এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী
বৈরাগ্য ইসলাম নয় :
সাধারণভাবে এই ধারণা করা হয়ে থাকে যে, বান্দাহ নিজের ওপর যে পরিমাণ কষ্ট বরণ করে নেয়, ঠিক সে পরিমাণই আল্লাহপাক সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন। আর এটাকেই বড় ইবাদত মনে করা হতো। এ জন্য মানুষ নিজের দেহের উপরে বড় বড় কষ্টকর কাজ ও অনুশীলন চাপিয়ে দিত এবং মনে করত, যে পরিমাণ দেহকে কষ্ট দেয়া হবে ঠিক সে পরিমাণ রুহ বা আত্মার পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা আসবে। এ জন্য গ্রিক দার্শনিকদের মাঝে আশলাফিয়াত এবং খ্রিস্টানদের মাঝে রুহবানিয়াত এবং হিন্দুদের মাঝে যোগ পালন করা এসকল ভ্রান্ত বিশ্বাসেরই বিষময় ফল হিসেবে দেখা যায়। এদের কেউ গোশত না খাওয়ার অঙ্গীকার করত, কেউ সপ্তাহভর অথবা চল্লিশ দিনে একবার খাদ্য গ্রহণ করত। কেউ সর্বাঙ্গ উলঙ্গ রাখত, সকল প্রকার লেবাসকে পবিত্রতার অন্তরায় মনে করত। কেউ চিল্লাসহকারে ঠা-া জায়গায় নগ্নদেহে অবস্থান করত। কেউ বছরের পর বছর জীবনভর নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখত, কিংবা বসে থাকত এমনকি শয়ন করা ও নিদ্রা যাওয়া হতে পরিপূর্ণভাবে দূরে থাকত। কেউ নিজের একহাত দাঁড় করিয়ে রাখত যেন তা শুকিয়ে যায়। কেউ জীবনভর অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বা গর্ত ও গুহায়ে লুকিয়ে থাকত। এভাবেই তারা আল্লাহর পরিচয়ের আলো তালাশ করত। একাকিত্ব গ্রহণ করে, দুনিয়ার সম্পর্ক পরিত্যাগ করে, স্ত্রী, পুত্র পরিবার-পরিজনদের সাহচর্য ত্যাগ করে, আল্লাহর মহব্বতের মিথ্যা দাবি করত। কিন্তু নবুওতে মুহাম্মদী (সা.) এগুলোর মুখোশ উন্মোচন করে দেয় এবং পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেন, এসব কাজকর্ম এটিও ইবাদত নয়।
সুপেয় ও সুস্বাদু আহার্য বস্তু পরিত্যাগ করলে মূল সত্যের আস্বাদ লাভ করা যায় না। এমনকি আমদের দুশ্চিন্তা ও দ্বিধাগ্রস্ততা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কারণও হতে পারে না। তাছাড়া বান্দাহদের অমানবিক দুঃখ-কষ্টের ফলে আল্লাহপাকও আরাম বোধ করেন না। ছেলেমেয়ে, জায়া-জননীর প্রতি বিরূপ মনোবৃত্তি পোষণ করলে আল্লাহর ভালোবাসা কাহারো নসিব হয় না। মূলত আল্লাহর মনোনীত ধর্ম বান্দাহর শক্তির বহির্ভূত কোনো কিছু তার ওপর আরোপ করে না। আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহপাক কাহারো ওপর শক্তির বহির্ভূত বোঝা চাপিয়ে দেন না।” (সূরা বাক্কারাহ : শেষাংশ)
ইসলামের সিয়াম সাধনা এমন একটি ইবাদত যাকে অস্বভাবী কষ্টের প্রতিরূপ কল্পনা করা যেতে পারে। কিন্তু ইসলাম এক্ষেত্রে অসংখ্য আসমানীর ব্যবস্থা রেখেছে। আল-কোরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছেÑ “আল্লাহপাক তোমাদের আসমানী কামনা করেন, তিনি তোমাদের প্রতি কাঠিন্য আরোপের প্রত্যাশা করেন না।” (সূরা বাক্কারাহ : ২৩) অনেকের ক্ষেত্রে হজ আদায়ও কষ্টকর ব্যাপার ছিল। কিন্তু আল্লাহপাক একে সহজ করে দিয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “যার পথচলা ও রাহা খরচের সামর্থ্য আছে, তার ওপরই হজ ফরজ।” (সূরা আলে ইমরান : ১০)
অতএব এক আয়াতে আল্লাহপাক ইরশাদ করেনÑ “আল্লাহপাক তোমাদের ধর্মীয় জীবনে কোনো রকম অসুবিধার অবকাশ রাখেননি।” (সূরা হজ : ১০)
এ সম্পর্কে রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, “এই দ্বীন সহজ ও আসান। যে ব্যক্তি স্বীয় শক্তি ও সামর্থ্যরে দ্বারা এই দ্বীনের মোকাবেলা করবে, তাহলে অবশ্যই সে এর কাছে পরাভূত হবে।” (সহিহ বুখারি, সুনানে নাসাঈ এবং জামউল কাওয়ায়েদ, ১ম খ-, ২০ পৃ.)
অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনÑ “আমাকে সহজ, সরল, আসান এবং সমুজ্জ্বল হানিফী দ্বীনসহ প্রেরণ করা হয়েছে।” (মাসনাদে ইবনে হাম্বল, ৫ম খ-, ২৬৬ পৃ.)
জীবন-ধর্মে বৈরাগ্য রুহবানিয়াত ও যোগ সাধনার প্রবর্তন যত সৎ উদ্দেশ্যেই করা হোক না কেন তবুও সত্যিকার দ্বীনের শিক্ষা এটা নয়। আর তা দ্বীনের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে একান্তই অপারগ। ইসলাম এ কারণেই এসব কার্যক্রমকে বেদআত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “খ্রিস্টানরা রুহবানিয়াত নামক একটি বেদআত প্রথার উদ্ভব ঘটায়, কিন্তু আমি তাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রত্যাশা ছাড়া এ কাজের নির্দেশ দেইনি। কিন্তু তারা বৈরাগ্য বা রুহবানিয়াতের মর্যাদাও রক্ষা করেনি।” (সূরা হাদিদ : ৪)
প্রকৃতপক্ষে ওই সকল লোক যারা উত্তম আহার এবং বৈধ সৌন্দর্যম-িত পোশাক নিজেদের ওপর হারাম সাব্যস্ত করেছিল, তাদের প্রতি আল্লাহপাক সন্তুষ্টি হবেন এমন ধারণা নিতান্তই ভুল। বরং আল্লাহপাকই তাদেরকে জিজ্ঞেস করছেন, “বলে দিন, আল্লাহর দেয়া বান্দাদের জন্য পবিত্র রিজিক ও আল্লাহর পছন্দনীয় সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ কে হারাম সাব্যস্ত করেছে?” (সূরা আ’রাফ : ৪)
ইসলাম এ ব্যাপারে এমন দৃঢ়তা ব্যক্ত করেছে যে, একবার রাসূলে পাক (সা.) কোনো এক স্ত্রীর মনে সান্ত¦নাদানের লক্ষ্যে মধু না খাওয়ার শপথ করেছিলেন। আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় হাবীবকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেনÑ “হে প্রিয় নবী! আল্লাহপাক আপনার জন্য যা হালাল করেছেন, তা স্বীয় স্ত্রীদের মনঃতুষ্টির জন্য কেন হারাম করেছেন? আল্লাহপাক ক্ষমাশীল মেহেরবান।” (সূরা তাহরীম : ১)
সাহাবিদের মাঝে কোনো কোনো ব্যক্তিত্ব খ্রিস্টান পাদ্রীদের প্রভাব কিংবা নিজেদের আন্তরিক প্রশান্তির জন্য একাকিত্ব বরণ উপাদেয় পানাহার বর্জন ও কঠিন রিয়াজত মোজাহাদার ভিতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করার অভিলাষ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে এ কাজ হতে প্রতিনিবৃত্ত করে বললেনÑ “আমি এহেন শরিয়ত নিয়ে আগমন করিনি।”
কুদামা বিন মাজউন ও তার এক বন্ধু একবার দরবারে নববীতে হাজির হয়ে আরজ করল, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের মাঝে একজন চিরকুমার থাকা ও বিয়েশাদী না করার সংকল্প করেছেন। অপর একজন জীবনভর গোশত না খাওয়ার ইচ্ছা করেছে।” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, “আমি তো উভয়টিই পালন করে যাচ্ছি। গোশত ভক্ষণ করছি এবং বিবাহিত জীবনও যাপন করছি। এই উত্তর-শ্রবণ করে প্রশ্নকারী দুজনই নিজেদের সংকল্প পরিহার করল।” (সহিহ বুখারি : কিতাবুস সওম) হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) একজন যাহেদ এবং আবেদ সাহাবি ছিলেন। তিনি একবার এই শপথ করলেন যে, দিনে রোজা রাখবেন এবং রাতভর ইবাদহ-বন্দেহী করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তা জানতে পেরে তাকে লক্ষ্য করে বললেন, “হে আবদুল্লাহ! তোমার ওপর তোমার দেহেরও হক আছে, তোমার চোখেরও হক আছে, এমনকি তোমার স্ত্রীরও হক আছে। মাসে তিন দিন রোজা রাখাই যথেষ্ট।” (আবু দাউদ : কিতাবুস সালাত)
হযরত ওসমান বিন মাজউন (রা.) ছিলেন একজন বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী সাহাবি। তিনি দিনে এবং রাতে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। স্ত্রীর সাথে কোনো সম্পর্কই রাখতেন না। দিনে রোজা পালন করতেন এবং রাতভর ইবাদত বন্দেগীতে অতিবাহিত করতেন। রাতে কখনো নিদ্রা যেতেন না। একদিন রাসূলে পাক (সা.) তাকে ডেকে বললেনÑ “হে ওসমান। কেন তুমি আমার তরিকা হতে দূরে সরে গেছ? উত্তর করলেন, আল্লাহর শপথ! আমি দূরে সরে যাইনি, আমি আপনার তরিকাকেই তালাশ করছি।”
রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, “আমি নিদ্রাও যাই, নামাজও আদায় করি এবং মহিলাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। হে ওসমান! আল্লাহকে ভয় কর। তোমার পরিবার-পরিজনদের, মেহমানদের, তোমার জানেরও তোমার ওপর হক আছে। সুতরাং তুমি রোজাও রাখ, ইফতারও কর, নামাজও পাঠ কর এবং নিদ্রাও যাও।” (আবু দাউদ : কিতাবুস সালাত)
বাহেলা গোত্রের একজন সাহাবি ইসলাম গ্রহণ করে স্বীয় গোত্রে প্রত্যাবর্তন করলেন। তারপর তিনি আহার করা ছেড়ে দিলেন এবং একটানা রোজা রাখা শুরু করলেন। এক বছর পর তিনি যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে হাজির হলেন, তখন তার চেহারা এমন পরিবর্তিত রূপ ধারণ করেছিল যে, রাসূলে পাক (সা.) তাকে চিনতে পারলেন না। তখন তিনি নিজের নাম বললে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি তো সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলে? তোমার চেহারা এমন হয়ে গেল কেন? তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার সাথে সাক্ষাৎ করে প্রত্যাবর্তনের পর আমি একটানা রোজা রেখে চলেছি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি নিজের প্রাণকে কেন আজাবে নিপতিত করছ। রমজান মাস ছাড়া প্রতি মাসে একটা রোজাই যথেষ্ট। তিনি এর চেয়ে বেশি রোজা পালন করার অভিলাষ ব্যক্ত করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে মাসে দুই দিন রোজা রাখার অনুমতি দিলেন। তিনি এর চেয়েও বেশি দিন রোজা রাখার আবেদন করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে তিন দিন রোজা রাখার অনুমতি দিলেন। তিনি এরচেয়ে বেশি দিনের আরজি পেশ করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে মর্যাদাপূর্ণ মাসে (মহররম, রজব, জিলকদ, জিলহজ) রোজা রাখার অনুমতি দিলেন। (আবু দাউদ)
একবার কয়েকজন সাহাবি রাসূলে পাক (সা.)-এর বিবিগণের সামনে হাজির হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর রাত এবং দিনের ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তাদের ধারণা ছিল হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দিনে এবং রাতে ইবাদত বন্দেগী ছাড়া কিছুই করেন না। বিবিগণ উত্তর করলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইবাদত সম্পর্কে কতটুকুই জানি? তিনি মাসুম, পবিত্র। সাহাবিদের একজন বললেন, আমি রাতভর নামাজ আদায় করব। অপরজন বললেন, আমি জীবনভর রোজা রাখব, তৃতীয়জন বললেন, আমি জীবনভর অবিবাহিত থাকব। কখনো বিবাহ করব না। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেন, “আল্লাহ শপথ! আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহকে বেশি ভয় করি। তবুও আমি রোজা রাখি, ইফতার করি, রাতে নামাজ পড়ি, ঘুমাই, দাম্পত্য জীবনযাপন করি। যে আমার তরিকার ওপর নাই সে আমার দলভুক্ত নয়।” (সহিহ বুখারি : কিতাবুন নিকাহ)
কোনো কোনো সাহাবি অভাব ও দরিদ্রতার জন্য বিয়ে করার সঙ্গতিসম্পন্ন ছিলেন না। এমনকি নিজেকে সম্বরণ করাও ছিল খুবই কষ্টকর ব্যাপার। এ কারণে তারা শারীরিক বিশেষ অঙ্গ কেটে ফেলার মনস্থ করেছিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে রুহবানিয়াত গ্রহণ করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তাদের এই অভিপ্রায় জেনে রাসূলুল্লাহ (সা.) খুবই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত সায়াদ বিন অয়াক্কাস প্রমুখ সাহাবিগণ বলেন, যদি রাসূলুল্লাহ (সা.) এ কাজের অনুমতি প্রদান করতেন, তাহলে বহুলোক এর ওপর আমল করতে প্রস্তুত ছিল। (সহিহ বুখারি : কিতাবুন নিকাহ)
এ সকল ঘটনা দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) কত বৃহত্তর পরিসরে এবং কত সহজভাবে মানুষকে সত্যিকার ইবাদতের রূপরেখা শিক্ষা দিতেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং একটানা কয়েক দিন রোজা রাখতেন। ফলে সাহাবিগণও তাঁর অনুসরণে একটানা রোজা রাখার অভিলাষ ব্যক্ত করলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে নিষেধ করলেন যেন তারা এমনরূপে রোজা পালন না করে। সাহাবীগণ মনে করলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) অতিশয় দয়াপরবশ হয়েই তাদেরকে এভাবে রোজা রাখতে বারণ করছেন। এজন্য তারা ইফতার করলেন না। অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (সা:) দু’দিন রোজা রেখেছিলেন, ঘটনাক্রমে তৃতীয়দিন চাঁদ দেখা গেল। তিনি ইফতার করলেন এবং বললেন, যদি মাস আরও দীর্ঘ হত, তাহলে আমার রোজাও দীর্ঘায়িত হত। এতে করে এ ব্যাপারে যারা গোঁড়ামি করছে তাদের গোঁড়ামির মুখোশ খুলে যেত।
একথা শুনে সাহাবীগণ আরজ করলেন ইয়া রাসূলুল্রাহ! আপনিতো একটানা রোজা পালন করেছেন প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, তোমাদের মাঝে আমার মত কে আছে? আমাকে আমার প্রতিপালক পানাহার করান। (সহীহ মুসলিম : কিতাবুস সাওম) এ কারণে ইসলামের বিধান অনুসারে সাধারণ উম্মতের জন্য একটানা কয়েকদিন রোজা রাখা বৈধ নয়।
একবার রাসূলুল্লাহ (সা:) কোন একটি মসজিদে গমন করে দেখলেন, এর এক কোণে একটি রশি ঝুলছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এখানে রশি ঝুলছে কেন? লোকজন উত্তর করল, এই রশিটি যয়নাবের দাসী টাঙিয়ে রেখেছে। রাতে দাঁড়িয়ে বন্দেগী করতে করতে যখন সে দাঁড়াতে অপারগ হয়ে যায়, তখন এই রশি ধরেই সে উঠা-বসা করে। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা:) নির্দেশ করলেন, রশিটি খুলে দাও। আর তোমরা যতক্ষণ সুস্থ, সচেতন থাকবে, ততক্ষই কেবল নামাজ আদায় করবে। আর যদি পরিশ্রান্ত হয়ে অপারগ হয়ে যাও, তাহলে বসে থাকাই উত্তম। (জামউল কাওয়ায়েদ বহাওয়ালায়ে মুজামে করীর ও আওছাত লিত্তিবরানী ও আবু দাউদ)
একবার একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সামনে দিয়ে যাচ্ছি। তাকে দেখে হযরত আয়েশা (রা:) বললেন, এতো খাওলা। লোকজন বলছে, সে নাকি রাতভর নিদ্রা যায় না, ইবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করে। তা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, সে রাতে মোটেই ঘুমায় না? হে লোক সকল! তোমরা ঐ পরিমাণ ইবাদত-বন্দেগী কর, যতটুকু ক্ষমতা তোমাদের আছে। (সহীহ বুখারী, মসলিম, মুয়াত্তা ইমাম মালেক, নাসাঈ ও জামউল কাওয়ায়েদ)
যারা নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যরে অতিরিক্ত রাতভর নামাযে মশগুল থাকত তাদেরকে লক্ষ্য করে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন ঐ পরিমাণ কাজের কষ্টই সহ্য কর যা তোমাদের সাধ্যের ভিতর আছে। কেননা তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত অস্বস্তিবোধ না কর, আল্লাহ পাক ততক্ষণ অস্বস্তিবোধ করেন না। আল্লাহ পাকের নিকট ঐ কাজটি অধিক পছন্দনীয় যা তোমরা হরমামেশা করে যাচ্ছ। যদিও তার পরিমাণ কম হয়। (আবু দাউদ, আল-কামদু ফিস সালাত অধ্যায়)
হজের সময় রুহবানিয়াতের বহু আচার-অনুষ্ঠান আরবদের মাঝে চালু ছিল। কোন কোন হাজী এই অঙ্গীকার করত যে, সে এই সফরে মুখে কোন কথা বলবে না। অথবা এই শপথ করত যে, সব সময় পায়ে হেঁটে চলবে, কখনো যানবাহনের ধারেকাছেও যাবে না। যদিও যানবাহন সংগ্রহের পরিপূর্ণ সুযোগ তার আছে। আবার কেউ এই শপথ করত যে, কখনো ছায়ায় অবস্থান করবে না। সব সময় প্রখর রোদেই অতিবাহিত করবে। কোন কোন লোক নিজের অপরাধের প্রকাশকল্পে নাকের সাথে রশি বেঁধে কা’বা শরীফের তাওয়াফ করত এবং এই কাজকে পুণ্য বলে মনে করত।
কিন্তু পবিত্র ইসলাম এই সকল আচার ও আচরণকে চিরতরে নির্মূল করে দিয়েছে এবং এসঙ্গে ঘোষণা করেছেÑ “অনর্থক ভিত্তিহীন কষ্টবরণ আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিচায়ক হতে পারে না।”
একবার হযরত ওকবা বিন আমের (রা:)-এর বোন এই শপথ করেছিল যে, তিনি পদব্রজে হজ সমাপন করবেন। হযরত ওকবা (রা:) রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর খেদমতে এসে এ ব্যাপারে ফতোয়া জিজ্ঞেস করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) উত্তরে জানালেন, তোমার বোনের এই শপথের কোন প্রয়োজনীয়তা আল্লাহ পাকের নেই। বরং তাকে গিয়ে বলো, সে যেন যানবাহনে চড়ে হজ কাজ সমাধা করে।” (আবু দাউদ ও মাসনাদে ইবনে জারুদ, ঈমান ও নজর অধ্যায়) অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (সা:) একব্যক্তিকে দেখলেন যে, কোরবানীর উট সাথে থাকা সত্ত্বেও সে পদব্রজে পথ চলছে। তিনি তাকে উটের উপর আরোহণ করতে নির্দেশ করলেন। সে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললো, এ যে কোরবানীর উট। এর উপর কেমন করে আরোহণ করি? রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, আমি জানি এটা কোরবানীর উট কিন্তু তবুও তুমি এর উপর আরোহণ করে পথ চল। (সহীহ বুখারী : ১ম: ৮২ পৃ:)
একবার হজের সফরের সময় রাসূলুল্লাহ (সা:) এক বৃদ্ধকে দেখলেন যে, সে চলতে পারছে না। তার ছেলে তাকে উভয় দিকের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সা:) জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, বৃদ্ধ লোকটি পদব্রজে হজ আদায় করার শপথ করেছে! রাসূলুল্লাহ (সা:) তার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, কেউ তার জানের উপর কষ্ট আরোপ করুক, এমন কাজের কোন প্রয়োজন আল্লাহ পাকের নেই। তোমরা এই বৃদ্ধ লোকটিকে যানবাহনে চড়িয়ে দাও। (আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে জারুদ, নাসাঈ) একবার রাসূলুল্লাহ (সা:) কোন এক বিষয়ের উপর খুতবা দিচ্ছিলেন, এমন সময় একজন লোককে দেখলেন যে, সে নিদাঘ সূর্যের তাপে খোলা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এর অবস্থা কি? লোকজন উত্তর করল, এ লোকটি শপথ করেছে যে, সে কখনো বসবে না, ছায়ায় দাঁড়াবে না, কাহারো সাথে কোন কথাও বলবে না এবং একটানা রোজা রেখে যাবে। এর নাম হচ্ছে আবু ইসরাইল। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, তাকে গিয়ে বল, সে যেন কথা বলে, দাঁড়িয়ে না থেকে বসে, ছায়ায় আরাম গ্রহণ করে এবং নিজের রোজা পুরা করে। (সহীহ বুখারী, আবু দাউদ ও ইবনে জারুদ)
হজের সময় একবার রাসূলুল্লাহ (সা:) দেখলেন যে, একটি লোকের নাকে রশি বাঁধা আছে এবং আর একটি লোক সেই রশি ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি তার নিকট গেলেন এবং রশি কেটে দিলেন তারপর সহায়তাকারী লোকটিকে বললেন, নাকের রশি ধরে তাকে সহায়তা কর এবং তাকে তাওয়াফ করাও। (সহীহ বুখারী: ঈমান ও নজর অধ্যায়) এই শ্রেণীর অপ্রয়োজনীয় সাধনার প্রবাহ দেখে খ্রিস্টান পাদ্রীদের অবর্ণনীর দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরে রাসূলে পাক (সা:) বললেন- নিজের উপর কঠোরতা প্রদর্শন করো না। কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তী কাওমের লোকেরা নিজের উপর কঠোরতা আরোপ করেই ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের পরবর্তী বংশধরদের এখনো তোমরা বিভিন্ন গীর্জা ও স্তূপের মাঝে দেখতে পাবে। (আবু দাউদ, মুজামে করীর, আওছাত লিত্তাবরানী, জামউল কাওয়ায়েদ)
খাতিমুল আম্বিয়া (রা:) ইবাদতের এ সকল ভ্রান্ত তরীকাকে নিজের ছোট একটি কথার দ্বারাই নির্মূল করে দিয়েছেন। ‘লা জারূরাতা ফিল ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামে রুহবানিয়াত বা নীতিহীন কৃচ্ছ্রতার কোন প্রয়োজন নেই। (আবু দাউদ)। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন