বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

সত্যালোকের সন্ধানে ইসলামে আত্মিক ইবাদতের গুরুত্ব

প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী
অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকালে যে জিনিসটি প্রথম চোটেই নজরে পড়ে, তা হলো ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মগুলোর সীমানা নির্ধারণ পদ্ধতি। অন্যান্য ধর্মে দ্বীন ও দুনিয়া দুটি পৃথক বস্তু, পৃথক পরিম-ল ও পৃথক অধিষ্ঠান। এর একটির সাথে অপরটির কোনো মিল নেই, সংযোগ নেই, সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র শিক্ষা সেই ভ্রান্ত ধারণার চির অবসান ঘটিয়েছে এবং প্রকৃত সত্যের দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।
ইসলামে দ্বীন এবং দুনিয়ার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন রকম বৈরিতার অবকাশ নেই। বরং এ দু’য়ের মাঝে বন্ধুত্বসুলভ নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। দুনিয়ার যে সকল কাজকে অন্যান্য ধর্মে দুনিয়াবি কাজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, এই কাজগুলোই যদি আত্মতুষ্টি, ব্যক্তিগত ইচ্ছার পরিপূরণ ও লোক দেখানো মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ রূপে স্থিরিকৃত করা না হয়, বরং এগুলোর দ্বারা আল্লাহর রেজামন্দি ও তার নির্দেশের বাস্তবায়ন এবং তার ফর্মাবরদারীর উপায় হিসেবে মেনে নেয়া হয়, তাহলে এ সকল কাজকর্ম, চিন্তা-ভাবনা সবই দ্বীনের কাজ বলে চিহ্নিত হবে, ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে। এ সকল কর্মকা-ের সাথে দুনিয়াদারির কোনো সম্পর্কই অবশিষ্ট থাকবে না। এ জন্য দ্বীন ও দুনিয়ার কর্মপ্রবাহের মাঝে কোনোই বিভেদ নেই, ফরক নেই। বরং তারতম্য হচ্ছে উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও নিয়তের পার্থক্যের ক্ষেত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা.) একজন সাহাবিকে লক্ষ্য করে বললেন, (যিনি রাত-দিন ইবাদতে মশগুল থাকতেন) তোমার ওপর তোমার দেহের হক আছে (একে কিছুটা শান্তি দেবে), তোমার চোখেরও হক আছে (কিছুক্ষণ তাকে বিশ্রাম দেবে), তোমার স্ত্রীরও হক আছে (তার সান্ত¦নার ব্যবস্থা করবে), তোমার মেহমানেরও হক আছে (তার খেদমতের জন্য সামান্য সময় ব্যয় করবে), (সহিহ বুখারি : কিতাবুল আদব, মেহমানের হক অধ্যায়)। মোটকথা, এ সকল হক ও হুকুম আদায় করাও আল্লাহর নির্দেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন ও ইবাদত বলে গণ্য। সুতরাং পাক-পবিত্র রুজি ভক্ষণ করা এবং তার শোকর আদায় করাও ইবাদত। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ। আমি তোমাদেরকে যে পবিত্র রিজিক দান করেছি, তা ভক্ষণ কর এবং আল্লাহর শোকর আদায় কর, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদতে ব্রতী হয়ে থাক।” (সূরা বাক্কারাহ) এই আয়াতের দ্বারা বোঝা যায় যে, পাক-পবিত্র রুজি তালাশ করা, ভক্ষণ করা এবং এর জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা ইবাদত। অপর এক আয়াতে তাওয়াক্কুল অর্থাৎ কাজের জন্য পরিশ্রম করে এর ফলাফলের ভার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়াকে ইবাদত সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহর ইবাদত কর এবং তারই ওপর ভরসা কর।” (সূরা হূদ) অনুরূপভাবে বিপদকালে ধৈর্য ধারণ ও অবিচল থাকা ইবাদত। আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “আল্লাহর ইবাদত কর এবং ধৈর্য অবলম্বন কর।” (সূরা মারইয়াম)
কোনো ভগ্ন দিলের অধিকারীর সাথে শান্তি ও সান্ত¦নার কথা বলা এবং কোনো অপরাধীকে ক্ষমা করাও ইবাদত। ইরশাদ হচ্ছেÑ “ভালো কথা বলা এবং ক্ষমা করা ঐ দান-খয়রাত হতে উত্তম, যেগুলোতে অন্যকে কষ্ট দেয়ার আমেজ নিহিত আছে।” (সূরা বাক্কারাহ) এই আয়াতের ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ (সা.) এভাবে করেছেনÑ “প্রতিটি পুণ্য কর্মই সদকা, তোমার ভাইকে দেখে সহাস্য আননে তাকানো সদকা, রাস্তায় পড়ে থাকা কষ্টদায়ক বস্তুটি অপসারণ করাও সদকা।” (সহিহ বুখারি : কিতাবুল আদব)
গরিব, নিঃস্ব, অসহায় ও বিধবাদের সাহায্য করা ইবাদত। বরং অনেক ইবাদতের চেয়ে উত্তম ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনÑ “বিধবা, নিঃস্ব ও গরিবদের জন্য সচেষ্ট ব্যক্তিদের মরতবা আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের মরতবার সমতুল্য। এবং ঐ ব্যক্তির সমতুল্য যিনি দিনভর রোজা রাখে এবং রাতভর সালাত আদায় করে।” (সহিহ বুখারী : কিতাবুল আদব)
পরস্পর দ্বন্দ্ব ও বিরোধের কারণগুলো দূর করা এবং পরস্পর ভালোবাসার বিস্তার করা এমন ইবাদত যার মর্যাদা নামাজ, রোজা এবং জাকাতের চেয়েও বেশি। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, “আমি কি তোমাদেরকে রোজা, নামাজ ও যাকাত হতেও অধিক মরতবার বস্তুটির কথা বলে দেব?” সাহাবিগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)। বলে দিন। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, “পরস্পরের মাঝে সুসম্পর্কের প্রতিষ্ঠা করা।” (সুনানে আবু দাউদ : দ্বিতীয় খ-, কিতাবুল আদব, পরস্পর সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা অধ্যায়, পৃ. ১৯২)
একদিন হযরত সালমান ফারেসী (রা.) অপর এক সাহাবি হযরত আবুজর (রা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। তিনি দেখতে পেলেন তার স্ত্রী অতি সাধারণ ও ময়লা কাপড় পরিধান করে আছেন। হযরত সালমান (রা.) এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। মহিলাটি উত্তর করলেন, আপনার ভাইয়ের দুনিয়ার প্রতি কোনো খায়েশ নেই।” তারপর মেহমানের জন্য খাদ্য সামগ্রী এলো। তখন হযরত আবুজর (রা.) বললেন, আমি রোজা রেখেছি। হযরত সালমান (রা.) বললেন, “আমি আপনাকে ছাড়া আহার্য গ্রহণ করব না।” পরিশেষে তিনি ইফতার করে একই সাথে আহার গ্রহণ করলেন। তারপর রাতের আঁধার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। হযরত আবুজর (রা.) উঠে চলে যেতে চাইলেন। হযরত সালমান (রা.) বললেন, “এখন শুয়ে পড়–ন”। রাতের শেষ প্রহরে তিনি তাকে জাগিয়ে তুললেন এবং বললেন, “এখন নামাজ পড়–ন।” সুতরাং উভয়েই তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করলেন। তারপর হযরত সালমান (রা.) বললেন, “প্রিয় আবুজর। তোমার প্রতিপালকের তোমার ওপর হক আছে, তোমার ওপর তোমার স্ত্রীরও হক আছে। সুতরাং তোমার ওপর যাদের হক আছে, সবই আদায় করবে।” তারপর হযরত আবুজর (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে হযরত সালমান ফারেসী (রা.)-এর ভাষণ তুলে ধরলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, “সালমান (রা.) সত্য কথাই বলেছেন।” (সহিহ বুখারি : কিতাবুল আদব, অতিথির আহার্য ও পরিচর্যা অধ্যায়, ৯০৬ পৃ.)
একদিন কতিপয় লোক রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, “ইয়া রাসূলুল্লাহ। সকল কাজের মাঝে কোন কাজটি উত্তম?” উত্তর করলেন, “আল্লাহর ওপর ঈমান আনা এবং তার পথে জিহাদ করা।” লোকজন পুনরায় জিজ্ঞেস করল, কোন গোলামকে মুক্ত করলে বেশি পুণ্য লাভ ঘটে? তিনি উত্তরে জানালেন, “যার মূল্য বেশি এবং যাকে মনিব অধিক ভালোবাসে।” লোকজন আবারও জিজ্ঞেস করল, “যদি এই কাজ আমাদের দ্বারা সম্ভব না হয়?” রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, “এরপর পুণ্যের কাজ হচ্ছে এই যে, কোনো শ্রমিককে সাহায্য করবে, কিংবা যে কাজ করতে অক্ষম তার কাজ সম্পাদন করে দেবে।” এরপর লোকজন বলল, “এ কাজও যদি সম্ভব না হয়?” রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রত্যুত্তরে জানালেন, “তাহলে কোনো খারাপ কাজ করবে না। এটাও এক প্রকার সদকা, যা তোমরা নিজেদের ওপর নিষ্পন্ন করতে পার।” (আদাবুল মুফরাদ, বুখারি, ভ্রাতৃ সাহায্য অধ্যায়)
একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদের লক্ষ্য করে বললেন, “আল্লাহপাক বান্দাহদেরকে লক্ষ্য করে বলবেন, আমি তোমাদের কাছে আহার চেয়েছিলাম, তা তোমরা দাওনি। তারা বলবে, হে পরওয়ারদিগার! তুমি কেমন করে আহার চেয়েছিলে, তুমি তো সবকিছুর প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, তোমাদের কি মনে নেই যে, অমুক ব্যক্তি তোমাদের কাছে আহার চেয়েছিল? তোমরা তাকে আহার দান করনি। যদি তোমরা তাকে আহার্য দান
করতে তাহলে আমার কাছ থেকে এর প্রতিদান লাভ করতে। হে বনী আদম! আমি তোমাদের কাছে পানি চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা আমাকে পানি পান করাওনি। তারা বলবে তুমি হলে পরওয়ারদিগার। আমরা কীভাবে তোমাকে পানি পান করাব? তুমিই তো সারা জাহানের পালনকর্তা। আল্লাহ বলবেন,
“তোমাদের কি মনে নেই যে, অমুক ব্যক্তি তোমাদের কাছে পানি চেয়েছিল, কিন্তু তোমরা তাকে পানি দাওনি। যদি তাকে পানি পান করাতে তাহলে আজ এর প্রতিদান লাভ করতে।
হে বনী আদম! আমি অসুস্থ ছিলাম। তোমরা আমার সেবা-শুশ্রƒষা করনি। তারা বলবে, হে পরওয়ারদিগার! আমরা কীভাবে তোমার সেবাÑশুশ্রƒষা করব? তুমি নিজেই তো বিশ্বপ্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, তোমার কি জানা নেই যে, আমার অমুক বান্দাহ রুগ্ন ছিল। তুমি তার পরিচর্যা করনি। যদি তোমরা তা করতে তাহলে তা আমার কাছে লাভ করতে বা আমাকে তার কাছে পেতে।” (আদাবুল মুফরাদ বুখারি, রোগীর সেবা অধ্যায়) এই প্রাণস্পর্শী ঘটনাবলিতে আল্লাহর পরিচয়ের সেতুবন্ধনকে কতখানি সুস্পষ্ট ও প্রাণবন্ত করে তুলেছে, তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। এতে খোলাখুলিভাবে ফুটে উঠেছে যে, আল্লাহর ইবাদত করা ও তার খোশনুদী অর্জন করার পথ কত বিস্তৃত, কত ব্যাপক।
হযরত সায়াদ (রা.) চাচ্ছিলেন যে, স্বীয় সকল দৌলত আল্লাহর পথে বিলিয়ে দেবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, হে সায়াদ! তুমি যা কিছু এই নিয়তে খরচ করবে যে, এর দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবে, সুতরাং এর সওয়াব তুমি অবশ্যই লাভ করবে। এমনকি যে লোকমা তুমি স্বীয় স্ত্রীর মুখে তুলে দেবে, এর পুণ্যও তুমি লাভ করবে। (আদাবুল মুফরাদ) আর একবার তিনি হযরত আবু মাসউদ আনসারী (রা.)-কে লক্ষ্য করে ইরশাদ করলেন, কোনো মুসলমান যদি সওয়াবের নিয়তে স্বীয় স্ত্রীর খরচ বহন করে, তাহলে এটাও হবে সদকার সমতুল্য। গরিব ও দুস্থ সাহাবিগণ একদিন দরবারে রিসালতে এই আরজি পেশ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! দৌলতমান্দ লোকজন সওয়ারের ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছেন। আমাদের মতো তারাও নামাজ পড়েন, তারাও রোজা রাখেন। এরপরও তারা ইবাদতে মালী সম্পাদন করেন। যা আমরা সম্পাদন করতে পারি না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহপাক কি তোমাদেরকে দৌলত দান করেননি, যা তোমরা সদকা করতে পার? তোমাদের ‘সুবহানাল্লাহ’ এবং ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলাও সদকা। এমনকি যদি কেউ স্বীয় নফসানী খায়েশকে বৈধ পন্থায় পুরা করে, এটাও সওয়াবের কাজ। লোকজন আরজ করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সে তো নিজের তৃপ্তির জন্য এ কাজ করে। ইরশাদ করলেন, সে যদি নাজায়েজ পন্থায় নিজের অভিলাস পূরণ করত তাহলে কি তার গোনাহ হতো না? সুতরাং বৈধ পন্থায় তা পুরা করলে কেন সওয়াব পাবে না? (সহিহ বুখারি : কিতাবুন নাফাকাত)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এসব শিক্ষার দ্বারা আন্দাজ করা যাবে যে, উত্তম আমলও সওয়াব এবং ইবাদতের মর্ম ইসলামে কতখানি বিস্তৃত। আর এর দ্বারা বহু মানবিক অহেতুক ভুলও অপসারিত হয়ে গেছে। এই বিশ্লেষণের পর সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, অহীয়ে মুহাম্মদী (সা.) পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ পন্থায় মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যকে ইবাদতে ইলাহী বলে সাব্যস্ত করেছে। আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “আমি মানব এবং জিন সম্প্রদায়কে এ জন্যই পয়দা করেছি, যেন তারা আমার ইবাদত করে।” (সূরা যারিয়াত : রুকু-৩) এই আয়াতে পাকে ইবাদতের অর্থ এতটা সংকীর্ণ নয়, তা সাধারণত ধারণা করা হয়। বরং সকল নেক আমল, উত্তম ও মঙ্গলজনক কাজই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। যেগুলোর একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহর সামনে স্বীয় বন্দেগীর প্রকাশ এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য ও খোশনুদী অর্জনের লক্ষ্যে করা হয়। এই বিস্তৃত পরিম-লে মানুষের সারা জীবনের কাজই শামিল রয়েছে। যেগুলো সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা রুহানিয়াতের ওই গোপন রহস্য, যা কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমেই পৃথিবীবাসী জানতে পেরেছে।
সাধারণভাবে এ কথা মশহুর হয়ে আছে যে, শরিয়তের দৃষ্টিতে চার শ্রেণীর ইবাদত ফরজ। অর্থাৎ নামাজ, রোজা, যাকাত এবং হজ। এর দ্বারা এই সন্দেহ যেন না হয় যে, এসব ফারায়েজ সুনির্দিষ্ট করার দ্বারা ইবাদতের বিস্তৃত পরিম-লকে সীমিত করে দেয়া হয়েছে। মূলত এই চার শ্রেণীর ফরজ ইবাদতের অগণিত অর্থ ও মর্ম শাখা-প্রশাখার সীমাহীন দফতরকে চারটি বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। যার মাঝে প্রত্যেক শ্রেণীর ইবাদত স্বীয় শাখা-প্রশাখা এবং বিস্তৃতি সম্বলিত এগুলোর সংক্ষিপ্ত শিরোনামের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। যেভাবে কোনো বিশাল বিস্তৃত বিষয়বস্তুকে একটি সংক্ষিপ্ত শব্দের দ্বারা প্রকাশ করে বিশাল মজমুনের ওপর স্থাপন করা হয়, অনুরূপভাবে এই চারটি ফারায়েজকে মূলত মানুষের যাবতীয় নেক আমলকে চারটি পৃথক শিরোনামে ব্যক্ত করা হয়েছে মাত্র। আর এ কারণেই মুখ্য চারটি আমলকে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করে চারটি মূল উৎস সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে।
১। বান্দাহদের ওই সকল নেক কাজ ও ভালো কর্ম যার সম্পর্ক খালেক এবং মাখলুকের মাঝে বিদ্যমান তাকে একটি পৃথক শিরোনাম দেয়া হয়েছে। আর এই শিরোনামই হচ্ছে ‘নামাজ’।
২। আর ওই সকল মঙ্গলানুষ্ঠান ও পুণ্য কর্ম যা প্রত্যেক মানুষের অন্যান্য উপকার ও আরামের লক্ষ্যে সম্পাদন করা হয়, এগুলোর শিরোনাম হচ্ছে সদকা এবং যাকাত।
৩। আল্লাহর পথে সকল প্রকার আত্মিক ও দৈহিক কোরবানি পেশ করা, কোনো সদুদ্দেশ্য পূরণের জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা এবং মন-মস্তিষ্ককে দৈহিক চাহিদা মিটানো এবং ক্ষতিকর খাহেশাতের নাপাকী হতে পবিত্র রাখা, এর অনুশীলনের শিরোনাম হচ্ছে রোজা। যদ্বারা মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের অন্তরায় প্রতিবন্ধকসমূহ দূরীভূত হয়ে যায়। আর এ কথাও বলা যায় যে, আত্মোৎসর্গ কোরবানির যাবতীয় খুটিনাটি বিষয়াবলি ও সৌন্দর্য বিকাশের মোক্ষম পন্থা হচ্ছে রোজা।
৪। মুসলিম বিশ্বে মিল্লাতে ইব্রাহিমের ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যরে বাস্তব চিত্র এবং সুশৃঙ্খল একতার বুনিয়াদি ফল্গুধারা কেবলমাত্র ইত্তেহাদ ও একতার মাধ্যমেই বিকশিত হয়ে ওঠে। এই কেন্দ্রীয় আবাদি ও রুজি অর্জনের সে চেষ্টা ও প্রয়াস, তাকেই হজ শিরোনামে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এবার চিন্তা করে দেখুন, মানুষের সকল নেক আমল ও মঙ্গলকর কর্মকা- এই চারটি মূল নীতির মাঝেই সম্পৃক্ত আছে। এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “ইসলামের বুনিয়াদ পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। (ক) তাওহিদ ও রিসালতের স্বীকৃতি প্রদান করা, (খ) নামাজ আদায় করা, (গ) রোজা রাখা, (ঘ) যাকাত দেয়া এবং (ঙ) হজ আদায় করা। (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম : কিতাবুল ঈমান) প্রথমোক্ত বস্তুর মাঝে আকায়েদ ও বিশ্বাস সংক্রান্ত যাবতীয় দফতর প্রচ্ছন্ন রয়েছে। আর বাকি চারটি জিনিস একজন মুসলমানের সকল নেক আমল এবং মঙ্গলকর কার্যাবলির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসব স্তম্ভরাজির ওপরই ইসলামের বৃহত্তর ইমারত দাঁড়িয়ে আছে।
এই অভিভাষণের মর্ম এই নয় যে, এই চারটি ফরজ ইবাদত নামাজ, যাকাত, রোজা এবং হজ মূল যথার্থ লক্ষ্যস্থল নয়। বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, এই চার শ্রেণীর ইবাদতসমূহ নিজস্ব শাখা-প্রশাখার সাথে মিলিত হয়ে সামগ্রিকভাবে ফরজ ও অপরিহার্য। যে ব্যক্তি শিরোনাম প্রযুক্ত এ সকল ফারায়েজকে আদায় করেন এবং এর অধ্যায়ের মাঝে সম্পৃক্ত শাখা-প্রশাখার প্রতি অসচেতনতা প্রদর্শন করে, এর ইবাদত হয় অসম্পূর্ণ ও অসমর্থিত। আর এরই জন্য দ্বীন ও দুনিয়ার সেই কামিয়াবি ও মুক্তি অর্জিত হয়, যার ওয়াদা আল্লাহপাক করেছেন। যে ব্যক্তি সন্দেহপ্রবণ এর দ্বারা যাবতীয় সন্দেহের অপনোদন হয়ে যায়। সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তির দ্বারা এ কথাও সূচিত হয় যে, আমাদের নামাজসমূহ কেন আমাদেরকে খারাবি হতে বিরত রাখে না? আমাদের রোজা কেন আমাদের তাকওয়া ও পরহেজগারির সম্পদ দান করে না? আমাদের যাকাত কেন আমাদের অন্তরসমূহ পাক-সাফ করে তোলে না। আমাদের হজ আমাদের মাগফিরাতের উসিলা কেন হয় না? এবং প্রথম যুগের মতো আমাদের নামাজসমূহ দেশ জয় এবং আমাদের যাকাতগুলো আমাদের সম্প্রদায়ের দরিদ্রতাকে কেন দূর করে না এবং আমাদের সামনে দ্বীন ও দুনিয়ার অঙ্গীকারকৃত নেয়ামত ও বরকতসমূহের স্তূপ কেন স্থাপিত হয় না? কিন্তু আল্লাহপাকের ওয়াদা হচ্ছে এই যে, “আল্লাহপাক ঐ সকল ব্যক্তি যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, এই অঙ্গীকার করেছেন যে, আমি তাদেরকে পৃথিবীতে খলিফা মনোনীত করব।” (সূরা নূর : রুকু-৭) ঈমানে কামেল ও নেক আমল ছাড়া এই অঙ্গীকার পূরণের আশা পূরণ করা মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়।
অনুরূপভাবে এই চার প্রকার সুস্পষ্ট শিরোনাম সম্বলিত আহকামগুলো পরিহার করে শুধু তৎসন্নিহিত শাখা-প্রশাখার বাস্তবায়নের দ্বারা ক্ষণভঙ্গুর পৃথিবীর বাদশাহী লাভ করা হয়তো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু ঐশী বাদশাহীর কোনো অংশ মোটেও লাভ করতে সক্ষম হবে না। আর ইসলাম এ জন্য এসেছে, এর অনুসারীদের কদমের নিচে উভয় জাহানের বাদশাহাত এনে দিতে পারে। (সিরাত ইবনে হিশাম : অফুদে কুরাইশ প্রসঙ্গ) এবং তা তখনই সম্ভব, যখন ইবাদতের অর্থ ও মর্ম পূর্ণ-বিস্তৃতিসহ জীবনে বাস্তবায়িত হবে, যা ইসলামের একমাত্র লক্ষ্য এবং ইসলামের মূল চেতনা এর মাঝেই নিহিত আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন