবহারের কথাও শোনা যায়। বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার কথা বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে। ভাবলাম, বিভিন্ন মহলের কথা সত্য হবে। কিন্তু কই?
৫.ছোটবেলা থেকে ভাবতাম বইপত্র-পত্রিকায় যা লেখা হয় তা সত্য। আসলে এই ভাবনা যে পুরোপুরি সত্য নয় তা একটু বড় হয়ে বুঝতে পারলাম। টাকা থাকলে এখন বইপত্র-পত্রিকা প্রকাশ করা কোনো ব্যাপারই নয়। দেখা যাচ্ছে, কোথাও কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে অথচ একই সংবাদ নানা রং-চং মাখিয়ে একেক পত্রপত্রিকায় একেক রকমভাবে ছাপা হচ্ছে। এতে পাঠকরা হচ্ছে বিভ্রান্ত। বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই। সরকার বদলের পর বইয়ের কোনো না কোনো অংশও বদল হয়ে যায়।
৬.সব সরকারের সময়ই দেখা যায় দ্রব্যমূল্য যাতে ঊর্ধ্বমুখী না হয় এ বিষযে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দিতে। দেখা যায় নানা পদক্ষেপ নিতে। কিন্তু কিছু দিন পরই সেই উচ্চকণ্ঠের ঘোষণাও থেমে যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোখার কেউ থাকে না।
৭.ঢাকায় বর্ষাকালে পানি জমে যাওয়া নতুন কিছুই নয়। একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকার কিছু রাস্তায় পানির কারণে মানুষের চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনকি ভয়াবহ দুর্ঘটনাও ঘটে থাকে। রিকশারোহী যাত্রী যখন পানির নিচে কোনো গর্তে পড়ে যায় তখন ওই বেচারার যে কী অবস্থা হয় তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। অথচ নগর উন্নয়নে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা শোনা যায়। ওই সব পদক্ষেপ কমই কার্যকর হয়। প্রতিবছর মানুষের যে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়, এটা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের যেন চোখে পড়ে না।
৮.খাদ্যে ভেজাল নিয়েও কিছু বলতে হয়। মাঝেমধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযানের কথা মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হয়। সাধারণ মানুষ ভাবে এই বুঝি দেশ থেকে খাদ্যে ভেজাল দূর হয়ে যাবে। আসলেই কি খাদ্যে ভেজাল দূর হয়েছে? বাজারে কি এমন কোনো খাদ্যদ্রব্য, শাক-সবজি, মাছ আছে যা ভেজালমুক্ত? আমরা প্রতিদিন যা বাজার থেকে কিনি এবং খাই আমাদের পাকস্থলি বিশেষভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে কী পরিমাণে খাদ্যের নামে অখাদ্য পাকস্থলিতে জমে আছে। প্রতিনিয়ত ভেজাল খাবার খেয়ে ধীরে ধীরে আমরা অজান্তেই নানা অসুখ-বিসুখে জড়িয়ে যাচ্ছি। অথচ এই দেশে এমন একদিন ছিল যখন খাদ্যে ভেজাল ছিল না। বিশুদ্ধ খাবার খেয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষরা বলিষ্ঠ শারীরিক কাঠামোর অধিকারী ছিলেন, নিরোগ ছিলেন এবং সেই সঙ্গে দীর্ঘায়ুর অধিকারী ছিলেন। উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলে বিভিন্ন শাসককে ভেজালবিরোধী অত্যন্ত কঠিন আইন চালু করতে দেখা গেছে এবং এর জন্য শাস্তিও ছিল কঠোর। আর এখন?
৯.সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগরে বহু পুরনো একটি প্রতœ ঢিবির সন্ধান পাওয়া গেছে। বিভাগীয় অধিদফতরের একটি প্রেস রিলিজেও জীবননগর ও সদর উপজেলার কথা উল্লেখ আছে। অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা ওই ঢিবি পরিদর্শন করেছেন এবং স্থানীয়দের কাছে তারা খনন করবেনÑ এ কথা বলেছেন। সেই ঢিবিতে দেখা সম্প্রতি গেল রহস্যময় দুটো গর্ত। এ বিষয়ে স্থানীয়দের সংগ্রহ করা একটি ছবি বিভাগীয় প্রধানকে পাঠানোর জন্য বারবার তার ই-মেইল নম্বর চেয়েও পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে একজন সাংবাদিক শক্তিশালী একটি তদন্ত টিম গঠনের কথা মিডিয়ায় প্রকাশ করেও কোনো ফল পাননি।
সত্য অনেক কঠিন এবং রূঢ়। সত্য থেকে আজ আমরা বিচ্যুত বলেই দেশে ও সমাজে নানা সমস্যা ও সংকট দেখা দিচ্ছে। আসুন, সবাই আমরা সত্যের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিই। অন্ধকার থেকে নিজেদের আলোয় টেনে তুলি। তাহলে আর শুনতে হবে না সত্যের মা মরে গেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন