বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

সত্যালোকের সন্ধানে ইসলামে আত্মিক ইবাদতের গুরুত্ব

প্রকাশের সময় : ২৫ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৬:২৯ পিএম, ২৫ আগস্ট, ২০১৬

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী
সম্পর্ক ছিন্ন করা ইসলাম নয়
অধিকাংশ ধর্মে দ্বীনদারী ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের সর্বাত্মক পরিচিতি হিসেবে কোন গুহায়, গর্তে, পর্বতারণ্যে বসে দুনিয়ার সংযোগ হতে বিছিন্ন হয়ে অবস্থান করাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এজাতীয় কার্যক্রমকে ইসলাম ইবাদত হিসেবে গণ্য করে না। এমনকি তা ইবাদতের যথার্থ তরীকাও হতে পারে না। বস্তুত ইবাদত হচ্ছে আল্লাহ এবং বান্দাহর হক-হুকুম আদায় করা। এতদর্থে যে ব্যক্তি নিজের পরিবেশ ও প্রয়োজনকে পরিহার করে পলায়নী মনোবৃত্তির পথ অবলম্বন করে কিংবা একান্ত নিভৃতে অজানার অন্তরালে লুকানোর চেষ্টা করে সে প্রকৃতই তার স্বগোত্রীয়দের দায়-দায়িত্ব ও অধিকার আদায় হতে বঞ্চিত থাকে। যা কখনো প্রশংসার উপাত্ত হতে পারে না।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মূল লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এই যে, মানুষ তার চতুষ্পার্শ্বের ভিড় এবং আনুষঙ্গিক আবশ্যকীয় সম্পর্কের হুজ্জুম সত্ত্বেও এগুলোর দায়-দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালন করে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ভীক সৈনিকের মত সম্পাদন করে যাবে। জাগতিক সম্পর্কের উপাদানগুলোকে ভয় করে কিংবা এগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত না করে নিজেকে নিঝুম মায়াজালে আবদ্ধ করলে সেটা হবে ভীত-সন্ত্রস্ত মতিভ্রম সৈনিকের পদচারণা মাত্র। তা ইসলামের কাম্য নয়। বরং ইসলাম চায়, তার প্রতিটি অনুসারী অকুতোভয় কালজয়ী সৈনিকরূপে গড়ে উঠুক এবং শত ব্যস্ততার মাঝেও আল্লাহর স্মরণে নিজেকে ব্যাপৃত রাখুক। ইসলামের দৃষ্টিতে সৃষ্টির কল্যাণার্থে সকল কাজ-কর্মই ইবাদত। দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্জনের নাম ইবাদত নয়; বরং কর্তব্য ও দায়িত্ব প্রতিপালনের পরিপূর্ণ রূপই সত্যিকার ইবাদত হিসেবে পরিগণ্য। সংক্ষেপে বলতে গেলে ফরজ আদায় করাই ইবাদত। এই ফরজ আদায় নিঃসন্দেহে নির্জনতায় কখনো সম্ভব হতে পারে না। যে সকল সাহাবী পরিবার-পরিজনদের ছেড়ে এবং বন্ধু-বান্ধবদের হক বিস্মৃত হয়ে দিনভর রোজা রাখতেন এবং রাতভর ইবাদত-বন্দেগী করতেন তাদেরকে লক্ষ্য করে রাসূলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছিলেন, “হে অমুক! তুমি এমন আর করো না। জেনে রেখ, তোমার উপর স্ত্রীর, ছেলে-সন্তানের হক আছে, তোমার মেহমানদের হক আছে, তোমার প্রাণের হক আছে, তোমার চোখেরও হক আছে।” (সহীহ বুখারী)
ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদত হচ্ছে যাবতীয়-হক-হুকুক আদায় করা, কিন্তু এ সকল হক-হুকুক আদায় করা নয়। একবার কোনও এক যুুদ্ধের সময় জনৈক সাহাবী এমন একটি স্থানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যেখানে একটি নিভৃত গুহা ছিল এর পাশেই ছিল একটি স্বচ্ছ পানির ঝর্ণা এবং একপ্রান্তে ছিল ছোটখাট একটি মরুদ্যান ও ফল-ফলারীর লতাকুঞ্জ। নিজের একাতীত্ব জীবনযাপনের জন্য স্থানটি তাঁর কাছে খুবই উপযোগী বলে মনে হল। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি একটি গুহার সন্ধান লাভ করেছি। এখানে জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সবকিছুই রয়েছে। আমার মন চাচ্ছে এই নির্জন গুহায় বসে জীবনযাপন করি এবং জাগতিক সমুদয় সম্পর্ক ছিন্ন করে এখানে চলে আসি। প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, ইহুদী ও নাসারাতের বিকৃত জীবন-ব্যবস্থা নিয়ে আমি আগমন করিনি। বরং আমি নিয়ে এসেছি হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর ঐ জীবন-ব্যবস্থা যা সহজ, সরল, আসান ও আলোকোজ্জ্বল। (মোসনাদে ইবনে হাম্বল : ৫ খ: ৪৬৬ পৃ:)
অহী লাভ করার আগে রাসূলুল্লাহ (সা.) জাবালে নূরের হেরা গুহার মাঝে মধ্যে গমন করে কয়েকদিন অবস্থান করতেন এবং আল্লাহ পাকের ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। কিন্তু যখন অহী নাজিল শুরু হল এবং তিনি আল্লাহর বাণী লাভ করলেন তখন দাওয়াত ও তাবলীগের বোঝাও তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। দিন-রাতের মাঝে কেবল রাতের কয়েকটি ঘণ্টা এবং বছরে রমজান মাসের শেষ দশ দিন এতেকাফ ও নিবিষ্ট-চিত্ততার সাথে আল্লাহর জিকিরে নিমগ্ন থাকতেন। তাছাড়া সারাদিন অতিবাহিত হত, জামাতের সাথে আল্লাহর ইবাদতের ভিতর দিয়ে এবং তারপর মাখলুকের কল্যাণার্থে তিনি সময় ব্যয় করতেন। এটাই ছিল খোলাফায়ে রাশেদিন এবং সকল সাহাবীদের কর্মময় জীবনের একান্ত গতিধারা। ঠিক এভাবেই পরিপূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে ইসলাম ধর্মের প্রতিটি ইবাদত বন্দেগীর প্রবাহ। ইসলামের কোন গৃহকোণে অবস্থান করা ও বাইরের ছোঁয়া এবং সংস্পর্শ হতে বিরত থাকার অবকাশ কখন আসতে পারে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে নিয়মনীতি ও কানুন মাফিক চলতে হবে। কোনক্রমেই কানুন ও নিয়ম-শৃঙ্খলা লংঘন করা যাবে না।
এখন লক্ষ্য করা যাক, কোন অবস্থায় এবং কখন একজন লোক একাকীত্ব বরণ করে নিতে পারে। (ক) এমন কোন ব্যক্তি যার সমুদয় কার্যকলাপই অমঙ্গলের সাথে জড়িত। যার চলাফেরা, কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনার দ্বারা কোন সৃষ্ট পদার্থই উপকার লাভ করে না বরং অপকারের যাঁতাকলে নিষ্পৃষ্ট হয়। এমন ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) অমঙ্গলের হাত হতে বেঁচে থাকার জন্য এই পরামর্শ প্রদান করেছেন যে, সে যেন জনমানুষের সংস্পর্শ হতে দূরে সরে থাকে। একবার একজন বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দেখমতে হাজির হয়ে আরজ করলো- সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি কে?’ রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রত্যুত্তরে জানালেন, (১) ‘ঐ ব্যক্তি যে নিজের জান ও মাল আল্লাহর পথে কুরবানী করে। (২) ঐ ব্যক্তি যে কোন নির্জন মাটিতে বসে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে এবং স্বীয় অপকার হতে মানুষকে রক্ষা করে।’ (সহীহ বুখারী : কিতাবুল আদব)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই শিক্ষা দ্বারা সকল মানুষকে দু’টি শ্রেণীতে বিন্যাস করা যায়। প্রথমত, সৃষ্টির শুভলগ্ন হতে যার মাঝে হেদায়েত এবং সৃষ্টজগতের খেদমতের তাওফীক প্রদান করা হয়েছে তার উচিত লোকালয়ে ও জনসমুদ্রে বসবাস করে মঙ্গলের পথে নিজে সুদৃঢ় থাকা এবং অন্যকেও মঙ্গলের দিকে আহ্বান করা । এ পথে তার জান ও মাল উৎসর্গ হয়ে যাওয়াটাই উত্তম। দ্বিতীয়ত, ঐ ব্যক্তি যার সহজাত স্বভাবই হচ্ছে অন্যের অনিষ্ট সাধন করা ও অমঙ্গলের পরিধি বিস্তৃত করা তার চারিত্রিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য উচিত হচ্ছে জনগণের সান্নিধ্য হতে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং নিবিষ্টচিত্তে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করা। এতে করে তার গোনাহের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে না এবং মানুষ ও তার অনিষ্টকারিতা হতে নিরাপদ থাকবে। দ্বিতীয়ত, যদি লোকালয়, জনবসতি, গোত্র বা দেশে ফেতনা-ফাসাদের বাজার এমনভাবে গরম হয় যে, তা প্রতিহত করা বা সংস্কার সাধন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন উত্তম পন্থা হচ্ছে এই যে, জনতার সংস্পর্শ হতে নিজেকে দূরে রাখা। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীদের লক্ষ্য করে একবার বললেন- “এমন একটি সময় মানুষের সামনে আসবে, যখন একজন মুসলমানের উত্তম সম্পদ হবে তার ছাগলের পাল। এগুলো নিয়ে সে বৃষ্টিভেজা স্থান ও পাহাড়ী ঘাঁটি তালাশ করতে থাকবে। যেন সে নিজের দ্বীন ও ঈমানকে ফেতনা ও অশান্তির হাত হতে রক্ষা করতে পারে।” (সহীহ বুখারী : কিতাবুল আদব)
বস্তুত, একাকী জীবনযাত্রার জন্য উল্লিখিত পন্থাগুলো খুবই প্রণিধানযোগ্য। প্রথমাবস্থায় যার দ্বারা কোন মাখলুক বা জমাতের উপকারের বদলে অপকারের সম্ভাবনা বেশি থাকে, সেক্ষেত্রে নির্জনতা অবলম্বন করা নিজের এবং জমাতের উভয়ের জন্যই উপকারী। দ্বিতীয় পর্যায়ে দেশ, জাতি, সমাজ ও দলের নিয়ম-শৃঙ্খলা বলতে কিছুই না থাকলে, পুণ্যশীল ও মঙ্গলকামী লোকজন প্রয়োজনীয় শক্তির অভাবে যদি তা প্রতিহত করতে কিংবা সংস্কার সাধনে অপারগ হন তাহলে অরাজকতার হাত হতে নিজেকে রক্ষা করার জন্য একাকী পথ চলাই উত্তম। ফলে তার নিজের নেক আমলের সুযোগ অব্যাহত থাকবে এবং অশান্তির নিগঢ় রক্ষা পাবে।
ইসলামী ইবাদতের অর্থ
ইসলাম প্রকৃতই শান্তির ধর্ম, নিরাপত্তার ধর্ম। ইসলামের ইবাদত বলতে যা বুঝায় তার পরিসর ও বিস্তৃতি খুবই প্রণিধানযোগ্য। বিশ্বের অন্যান্য ধর্মগুলোর বেলায় তা মোটেই ...
প্রযোজ্য নয়। সংকীর্ণতা, কুপমন্ডুকতা, অস্পৃশ্যতা ও অধিকারহীনতাই হলো অন্যান্য ধর্মগুলোর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ইসলামে ইবাদত-এর ধারণা লাভ করতে হলে লক্ষ্য করতে হবে যে, ইবাদতের শাব্দিক অর্থ কি? এর অর্থ হলো- নিজের আজিজী ও আনুগত্য এবং অক্ষমতা প্রকাশ করা। শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহ জাল্লাশানুহুর সন্নিধানে নিজের বন্দেগী ও আনুগত্যের নজরানা পেশ করা এবং তাঁর নির্দেশাবলী অনুণ্ঠুচিত্তে পালন করার নামই ইবাদত। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, আল-কোরআনে ইবাদতের বিপরীত শব্দ হিসেবে অহংকার ও অহমিকা শব্দদ্বয়কে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “যে আমার ইবাদত হতে অহংকার বশে নিবৃত থাকে, সে অবশ্যই জাহান্নামের প্রবেশ করবে।” (সূরা মু’মিন)
আনুগত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ফেরেশতাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “যারা তাঁর সন্নিধানে অবস্থান করেছে, তারা তাঁর ইবাদতের ক্ষেত্রে কখনো অহমিকা প্রদর্শন করে না।” (সূরা আম্বিয়া)
এ প্রসঙ্গে সৌভাগ্যশালী ও ঈমানদার মু’মিনদের সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়েছে, “অবশ্যই আমার নিদর্শনাবলীর ওপর তারাই পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে, যাদের এই নিদর্শনাবলী দ্বারা বুঝানোর সাথে সাথে তারা সেজদায় পতিত হয় এবং স্বীয় প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং তারা অহঙ্কার করে না।” (সূরা সেজদাহ)
আল-কোরআনে এই জাতীয় আরো বহু আয়াত রয়েছে যা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইবাদতের বিপরীত হচ্ছে অহঙ্কার প্রদর্শন করা। সুতরাং অহঙ্কার ও অহমিকার অর্থ হচ্ছে- মহান আল্লাহ পাকের সার্বিক শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করে নিজেকে বড় মনে করা এবং নিজের সত্তাকে কিছু একটা বলে ধারণা করা এবং আল্লাহর সামনে মস্তক অবনত করাকে লজ্জাষ্কর মনে করা।
বস্তুত, আল্লাহর সন্নিধানে নিজের আজিজী ও বন্দেগী প্রকাশ করা ও তাঁর নির্দেশাবলীর প্রতি আনুগত্যের শির অবনত করার মাধ্যমেই ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যে নিহিত রয়েছে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাক জবান হতে ঘোষণা করা হয়েছে যে, “বান্দাহর ঐ সকল কাজ যার উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বীয় আজিজী ও বন্দেগী প্রকাশ করা এবং তাঁর নির্দেশাবলীর প্রতি একান্ত আনুগত্য সহকারে নিজেকে সমর্পণ করা, তা সবই ইবাদতের মাঝে পরিগণিত।” এতদর্থে কোন মানুষ বাহ্যত যত উত্তম কাজই করুক না কেন, এর দ্বারা যদি স্বীয় বন্দেগী ও আজিজীও প্রকাশ না পায় এবং আল্লাহর নির্দেশাবলীর প্রতি আনুগত্যের ছোঁয়া না থাকে তা কখনো ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না।
এতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, সব ভালো কাজ ইবাদতের মাঝে শামিল করতে হলে নিয়ত ও উদ্দেশ্য পাক ও খালেস হওয়া একান্ত দরকার। আর এই খালেস নিয়তের দ্বারাই কোনটা ইবাদত এবং কোনটা ইবাদত নয়, তা নির্ণীত হয়ে যায়। আল- কোরআনে এর প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে বলা হয়েছে-‘দোজখ থেকে মুত্তাকীনদেরকে বাঁচানো হবে, যারা নিজেদের মাল-সম্পদ অন্তরের পবিত্রতার নিমিত্ত খরচ করে এবং তার উপর কাহারো ইহসান অবশিষ্ট নেই, যার প্রতিদান তাকে দিতে হবে; বরং আল্লাহর পবিত্র সত্তার সান্নিধ্য লাভই তার একমাত্র উদ্দেশ্য, সে অবশ্যই পরিতুষ্ট হবে।” (সূরা আল লাইল)
অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছেÑ “তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে, তা কেবল আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্যই করবে”। (সূরা বাকারাহ) অন্যত্র বলা হয়েছেÑ “আমি শুধু আল্লাহর করুণা ও অনুকম্পা লাভের জন্যই তোমাদের আহার করাচ্ছি।” (সূরা ইনসান) “অভিশম্পাত ঐ সকল নামাজীর জন্য যারা স্বীয় নামাজে গাফেল থাকে এবং অন্যকে দেখানোর জন্য কাজ করে। (সূরা মাউন)
আল-কোরআনে উপরোক্ত আয়াতগুলোর সুস্পষ্ট ও সুবিস্তৃত তাৎপর্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাক জবানে অতি সংক্ষিপ্ত আকারে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, “সকল কাজের পুণ্য এর নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
নিয়তের এই তাৎপর্য রাসূলুল্লাহ (সা.) ঐ সকল লোকদের সামনে পরিস্ফুট করেছিলেন যারা নিজেদের ঘরবাড়ী ছেড়ে হিজরত করে মদীনায় আগমন করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, “প্রত্যেক ব্যক্তি ঐটুকুই পাবে যতটুকু সে নিয়ত করেছে। যদি হিজরতের উদ্দেশ্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সান্নিধ্য হয়, তাহলে আল্লাহ পাক তার বিনিময় প্রদান করবেন। আর হিজরত যদি দুনিয়াবী উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত হয়, কিংবা কোন স্ত্রীলোককে পাওয়ার লক্ষ্য হয় তবে তার হিজরত ঐ বস্তুর প্রতিই নিবিষ্ট হবে, যার উদ্দেশ্যে সে হিজরত করেছে।” (সহীহ বুখারী)
এই বিশ্লেষণ হতে এটাই প্রতীয়মান হয়ে যে, রাসূলুল্লাহ (স.) ইবাদতের যে অন্তর্নিহিত মর্ম দুনিয়ার সামনে পেশ করেছেন এর মাঝে প্রথম জিনিস হচ্ছে অন্তরের উদ্দেশ্য ও ইখলাস। এক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট কাজ ও তরীকার কথা নির্ধারিত করা হয়নি। বরং মানুষের প্রত্যেক কাজ যার উদ্দেশ্য হচ্ছে- আল্লাহর খোশনুদী ও রেজামন্দি লাভ করা এবং তাঁর নির্দেশাবলী অনুসরণ করা, তা’সবই ইবাদত, যদি তুমি নিজের সুনামের জন্য লাখো টাকা কাউকে দান কর, তা ইবাদত বলে গণ্য হবে না। পক্ষান্তরে আল্লাহর রেজামন্দি লাভের আশায় এবং তাঁর নির্দেশ পালনের নিয়তে কয়েকটি কড়ি দান করলেও তা বৃহৎ ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষার আলোকে সত্যিকারের ইবাদত পরিসাধিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অন্তরের পবিত্রতা, রূহের নির্মলতা এবং কর্ম সম্পাদনের জন্য ইখলাস ও পূর্ণ আন্তরিকতা এবং নির্মল নিয়ত ও উদ্দেশ্যে। এই শ্রেণীর ইবাদতের সাথেই ইসলামের ঘনিষ্ট ও নিবিড় বন্ধন রয়েছে।
ইবাদতের উদ্দেশ্য ও পরিণতির কথা তুলে ধরে আল-কেরআনে ইরাশাদ হচ্ছে- “হে লোক সকল! তোমরা নিজেদের ঐ প্রতিপালকের ইবাদত কর, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও।” (সূরা বাকারাহ) এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, ইবাদতের উদ্দেশ্যে ও পরিণতি হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া হচ্ছে- মানুষের অন্তরে ঐ গুণাবলীর বিকাশ যা তাদের হৃদয়ে পুণ্য কর্মের- অনুপ্রেরণা এবং খারাপ কাজের প্রতি ঘৃণার ভাব ফুটিয়ে তোলে। একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় বক্ষস্থলের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেছিলেন। “তাকওয়ার স্থান হচ্ছে এই বক্ষস্থল।” (সহীহ মুসলিম) আর আল-কোরআনেও ‘তাকওয়াল কুলুব’ বা অন্তরসমূহের তাকওয়া বলে এই দিকনির্দেশনাই তুলে ধরা হয়েছে। (সূরা হজ্জ) এই পরিবেশ সৃষ্টি করাই ইসলামী ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য নামাজ, রোজা ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী আদায় করার মূলে এই উদ্দেশ্যই নিহিত রয়েছে। এই নিরীখে মানুষের ঐ সকল বৈধ কাজকর্ম ও চিন্তা-ভাবনা যা শরীয়তের হুকুম মোতাবেক এই উদ্দেশ্য সাধনের পথ সহজ ও সুগম করে তোলে, তা সবই ইবাদত বলে গণ্য হবে।
উপরোক্ত পথনির্দেশকে আমরা এভাবেও ব্যক্ত করতে পারি- সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, ইবাদত বলতে নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক কাজকর্মকেই বুঝানো হয়ে থাকে যা মানুষ আল্লাহর রেজামন্দি লাভের আশায় পালন করে। যেমন-নামাজ, রোজা, কুরবানী প্রভৃতি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহান শিক্ষা এই সংকীর্ণতার সীমারেখাকে বিলীন করে এর ক্ষেত্র ও পরিধিকে বিস্তৃত ও বিশালরূপে ফুটিয়ে তুলেছে। এই শিক্ষার আলোকে বলা যায় যে, প্রতিটি পুণ্যকর্ম যা খালেসভাবে আল্লাহর জন্য করা হয় এবং আল্লাহর সৃষ্টজগতের কল্যাণের জন্য পরিসাধিত হয় যার মূলে আল্লাহর খোশনুদী অর্জনই কাম্য তা সবই ইবাদতের মাঝে শামিল রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর জন্য কাজ করার মর্ম হচ্ছে এই যে, সে কাজ আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতা বর্ণনার জন্যই হোক কিংবা কোন মানুষ বা প্রাণীর মঙ্গলার্থেই হোক কিন্তু এই কাজ সম্পাদনকারীর মাঝে যেন লোক দেখানো মনোবৃত্তি, অহমিকা, অহংকার অপরের উপর দয়া প্রদর্শন, সুনাম অর্জন ও দুনিয়াবী উদ্দেশ্য পরিপূরণের কোনরকম চিহ্ন অবশিষ্ট না থাকে এবং বস্তুময় পরিম-লের আবেষ্টনীর বেড়াজালে তা সমাচ্ছন্ন না হয়। বরং যাবতীয় কর্মকা-ের মূলে থাকবে আল্লাহর মহব্বত লাভের প্রত্যাশা, তাঁর রেজামন্দি অর্জনের উদগ্র অনুরাগ এবং খোশনুদী লাভের নির্ভেজাল আকর্ষণ। এতে করেই খালেস ইবাদতের স্বরূপ কাজের ভিতর দিয়ে বিকশিত হবে এবং লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার পথ সুগম করে তুলবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন