বাঙালির মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার ব্যঞ্জনা আজ ধ্বনিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে একযোগে পালন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম প্রহর থেকে মানুষের ঢল নামে শহীদ মিনারে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর পর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের একেক করে পুষ্পস্তবক অর্পণের পরপরই নাঙ্গা পায়ে, মৌন ধীর গতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করতে আসে হাজার হাজার মানুষ। রাতভর শহীদ মিনারে চলে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ। আর ভোর হতেই তা ধারণ করে অন্যরকম এক দৃশ্য। চারদিক থেকে স্রোতের মতো মানুষ আসতে থাকে শহীদ মিনারে। প্রভাতফেরী শেষে সেই স্রোত গিয়ে মিশে যায় গ্রন্থমেলায়।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ অথবা ‘মোদের গরব মোদের আশা/আমরি বাংলা ভাষা’ গাইতে গাইতে দলবেধে আসতে থাকে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন, বিশিষ্ট ব্যক্তি থেকে শুরু করে মুটে-মজুর পর্যন্ত। শহীদদের স্মৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর সকাল সাড়ে সাতটা থেকেই গণমানুষের ঢল নামে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ভাষার সম্মানে সাদা কালো পাঞ্জাবি শাড়িতে বন্দী মানুষের পদচারণায় মেলা হয়ে উঠে প্রাণোচ্ছল। ক’দিন আগে বসন্তের প্রথম দিনে মেলা যেমন বর্ণিল হয়ে উঠেছিল বাসন্তি রঙে, তেমনি একুশের দিনে মেলায় আগতদের মার্জিত পরিপাটি পোশাকে স্পষ্ট ছিল একুশের ছাপ।
গতকাল বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বেজেছে ‹আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি› গানটি। অন্যদিকে বর্ণমালা যুক্ত বাহারি পোশাকে গণমানুষের আনাগোনায় সকাল থেকেই মেলাজুড়ে বিরাজ করছিলে একুশের আবহ। এদিন সকাল ৮টা থেকে মেলা শুরু হয়। তবে তার দ্বার খুলেছিল আরেকটু আগেই। তাই তো শহীদ মিনারের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সকাল থেকেই মেলায় ছুটে আসেন নানা বয়সী মানুষ। কেউ এসেছেন বাবা-মায়ের সঙ্গে, কেউ এসেছেন প্রিয় মানুষ কিংবা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে। বেশিরভাগ নারীর পরনে ছিল কালো রঙের শাড়ি, আর ছেলেদের ছিল কালো পাঞ্জাবি। সকাল থেকে আসা মানুষের স্রোত দুপুরের পর পরিণত হয় জোয়ারে। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বইমেলা পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। নানা বয়সী মানুষের উপস্থিতিতে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরে উঠেছে মেলার মাঠ। এদিন সর্বাধিক বই বিক্রির কথাও জানান প্রকাশকরা।
এদিন মেলায় কেবল ঘুরতে আসা নয়। অনেকেই প্রিয় লেখকের প্রিয় বইটি কিনে উপহার দিচ্ছিলেন প্রিয়জনকে। মোড়কের নিচে সাদা কাগজে লিখে দিচ্ছেন একুশের প্রিয় পঙতি। রাজধানীর আজিমপুর থেকে কালো পাড়ের সাদা শাড়িতে ঢেকে মেলায় এসেছেন ইডেন কলেজ শিক্ষার্থী মাইমুনা। কথার ফাঁকে জানান, এই কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তিনি। তবে বাংলা সাহিত্যের প্রতি রয়েছে অগাধ টান। তাই তো হাজারো মানুষের ভীড় ঠেলে ছুটে এসেছেন বইয়ের গন্ধে। কিনে নিলেন হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘ আগুনের পরশমণি ‹। জানান, এই উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি চলচ্চিত্র দেখে বইটি কেনার আগ্রহ জন্মায়। এছাড়াও জনপ্রিয় কবিদের কিছু কবিতার বইও কিনবেন বলে জানান মাইমুনা।
কথা হয় রাজধানীর কলাবাগান থেকে আসা ফয়সাল হোসেন সিরাজির সাথে। পেশায় একজন সর্ট ফিল্ম নির্মাতা। জনপ্রিয় লেখকদের জনপ্রিয় সব গল্প উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করতে চান চলচ্চিত্র। স্বপ্ন দেখেন একদিন তার নির্মিত এসব চলচ্চিত্র পরিচিতি পাবে বিশ্বব্যাপী। তবে সে স্বপ্নের পথে কতটা হাঁটতে পারবেন সেটা নিয়েও তিনি শঙ্কিত। মেলায় এসে খোঁজ করছিলেন জনপ্রিয় প্রকাশনীগুলোর বেস্ট সেলার বইগুলো। এভাবেই মাইনুনা ফয়সালদের মতো হাজারো বইপ্রেমীর ভীড়ে একাকার ছিল গতকালের মেলাপ্রাঙ্গণ।
তবে এর ভিন্ন চিত্রও ছিল চোখে পড়ার মতো। মেলায় এসে বন্ধু প্রিয়জনদের নিয়ে সেলফি তোলায় ব্যস্ত মানুষদেরও দেখা গেছে। এই শ্রেণির লোকগুলো এদিন মেলার পরিবেশ নষ্টের অংশীদার হয়েছেন বললেও অত্যুক্তি হবে না। যেন তারা এসেছেন কেবলই ছবি তুলতে আর ভিডিও করতে। জনপ্রিয় সব প্যাভিলিয়নে ঘুরে দেখা গেছে মানুষের ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। তাও আবার বিশেষ দিন হওয়ায় এদিন মেলায় আসেন ইউটিউবার, মোটিভেশান স্পিকার ও তরুণ জনপ্রিয় লেখকরা। যাদের ঘিরে সেলফি তোলার হিড়িক গণমানুষের বিরক্তির কারণও হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বই কেনা নয় যেন ছবি কিংবা ভিডিও করাই যেন তাদের প্রধান লক্ষ্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন