বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

অভিনেতা

প্রকাশের সময় : ১২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
মেয়েটা একা থাকে? বিমূঢ় আর নির্লজ্জের মতো প্রশ্ন করে বসে শোভন।
তার আগ্রহী মুখ আর কথা বলার ভঙ্গি দেখে চোখ রাঙানি দেয় শাহেলা, ‘ওর বাবা-ভাই কেউ শহরে থাকে না, সে একা না থেকে কী করবে?’
সবেমাত্র দু’দিন হলো ‘একা’ থাকা মেয়েটির সাথে পরিচিত হয়েছে শোভন। মেয়েটার নাম ছায়া রহমান অথবা শুধু ‘ছায়া’। শাহেলাই তার একমাত্র বান্ধবীকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে শোভনের সাথে। মাত্র এ ক’দিনেই ছায়ার জন্য শোভনের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ দেখে বিস্মিত দেখায় শাহেলাকে। নিজের প্রিয় মানুষটিকে চুপ থাকতে দেখে চুপ মেরে থাকে শোভন। তার মনে হয় আজকের আড্ডাটা কোনোভাবেই জমছে না যেন। হঠাৎই শাহেলার মনের কথাগুলো যেন আঁচ করতে পারে সে।
‘তুমি কি ভাবছো আমি তোমার বান্ধবীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি?’  
বিনা সংকোচে বলা কথাগুলো শোভনের মুখ থেকে শুনতে পেয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে শাহেলার। শোভনের কাছে ছোটো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মুহূর্তে হেসে বলে, ‘সেটা ভাবার কি কোনো কারণ আছে?’ কথাটা বলেই বলে, ‘ভাবছি ইংল্যান্ড চলে যাব।’
   ইংল্যান্ড চলে যাওয়ার কথাটা আরো বারকয়েক শাহেলার মুখে শুনেছে শোভন। কিন্তু কখনোই পাত্তা দেয়নি কথাটা। কিন্তু আজ শাহেলার মুখে থমথমে ভাব দেখে খানিক শঙ্কিত হয় সে। শাহেলার চোখে অন্য রকমের ছায়া দোলে। সেই ক্ষণিকের রূপ বদল করা ছায়াটাকে ধাওয়া শেষে মুহূর্তেই পরাজিত করে ফেলে শোভনের নিজস্ব চিন্তা-চেতনাকে। শাহেলার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘হঠাৎ ইংল্যান্ড যাওয়ার শখ হলো?’
শাহেলা তার কথার জবাব দেয় না। মনে মনে ভাবে, সে কি ভুল করতে যাচ্ছিল?  
    নিজের কাছ থেকে জবাব না পেয়ে সে ইতিউতি তাকায়। পার্কে থাকা প্রেমিক যুগলদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এমন দৃশ্য শাহেলার চোখে বেশ লাগে। একটা সময় ছিল যখন সে আর লাবণ্য পার্কে এভাবেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে থাকতো, বাদামের খোসা উড়াতে উড়াতে ফুসুর ফুসুর আলাপ চালাতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কথার রাজ্যে হারিয়ে যেত কখন যে বসন্তের বিকেলটা কেটে যেত তা টেরই পেতনা শাহেলা। পাবেই আর কী করে। কত ভঙ্গিতে কত ধরনের কথা বলতো লাবণ্য। তার প্রতিটি কথাই ভালো লাগতো শাহেলার। মাঝে মাঝে হুট করে এমন সব কাজ করতো লাবণ্য, যাতে শাহেলার ভ্রু কুঁচকে না গিয়ে পারতো না। তার বিস্মিত ছাপ মুখ থেকে কখনো লুকোতে পারতো না সে। এই তো সেদিন। মাসছয়েক আগের এক বিকেল। জিয়া উদ্যানের পূর্ব-দক্ষিণ কোণায় একটা বেঞ্চির উপর বসে কথার ফোয়ারা ছোটাচ্ছিলো লাবণ্য। জানো আজ কী হয়েছে? শাহেলা না সূচক মাথা দোলাতে দেখে লাবণ্য দ্বিগুণ উৎসাহে তার কোনো এক বান্ধবীর আট দশটা প্রেমিকের কথা এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে। তারপর মনে পড়ার ভঙ্গিতে হঠাৎ-ই বলে ফেলে, ‘ক্লোজ ইউর আইজ, প্লিজ। সারপ্রাইজ দেবো।’
শাহেলা চোখ বন্ধ করে অবাক হওয়ার অপেক্ষা করে। কিন্তু যখন চোখ খোলে ততক্ষণে লাবণ্য হাওয়া। পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ তাকিয়ে লাবণ্যকে না দেখে শাহেলার কেমন যেন অবাক লাগে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে খুব। তাকে খুঁজে ফিরে না পেয়ে বারবার মনে প্রশ্ন এসে ভিড় জমায়, সে কেন এমন করলো? সে এমন করতে পারলো? তার কি মনে নেই আজ শাহেলার জন্মদিন? শাহেলা মুখ অন্ধকার করে বসে থেকে আগত কান্না চাপা দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তখনি কোনদিক থেকে যেন গোলাপের একটা কুঁড়ি এনে লাবণ্য বলে ‘হ্যাপী বার্থ ডে, শাহেলা! শুভ জন্মদিন!’ সেদিন তার সে কথা শুনে কী যে ভালো লেগেছিল শাহেলার! কতই না সুন্দর ছিল সেদিনের দিনগুলো। কতই না সুন্দর সময় কাটতো তাদের।
    লাবণ্যের কথা ভাবতেই শাহেলার মনে বহুদিনের প্রশ্নটা আবারো জেগে ওঠে। তার সাথে লাবণ্যের এমন না করলেই কি চলতো না? তাকে কত না ভালোবেসেছিল শাহেলা। ভেবেছিল ছেলে হিসেবে লাবণ্যের কোনো জুড়ি নেই। কিন্তু একদিন শাহেলা ঠিকই জানতে পেরেছিল লাবণ্যের মায়াময় চেহারার আড়ালে কতটা দক্ষ অভিনেতা সে। তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে কখনো বলেনি সে। কেনই বা বলবে? বললে কি আর কোনো নির্জন দুপুরে শাহেলাকে এত কাছে পেত লাবণ্য? কিন্তু যেদিন বিয়ে করলো, ওর স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো শাহেলাকে এই বলেÑ ওর নাম শাহেলা, আমার দূর সম্পর্কের বড়বোন। সেদিন শাহেলার ইচ্ছে করছিল লাবণ্যের মুখোশ খুলে দিতে। কিন্তু শাহেলা সেদিন কিছুই করে নি। এরপরেও কতদিন লাবণ্যের সাথে দেখা হয়েছে। কই সে তো কখনো আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করেনি সে কেন এমন করলো? শাহেলা তার অতীত এখনো জানায়নি শোভনকে। জানাবেও না হয়তো। আচ্ছা, ছায়ার ব্যাপারটা কি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে শাহেলা? ভেবেচিন্তে নিজের  কাছেই প্রশ্নের উত্তর পায় না সে। শোভনকে কিছু বলার আগেই সবুজ ফুলতোলা শাড়িপরা ছায়াকে আসতে দেখা যায়। সুবজ শাড়ি ? সন্দেহের চূড়ান্ত ফল পেতে বুকের ভেতর ধক-ধক শব্দের উপস্থিতি টের পায় শাহেলা। শোভনের প্রিয় রং সবুজ। শোভনকে নতুন করে দেখে শাহেলা। শোভনও  আজ সবুজ শার্ট পরে এসেছে। শোভন তাকে কতবারই না অনুরোধের সুরে বলেছে, সবুজ শাড়ি পরবে? কিনে দেব একটা? ফুল তোলা সবুজ শাড়ি? শাহেলা বরাবরই না বলেছে।
    তার ভাবনা বেশি দূর এগুতে না দিয়ে ছায়া ধপ করে বসে পড়ে শোভনের পাশে। শাহেলার মনে হয়, কেমন যেন গা ঘেঁষে ঘেঁষে বসা। কতদিন এভাবেই বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করেছে শাহেলা আর লাবণ্য কিংবা শোভন আর শাহেলা। শাহেলার মাথা ঘুরতে থাকে। ভন-ভন-ভন ঘোরা। কষ্ট হলেও সে অস্পষ্ট শুনে শোভনের প্রশ্নসংবলিত কণ্ঠস্বর, তুমি এত দেরি করে এলে যে? প্রশ্নটা ছায়াকেই করেছে শোভন বুঝতে অসুবিধা হয় না শাহেলার। তার মানে কি ছায়াকে আগে থেকেই এখানে আসতে বলে দিয়েছে শোভন? আর তুমি করে বলাটা ? গতকালই যেটা আপনি ছিল, সেটা আজ তুমি হয়ে গেলো ? শাহেলা আর ভাবতে পারে না। এক সময় ঠিক করে ফেলে বাবার দেশেই পাড়ি জমাবে সে। বাবাকে ইংল্যান্ডে গিয়ে বলবে, আমার জন্য একটা ভালো পাত্র দেখ, বাবা!
    কিচির মিচির হাসির শব্দে ভাবনা ছেয়ে শাহেলা ছায়ার দিকে তাকায়। হাসতে হাসতে সে শোভনের গায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ছে যেন। কী নির্লজ্জ! কুৎসিত! কত জঘন্য! শাহেলার মাথাটাকে বায়ুশূন্য মনে হয়। ছায়া কি শোভনের পূর্ব পরিচিত? হয়তো পরিচিত ছিল। তবে কি শাহেলার মাধ্যমে শোভনের সাথে ছায়ার পরিচয় পর্বটা ছিল সুসজ্জিত নাটক? ওরা দু’জন যে অভিনয়ে পাকা, অভিনয় করেনি তা কী করে বিশ্বাস করবে শাহেলা? শোভন ছায়ার হাসি মুগ্ধ নয়নে দেখলেও শাহেলার কপালে, নাকের ডগায় ঘামের চিক-চিক পানি তার চোখ এড়ায় না। ছায়াকে দেয়া শাড়িটা তো সে শাহেলার জন্যই কিনেছিল। কিন্তু সে তো তার ভালো লাগার মূল্যায়ন করেনি কখনো। তবে তাকে চিন্তিত দেখে নিজের খারাপ লাগার কী আছে? কিছুই নেই! ছায়ার সাথে স্কুল জীবন থেকে পরিচয় থাকলেও শোভন কি জানতো সে শাহেলার বান্ধবী? ছায়াকেই সেক্ষেত্রে বেছে নিবে সে। ছায়া জানে শাহেলা তার বান্ধবী। শুধু-ই বান্ধবী। লতাপাতার বান্ধবী। প্রেমের কথাগুলো বহু যতনে বহুদিন থেকেই ছায়ার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে শোভন।
    অবশেষে ছায়া শাহেলার সাথে কথা বলে। হাসিমাখা কথা। ‘শাহেলা, তুই একটু বোস্, আমি শোভনকে নিয়ে একটু ওদিকটা বেড়িয়ে আসি। জানো তো আজ ওর জীবনের একটা বিশেষ দিন।’
শোভনের জন্মদিন আজ! নিজের অজান্তেই হাসি হাসি মুখ করে নব প্রেমিক যুগলকে সম্মতি দিয়ে দেয় শাহেলা। শোভন আর ছায়া রহমান উঠে দাঁড়ায়। ছায়ার ডানহাতটি আস্তে করে ধরে এক পাÑ দু’পা করে পশ্চিম কোণে এগিয়ে চলে শোভন। পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ হয়ে হাঁটে ওরা। পেছনে বসে রয় শাহেলা। নি®প্রাণ চাহনিতে দৃশ্যগুলো আনকাট অবস্থায় দেখতে থাকে সে। কত চমৎকার আর সুন্দরভাবে অভিনয় করলো ওরা। তার কথায় সায় দিয়ে একটা মাছি ভন ভন করে এসে শাহেলার হাতে বসে। শাহেলা অবাক হয়ে শোনে, দূর থেকে ভেসে আসা শোভনের বাঁধভাঙা হাসি শুনে সহসাই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে  গিয়ে প্রচ- রাগে চিৎকার করে ওঠে শাহানা, ‘অভিনেতা! অভিনেতা!’
শোভন আর ছায়া দূর থেকে শাহেলার শুনতে পেলেও তাদের কোনো ভাবান্তর হয় না। হাসতে হাসতে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যেতে থাকে তারা।
পার্কের উৎসাহী লোকজন কান্নারত মেয়েটির চারদিকে ভিড় জমাতে শুরু করে। ওদিকে শোভন আর ছায়া পরস্পরের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় দূরে মিলিয়ে যায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন