মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

চাঁদাবাজির মহোৎসব

রাজধানীর ফুটপাথ ও রাস্তায় কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

চাঁদাবাজি থামছে না কিছুতেই। রাজধানীর ফুটপাথ থেকে শুরু করে নির্মাণাধীন বহুতল ভবন পর্যন্ত চাঁদাবাজি চলছেই। সাথে বাস, টেম্পু, নিষিদ্ধ ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ডিশ, ইন্টারনেট প্রোভাইডার সেক্টরতো আছেই। এখন পুরো রাজধানীর পাড়া মহল্লায় রাস্তা দখল করে বসানো হচ্ছে ভ্যানগাড়ির দোকান। সেখান থেকেও প্রতিদিন তোলা হচ্ছে চাঁদা। সরকারি বাড়ি, জায়গা জমি দখল করে চাঁদাবাজির ঘটনা অনেক পুরনো। সময়ের সাথে হাত বদল হয়, চাঁদাবাজি বন্ধ হয় না।

ভুক্তভোগীদের মতে, চাঁদাবাজির ধরণ এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। আগে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি করতো।
এখন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সহযোগীদের সাথে যোগ হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। এ কাজে সহযোগিতা করছে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ পুলিশ। সন্ত্রাসীদের তৎপরতা একেবারে নেই তা নয়। তবে প্রভাবশালীদের চাঁদা না দিলে সন্ত্রাসীরাও টিকতে পারে না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশও অসহায় রাজনীতিকদের কাছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররাও এ কাজে পিছিয়ে নেই। সরকারি জায়গা-জমি-বাড়ি, রাস্তা ও ফুটপাথ দখল করে কেউ কেউ চাঁদার রাজত্ব কায়েম করেছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এসব নিয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মেলে না।

মতিঝিল শাপলা চত্বরে গিয়ে দেখা গেছে, সোনালী ব্যাংকের সামনে ফুটপাথ দখল করে ভাসমান কাপড় ব্যবসায়ীরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু সোনালী ব্যাংকের সামনে নয়, পুরো শাপলা চত্বরের চারপাশে ফুটপাথ দখল করেছে ভাসমান ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা জানান, দিনে ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা করলেও রাতে তাদের ভ্যানগাড়ি ও মালামাল গোডাউনে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এতে ভাসমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গোডাউন মালিকরা দিনে ৮০ টাকা ও রাতে ১০০ টাকা নিয়ে থাকেন। একই অবস্থা দিলকুশা এলাকায়ও।

গতকাল সেই এলাকার জনতা ব্যাংকের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, ফুটপাথে কয়েকটি চৌকি রাখা আছে। সেই এলাকার বাবুল নামের এক নিরাপত্তাকর্মী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, প্রতি শুক্রবার সেই এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিস বন্ধ থাকে। তাই ভাসমান ব্যবসায়ীরাও আসেন না। তবে সপ্তাহের ছয় দিনই ভাসমান ব্যবসায়ীরা ফুটপাথ দখল করে নেন। তাই ফুটপাথ ছেড়ে মূল সড়ক দিয়েই চলাচল করেন পথচারীরা।

গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, জিপিওএর পশ্চিম পাশ ও সামনের ফুটপাথ দখল করে ভাসমান ব্যবসায়ীরা শীতের কাপড় বিক্রি করছেন। একই অবস্থা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনের ফুটপাথেও। সেই এলাকায় শুধু ফুটপাথ দখল করেই ক্লান্ত হয়নি দখলবাজরা। মূল সড়ক দখল করেও কাপড় ও ফলের ব্যবসা করতে দেখা গেছে।

পল্টন মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে, তোপখানা সড়কের ফুটপাথ দখল করে রেখেছেন ভাসমান ব্যবসায়ীরা। সেই সড়কে অনেকগুলো ভ্যানগাড়িও রাখা হয়েছে। গাড়িগুলো পলিটিন ও রশি দিয়ে বাঁধা রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, পুলিশকে মেনেজ করে ভাসমান ব্যবসায়ীরা ফুটপাথ দখল করে রেখেছেন। তাই শুক্রবার বন্ধের দিনও ফুটপাথ দখল করে তাদের মালামাল নিরাপদে রেখেই বাসায় গেছেন।

সূত্র জানায়, রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল ও গুলিস্তান এলাকা থেকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদা আদায় করতে গিয়েও রয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট। ওইসব সিন্ডিকেট সদস্যদের নাম দৈনিক ইনকিলাবের কাছে এসেছে। তাদের মধ্যে পল্টনস্থ বাসস অফিসের সামনের ফুটপাথ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেন আদালত থেকে নিষিদ্ধ হকার্স সংগঠনের সভাপতি আবুল হাসেম কবির, তার সহযোগী মুকিদুল ইসলাম শিমুল ও হযরত আলী। বায়তুল মোকারম পূর্ব গেইটের বন্ধ রাস্তার হকার্সের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন পল্টন থানা পুলিশের ক্যাশিয়ার পরিচয়দানকারী ও ইয়াবা ব্যবসায়ী দুলাল, সেকেন্দার হায়াত ও আরিফ চৌধুরী।

বায়তুল মোকারম পশ্চিম পাশের ফুটপাথ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেন অবৈধ সংগঠন হকার্স সংগ্রাম পরিষদের নেতা চাট গাইয়া হারুন ওরফে বাটপার হারুন, হিন্দু খোকন মজুমদার, মিজান, মোস্তফা ও জাহাঙ্গীর। বায়তুল মোকারম উত্তর পাশের ফুটপাথ থেকে চাঁদা আদায় করেন সাজু, মন্টু, কালানুরু, আব্দুল্লাহ খোকন ও সবুজ।

বঙ্গবন্ধু এক নম্বর গেটে বাবুল, তার দুই ছেলে আকাশ ও হৃদয়, ২ নম্বর গেট ও ভাষানি স্টেডিয়ামের পাশে চাঁদা সংগ্রহ করেন আলী, গফুর, বায়তুল মোকারম লিং রোডে কোটন, ফারুক, জিপিও এর দক্ষিণ পাশে বুড়া ছালাম, নজরুল মুক্তাঙ্গনের পাশে নাছির, আলমঙ্গীর, মনির, হাউজ বিল্ডিং এর পাশে ফলপট্টিতে ওসমান, আলমগীর, জাহাঙ্গীর, কমিউনিস্টপার্টি অফিসের সামনে হানিফ, কালাম, আবুল হোসাইন, এলমল্লিক বিল্ডিং এর সামনে পল্টন মোড়ে বিল্লাল, টিটু, আহাদ পুলিশ বক্সের দক্ষিণ পাশে সাইদের ছেলে রিপন, জনি, জয়নাল, আহাদ বক্সের উত্তর পাশে লম্বা হারুন ও ফোন বক্সের দোকান নামধারি শাহিন।

সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের পূর্ব পাশে সেলিম, জয়নাল, লম্বা বাবুল, ভোলা, সালেক, আবু সাইদ, রজ্জব, গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার এর পশ্চিম পাশে বিমল, মিন্টু, হান্নান সিদ্দিকি, গুলিস্তান হলের সামনে টাকা ওয়ালা বাবুল, খোরশেদ ওরফে বড়মিয়া, কালাম, বাচ্চু, সুলতান, আহাদ বক্সের সামনে নয়ন মুন্সি হান্নান, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের সামনে লিপু, শহিদ, রমনা ভবনের পশ্চিম পাশে মনির, শফিক, খদ্দর মার্কেটের সামনে কাদের ও মো. আলী, রাজধানী হোটেলের সামনে কালানবী, রব, সেলিম, নাছির, পূর্ণিমা স্ন্যাক্স ও অগ্রণী ব্যাংকের সামনে আক্তার, জাহাঙ্গীর, দুলাল, শাহবুদ্দিন, সোনালী ব্যাংক ও খাবার দাবার হোটেলের সামনে জুয়ারী সালাম, রহিম, অপু।

বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটে খলিল, তাজু, নবী, আনোয়ার, ওসমানী উদ্যানের দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে গাউরা বাবুল, লম্বা শাহজাহান, হিন্দু শাহিন, মোহন, বাচ্চু, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে একাধিক মামলার আসামি সাইফুল মোল্লা, তার দুই ছেলে সিবলু, হোসাইন, মোহর আলী, শাহ জাহান, টিপু, বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তর পাশে ইয়াবা ও গানজুট্টি হারুন শহীদ, মতিঝিল সোনালী ব্যাংকের সামনে মকবুল, সাইদ, ফারুক, বক চত্ত¡রে মান্নান মোল্লা, নুরুল ইসলাম, কালা কাশেম, ইউসূফ, নিউ মার্কেটে জুতা সেলিম, চুন্নু, আলামিন, জয়কলি মন্দির এলাকায় মহসিন ও তার বৌ রিতা বেগম।
নিউ মার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা কলেজের উল্টো দিকে, গাউছিয়া মার্কেটের এলাকায় ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। একই অবস্থা রাজধানীর ফার্মগেট এলাকাতেও। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ফার্মভিউ মার্কেট, তেজগাঁও কলেজের সামনে ফুটপাথ দখল করে কাপড় ও সবজি বিক্রি করছে ভাসমান ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি রাতে তেজগাঁও কলেজের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, এক নারী ভাসমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করছেন। নিয়মিত রাতে ওই নারী সেই এলাকা থেকে চাঁদা সংগ্রহ করলেও তার নাম বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

শুধু মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, নিউ মাকের্ট ও ফার্মগেট এলাকাই নয়, রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাথের মধ্যে ভাসমান ব্যবসায়ীদের দখলে ১০৯ কিলোমিটার। আর ২ হাজার ২৯০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭৩ কিলোমিটার সড়ক অবৈধ দখলে। আর এসব রাস্তা ও ফুটপাথ দখলের নেপথ্যে রয়েছে সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশের বিশাল অর্থ বাণিজ্য। এ কারণে পর্যাপ্ত আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকার পরেও ফুটপাথ দখলমুক্ত করা সম্ভব হয় না।

সূত্রমতে, হকার উচ্ছেদের নামে চোর-পুলিশ খেলা চললেও তাদের প্রশ্রয়ে প্রতিদিন দোকান পেতে বসে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার হকার। ফুটপাথ থেকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশ সদস্যরা দৈনিক চাঁদা পায় প্রায় ৩ কোটি টাকা। যা কয়েক স্তরে বণ্টন হয়।

এ ছাড়া, রাজধানী পাড়া-মহল্লার রাস্তা দখল করে ভ্যানগাড়ি লাগিয়ে নতুন করে চলছে চাঁদাবাজি। প্রতিটি এলাকার পাড়া মহল্লায় এখন শত শত ভ্যানের ছড়াছড়ি। প্রতিটি ভ্যান থেকে সরকারদলীয় প্রভাবশালীরা চাঁদা তোলে। এর অর্ধেক ভাগ পায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ।

এদিকে, করোনা মহামারিতেও ফুটপাথ দখল করে রামরমা বাণিজ্য চললেও সুখ নিদ্রায় রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে করোনার কারণে ফুটপাথে অভিযান বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এডিসি ইফতেখায়রুল ইসলাম। তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, করোনাকালীন সময়ে সকল মাস্ক, স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিরুদ্ধে অভিযান চলেছে। ফুটপাথ উচ্ছেদের অভিযান বন্ধ রয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
Habib ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৫২ এএম says : 0
বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকায় এমন ঘটনা আছে, খোজ নিলেই প্রমান পাওয়া যাবে। একমাত্র পুলিশ হচ্ছে ওই.....
Total Reply(0)
Kader sheikh ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৫৩ এএম says : 0
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত
Total Reply(0)
Neamat Ullah ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৫৪ এএম says : 0
আরে ভাই এগুলা তো সব জায়গাতেই হয়। টাকা দিলে নাকি সব মিট্মাট।
Total Reply(0)
Jaker ali ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৫৫ এএম says : 0
এটা নতুন কি এটা রোজ দিনকার
Total Reply(0)
Unit chief ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৫৬ এএম says : 0
Very very bad news for genarel people
Total Reply(0)
Babu shek ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ৩:০০ এএম says : 0
Oh Allah save us from this kind of Zulum
Total Reply(0)
মশিউর ইসলাম ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ৮:২২ এএম says : 0
এসব চাঁদাবাজরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের টিকিয়ে রেখেছে আর তারা বিনিময়ে সেলটার দেয়।
Total Reply(0)
নাসিম ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ৮:২২ এএম says : 0
এটাই আমাদের সোনারা বাংলাদেশ!!!
Total Reply(0)
Md Sumon ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ৫:৪৩ পিএম says : 0
I hate Bangladesh
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন