রাম, ঈশ্বর, ভগবানে ওদেরও বিশ্বাস। মুসলমানরা কখনো এ সব নামের প্রতি অবমাননা, অবজ্ঞা প্রদর্শন করে না। কিন্তু ওরা কেন আল্লাহর নাম শুনলে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে? কেবল আল্লাহর নাম নয়, নামের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং তার গুণবাচক নামও ওরা কেন সহ্য করতে পারে না? কেন এ হীনতা, কাপুরুষতা? রাম ভক্ত, ঈশ্বর পূজারী ও ভগবানে বিশ্বাসীরা আল্লাহর নাম শুনলে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
আল্লাহ নামের সাথে রহমান ও রহীম দু’টি গুণবাচক শব্দ যোগ হয়ে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বাক্যটি গঠিত হয়েছে। বহুত্ববাদী-অংশীবাদীরা এ বাক্যের সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিচয়টাকে পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না। ৭৮৬ সংখ্যাটি তাদের জন্য যেন যমদূত।
‘বিসমিল্লাহ’ শরীফের মহিমা-মাহাত্ম্য কেবল মুসলমান তওহীদবাদীদের কাছেই স্বীকৃত নয়, বহু তওহীদ বিরোধী অংশীবাদীর নিকটও স্বীকৃত এবং তারাও ‘বিসমিল্লাহ’-এর প্রতি সম্মান করে থাকেন। এরূপ বহু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু, অবাক ও বিস্ময়য়ের সাথে লক্ষ করা গিয়েছে যে, অংশীবাদী, তুলসী পূজারী কিছু লোক ‘বিসমিল্লাহ’-এর সংখ্যাতাত্ত্বিক নিদর্শন ‘৭৮৬’ সংখ্যাটিকেও সহ্য করতে পারে না। এর স্পষ্ট প্রমাণ রেখেছে ভারতের কিছু তুলসি পূজারী। তুলসি পূজারির কথাটি এ জন্য বললাম যে, হজরত নিজাম উদ্দীন আওলিয়ার প্রধান খলিফা ভারতের বিখ্যাত কবি আমির খসরু (র.) বহুত্ববাদীদের তুলসি পূজারী হিসেবে আখ্যায়িত করে গেছেন। তিনি বলেছিলেন:
‘গুলো বর্গে তুলসি ব-একজানে হিন্দ,
হরিবোলা গুয়েন্দে সেজদা দেহেন্দ’
অর্থাৎ- হিন্দুদের প্রাণের টুকরা হচ্ছে তুলসি বৃক্ষ-ফল, যা দেখা মাত্র হরিবোল হরিবোল বলে সেজদা শুরু করে দেয়। অথচ হজরত নিজামুদ্দীন আওলিয়া (রহ.) ওদের সম্পর্কে যে উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন, তা সূফী সাধক মহলের মধ্যে অনেকের মনোপূত না হলেও কেউ তার প্রতিবাদ করেন নি। তিনি বলতেন, ‘বা বারহামান রাম রাম, বা মুসলমান আল্লাহ আল্লাহ।’
ব্রাহ্মণ যদি রাম রাম বলে, তাদের সাথে মুসলমান রাম রাম বললে তাতে দোষের কিছু নেই। অনুরূপভাবে মুসলমানের সাথে ব্রাহ্মণও আল্লাহ আল্লাহ বলতে পারে।
সাধকের এ বিখ্যাত বক্তব্য সম্পর্কে সে সময় আলেমদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমর্থনে আলেমদের অপর এক শ্রেণি জোরালো প্রমাণ হিসেবে মনে করতে থাকেন এবং তাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। কেননা তারা ধর্মীয় সম্প্রীতিকে এ উক্তির অন্তর্ভুক্ত করতে থাকেন। প্রথম শ্রেণির আলেমদের বক্তব্য ছিল, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি এক নয়। কেননা ধর্মীয় সম্প্রীতি নামে মুসলমানরা শির্ক বা অংশীবাদের সাথে কিছুতেই আপোস করতে পারে না। রসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম শির্কের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছেন। পক্ষান্তরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দুনিয়াবী নানা ব্যাপারকে অন্তর্ভুক্ত করে। এ সম্পর্কে বলার অনেক কথা আছে। বর্তমান কালেও এক শ্রেণির ধর্মপ্রচারকারী ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে একাকার করে বিভ্রান্তির বিস্তার করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বলছিলাম সংখ্যাতত্ত্ব ৭৮৬-এর কথা, দুই কুলাঙ্গার ভারতে একজন মুসলিম যুবকের হাত কর্তন করে দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, ঐ মুসলিম যুবকের হাতে ৭৮৬ লেখাছিল। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে ২৮ বছর বয়সী এক মুসলিম যুবককে নৃশংসভাবে নির্যাতন করা হয়েছে এবং তার ডান হাত করাত দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার ঐ যুবকের নাম আখলাক, তিনি পেশায় একজন নাপিত। তার বাড়ি উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে নানৌতাতে। গত ২৩ আগস্ট তিনি হরিয়ানার পানিপথে গিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে। প্রকাশিত খবরে ঘটনার বিবরণ দিয়ে শেষে বলা হয়েছে, ভারতের অনেক মুসলমানই ৭৮৬ সংখ্যাটি মহান আল্লাহর নাম বোঝাতে ব্যবহার করেন। ১৫ বছর বয়সে এই সংখ্যা আখলাক তার হাতে ট্যাটু করান।
‘ফ্রি প্রেস কাশ্মির’ সূত্রে খবরটি পরিবেশিত হয়েছে। ৭৮৬ সংখ্যাটির মূল অনেকের না জানা থাকলেও আল্লাহর নামের সংখ্যা হিসেবে এটি বরকত ও সৌভাগ্য লাভের কিংবা বালা মুসিবত হতে মুক্ত থাকার জন্য ভক্তি, বিশ্বাস ও সম্মান প্রদর্শন হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে থাকেন।
প্রকৃতপক্ষে হাদীস অনুযায়ী, প্রত্যেক শুভ কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বা আল্লাহর নামে শুরু করার কথা বলা হয়েছে। তাই বই-পুস্তক, চিঠি-পত্র, দলিল-দস্তাবেজ রচনা কালে মুসলমানদের মধ্যে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখার প্রচলন শুরু থেকে চলে আসছে। ইসলাম পূর্বকালে শুধু ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ (হে আল্লাহ তোমার নামে) লেখা-এর পরিবর্তে ইসলাম যুগে ‘বিসমিল্লাহ’ বাক্য পূর্ণ লেখার নির্দেশ হয়। এ বাক্যে আল্লাহ, রহমান ও রহীম- এ তিনটি নামের ‘আবজাদ’ রীতি অনুযায়ী সর্বমোট সংখ্যা ৭৮৬। তাই ‘বিসমিল্লাহ’ বাক্য পূর্ণ না লিখে শুধু ৭৮৬ সংখ্যা সংক্ষিপ্ত লেখার প্রচলন হয়ে যায়।
খোদায়ী জ্ঞান ভান্ডার হতে বঞ্চিত যারা গন্ডমূর্খ এবং এক সময় যারা ছিল ভারতে ৩৩ কোটি দেব-দেবীর পূজারী, বর্তমানে তাদের দেবতার সংখ্যা কত বৃদ্ধি পেয়েছে সে পরিসংখ্যান এই বৈজ্ঞানিক যুগে প্রস্তুত করা হয়েছে কিনা প্রশ্নবোধক হলেও কিছু দিন আগে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, ভারতের কোনো কোনো স্থানে করোনা ভাইরাসকে স্বাগত জানিয়ে কিছু নারী-পুরুষ করোনাকে ‘দেবতা’ হিসেবে পূজা-আর্চণা শুরু করে দিয়েছে।
বিশ্বময় ইসলামের দুশমনরা ইসলামের বিরুদ্ধে নানাভাবে কেন উঠে পড়ে লেগেছে তা মুসলমানদের ভালোভাবেই জানা আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলামের নব যাত্রা-জাগরণ দেখে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ওদের হিংসা-বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করেছে। করোনাকবলিত না হলে ওদের ভয়ংকর ইসলামবিদ্বেষী প্রকাশ পেত। তবুও হিংসাত্মক রূপ এখানে সেখানে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ইসলাম ও কোরআনের অবমাননা, মসজিদ পুড়ানো ইত্যাদি হিংসাত্মক কার্যকলাপ ওদের থেমে থাকেনি। দূর-নিকট সকল স্থানেই অনুরূপ ঘটনাবলী থেমে থেমে প্রকাশ পাচ্ছে। বিক্ষিপ্ত এসব ইসলামবিদ্বেষী তৎপরতার তালিকা প্রস্তুত করা হলে তাও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
মুসলমানদের অগ্রযাত্রা ও নবজাগরণকে থামিয়ে দেয়ার জন্য শত্রুশক্তিবর্গ নব নব কৌশল আরম্ভ করেছে। মুসলিম উম্মাহর পরস্পর কোন্দল-বিরোধের সুযোগে কোরআন ও ইসলাম অবমাননার পাশাপাশি ভূখন্ডগত বিরোধকে উস্কে দিচ্ছে, যার ফলে রক্তাক্ত ঘটনাবলী অব্যাহত রয়েছে। মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গঠিত ওআইসির নীরব-নিষ্ক্রিয় ভূমিকা সমস্যাবলীকে আরো ঘনীভূত করে তুলেছে, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যসহ উপসাগরীয় এলাকায় নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসলাইলের সাথে দুটি উপসাগরীয় দেশের নতুনভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন কিসের আলামত? ওআইসি চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী তার সদস্যভুক্ত এ দুটি রাষ্ট্রের ব্যাপারে হয়তো দু’একটি নিন্দা সূচক বাক্য উচ্চারণ করেই দায়িত্ব শেষ করবে। এর বেশি তার কাছে আর কী আশা করা যায়?
৭৮৬ সংখ্যা ব্যবহারের অভিযোগে আখলাক নামক মুসলিম যুবকের হাত কর্তনের ঘটনা খুবই নিন্দনীয় ও ধিক্কারজনক। আল্লাহর মহিমান্বিত নামগুলোর প্রতীকি সংখ্যাতাত্তি¡ক নিদর্শন ৭৮৬ এর অবমাননা কোরআন অবমাননার শামিল। ভারতের নানা স্থানে মুসলমানদের ওপর নানা উৎপীড়ন-নির্যাতন অহরহ চলছে, বাধা দেয়ারও কেউ নেই। এ ব্যাপারে সে দেশে কোনো আইন আছে বলেও মনে হয় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন