রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ‘বালিশ-কান্ড’ বা ফরিদপুর হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের একটি পর্দা ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে ক্রয় কাহিনীকেও হার মানিয়েছে একটি ওটি লাইটের দাম। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাজারদর যাচাই কমিটি সঠিকভাবে যাচাই না করে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) লাইটের দাম ৮০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। এক্ষেত্রে সরকারের ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা অর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ জন্য হাসপাতালের পরিচালক ও বাজারদর কমিটি দায়ী। হাসপাতাল পরিচালক প্রফেসর ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া ও বাজারদর কমিটির চার সদস্য নিউরো সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সৌমিত্র সরকার, নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান ডা. রতন দাশগুপ্ত, পরিসংখ্যান কর্মকর্তা এ এস এম কামরুজ্জামান এবং প্রাশসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করেছে এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি।
চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব মো. ইসমাইল হোসেন, কমিটির সদস্য যুগ্ম সচিব শাহিনা খাতুন এবং উপসচিব হাসান মাহমুদ। এরপর তদন্ত প্রতিবেদনটি অজ্ঞাত কারণে আলোর মুখ দেখেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘পাবলিক মানি’ বা সরকারি অর্থ নিয়ে এ ধরণের দুর্নীতি আসলে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়। কারণ এ অর্থ উন্নয়ন কিংবা জনগণের কাজে ব্যয় হওয়ার কথা থাকলেও দুর্নীতির কারণে তা ব্যক্তি পর্যায়ে কুক্ষিগত করা হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, এর ফলে পর্যাপ্ত অর্থ সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যয় না হওয়ার কারণে হয় সেই উন্নয়ন কাজটি বাধাগ্রস্ত হয়, না হলে নিম্নমানের কাজ করা হয় অথবা যে কাজে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার কথা ছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় হয়।এ ধরণের দুর্নীতি থাকলে তার দায়ভার আসলে জনগণের উপরে গিয়েই পড়ে।
সূত্র মতে, তদন্ত কমিটি ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর হাসপাতাল পরিদর্শন করে। এ সময় অভিযোগ ও কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয় এবং হাসপাতাল পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেয়া হয়। তদন্ত কমটি ক্রয় পরিকল্পনার সঙ্গে সংযুক্ত তালিকায় দেখেন, ওটি লাইটের চাহিদা রয়েছে ২০টি। আরসিএস এন্টারপ্রাইজ থেকে দুটি ওটি লাইট কেনা হয় এক কোটি ৫৯ লাখ ৭০ হাজার টাকায়। প্রতিটির ক্রয়মূল্য ৭৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। কার্যাদেশ থেকে দেখা যায়, কেনা হয়েছে আটটি ওটি লাইট। এতে ব্যয় হয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে পরিচালকের বক্তব্য- দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকেই কার্যদেশ দেয়া হয়েছে। তবে কমিটির বক্তব্য দেশের কোন হাসপাতালে অতি উচ্চমূল্যের ওটি লাইট কেনা হয়নি। স্বাস্থ্য বিভাগের হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে ‘সেলিং মাউন্টেড ডাবল ডেমো’ দুটি ওটি লাইট প্রতিটির দাম ২২ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা।
এছাড়া স্যার সলিমউল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেনা হয়েছে ২৩ লাখ টাকায়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজে কেনা হয়েছে ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকায় এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে কেনা হয়েছে ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায়। সঠিকভাবে যাচাই না করে বাজারদর যাচাই কমিটি ওটি লাইটের দাম নির্ধারণ করেছে ৮০ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা ২৬৫ শতাংশ অধিক দামে কেনা হয়েছে। এতে সরকারের ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা অর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর জন্য হাসপাতালের পরিচালক ও বাজারদর কমিটি দায়ী। অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে হাসপাতাল পরিচালক প্রফেসর ডা. উত্তম বড়–য়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা যেতে পারে। এছাড়া বাজারদর কমিটির চার সদস্যের বিরুদ্ধেও মামলা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, ২০১৮ সালে যন্ত্রপাতিসহ একটি কোবলেশন মেশিন কেনা হয় ৯৬ লাখ টাকায়। আরেকটি ২৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকায়। যদিও প্রাইস গাইডলাইনে এর দাম ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৩০০ টাকা। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আরসিএস এন্টারপ্রাইজ থেকে কোবলেশন মেশিন কেনা হয়েছে। কার্যাদেশে দেখা গেছে, ‘কোবলেশন মেশিন উইথ আল স্ট্রান্ডার্ড এক্সেসোরিস’ একটি কেনা হয়েছে ৯৬ লাখ টাকায়। এর অরিজিন ইউএসএ উল্লেখ করা হয়েছে। আরেকটি কেনা হয়েছে ‘কোবলেশন সিস্টেম ফর ইএনটি সার্জারি’ ২৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকায়। এটিরও অরিজিন ইউএসএ। পরিচালকের বক্তব্য সর্বনিম্ন দরদাতা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। প্রাইজলিস্টে ইউনিট মূল্য সর্বোচ্চ ১৬ লাখ টাকা। দুটি মেশিনে মূল্যের বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ে পরিচালক কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। এ দুটি মেশিন কেনায় সরকারের অতিরিক্ত অর্থ অপচয় হয়েছে ৭৮ লাখ টাকা। এ মেশিন কেনার ক্ষেত্রেও তদন্ত কমিটি পরিচালকসহ উল্লিখিত পাঁচজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করেছে।
একইভাবে তৃতীয় অভিযোগে ‘দুটি এনেসথেসিয়া মেশিন ইউথ ভেন্টিলেশন’ কেনায় সরকারের এক কোটি ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা অর্থিক ক্ষতির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এক্ষেত্রে কমিটি হাসপাতাল পরিচালক ও বাজারদর কমিটির চার সদস্যের বিরুদ্ধে পৃথক বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করে।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে- ২০১২ সালে কিডনি চিকিৎসায় লেথোপ্রিপসি মেশিন কেনা হয়। কিন্তু বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৫ সালে। ফলে উল্লিখিত কার্যক্রম পরিচালকের কর্মকালে না হওয়ায় বিবেচনাযোগ্য নয়। এছাড়া অভিযোগ ৫, ৬, ৭, ৯ তদন্ত কমিটির কাছে যথাযথ নয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
আট নম্বর অভিযোগে বলা হয়- প্রফেসর ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া অর্থিক অনিয়মে বিভাগীয় মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক পদে বহাল থাকবেন কিনা- এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। এছাড়া ১০ নম্বর অভিযোগে তার স্থাবর সম্পদের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। তদন্ত কমিটি বলেছে এ সংক্রান্ত কোন তদন্ত এ কমিটির আওতাধীন নয়। ১১ নম্বর অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কমিটির মন্তব্য হাসপাতালে কিভাবে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে তার কোনো তথ্য প্রমাণ নেই, তাই অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়।
১২ নম্বর অভিযোগ প্রসঙ্গে পরিচালক প্রফেসর ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া বলেন, তিনি ১৯৮৪-৮৫ সালে মেধা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। নিয়ম অনুযায়ী দুই মাস পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে অটো মাইগ্রেশন করেন। তবে তার কাছে ভর্তি সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র সংরক্ষিত নেই। এ প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির মন্তব্য, অভিযোগটি গুরুতর। যথাযথভাবে তথ্য সংগ্রহ করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন।
তদন্ত কমিটি সামগ্রিক মন্তব্যে উল্লেখ করেন, হাসপাতাল পরিচালকের বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে ৪, ৫, ৬, ৭, ৯, ১০ ও ১১ নম্বর অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে কমিটি প্রাথমিক সত্যতা খুঁজে পায়নি। এসব অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া যায়। ৮ নম্বর অভিযোগে তিনি ইতোপূর্বে মন্ত্রণালয় থেকে সাজা প্রাপ্ত হয়েছেন। ১২ নম্বর অভিযোগটি গুরুতর; তাই যথাযথ তথ্য সংগ্রহ করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। এছাড়া অভিযোগ ১, ২, ৩ নম্বর তিনটির সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনা করে ত্রæটি বিচ্যুতি পাওয়া গেছে। এ তিনটি অভিযোগে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ৬ কোটি ৪০ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ টাকা। এ কারণে পরিচালকসহ উল্লিখিত পাঁচজনের বিরুদ্ধে পৃথক বিভাগীয় মামলা করা যেতে পারে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহনের পর ডা. উত্তম হাসপাতালের সব ক্ষমতা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। এজন্য তিনি গড়ে তোলেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই চক্রের সঙ্গে আরো জড়িত আছেন অত্র প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক। গত ১৬ জানুয়রি একাউন্টেন্ট নাসিরকে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত করা হলেও তাকে দিয়ে ওই পদে অফিস করানো হচ্ছে। একজন ওয়ার্ড মাস্টার যিনি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও ও লুটপাটের সুবিধার্থে তাকে লোকাল ওয়ার্ডে ম্যানেজার মেইনটেন্সের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই চক্রটির ভয়ে এই প্রতিষ্ঠানের গত ৬-৭ বছর যাবৎ কোন প্রতিদ্বন্ধিতামূলক টেন্ডার প্রসিকিউর হয় না।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন প্রফেসর ডা. উত্তম বড়–য়া। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চলতি বছরের ২৯ জুলাই চট্টগ্রাম সদর রেজিস্ট্রি অফিসে দুই কোটি টাকা মূল্য দেখিয়ে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন একটি ভবন জমিসহ করলেও প্রকৃতপক্ষে তার দাম সাড়ে তিন কোটি টাকা। এর আগে ৭ জানুয়ারি তার ভাই দিলীপ কুমার বড়–য়ার নামে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন একটি জমিসহ বাড়ি ক্রয়ের বায়না ৫ কোটি টাকা মূল্য দেখানো হলেও মূলত তার দাম ছিল ১২ কোটি টাকা। জমি কেনার এসব কাগজ-পত্র ইনকিলাবের কাছে রয়েছে। চট্টগ্রামে বাড়ি কেনা ছাড়াও ইন্দ্রিরা রোডে ২০০০ বর্গফুট ফ্ল্যাট, ধানমন্ডি ২৮-এ ৩০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, শ্যামলী স্কয়ার এ বাণিজ্যিক দোকানসহ নামে/বেনামে বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। এছাড়া দেশের বাইরে মালয়শিয়াতে তিনি ফ্ল্যাট কিনেছেন এবং সম্প্রতি আমেরিকাতে ফ্ল্যাট কেনার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েছেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তিনি কোন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না। শুধুমাত্র সরকারি চাকরির থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কিভাবে এত সম্পদ গড়ে তোলা যায় সে বিষয়ে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
তবে তদন্ত কমিটি এ বিষয়গুলোকে তাদের এখতিয়ার বর্হিভ‚ত হওয়ায় তদন্তে এগুলো এড়িয়ে গেছেন। তবে এ ধরনের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি দমন কমিশনকে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ইনকিলাবকে বলেন, প্রতিবেদন আমার হাতে আসেনি। আর কেউই জবাবদিহিতার বাইরে নয়; প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যখাতের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। তাই কেউ অপরাধ করলে অবশ্যই তার শাস্তি পাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন