১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় সর্বসম্মত দাবি এবং হিন্দু নেতৃবৃন্দের সম্মতির ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। এই লাহোর প্রস্তাব ছিল হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত এ উপমহাদেশের শত শত বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধির ফসল। লাহোর প্রস্তাবের দুটি দিক ছিল: এক, উপমহাদেশকে হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চলের ভিত্তিতে বিভক্ত করা, দুই. উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলিম এলাকাসমূহের সমন্বয়ে একাধিক পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা। লাহোর প্রস্তাবের কোথাও ‘পাকিস্তান’ শব্দ ছিল না। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের যে অধিবেশনে ওই প্রস্তাব গৃহীত হয়, তার সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে হিন্দু সংবাদপত্রগুলো প্রথম একে ‘পাকিস্তান’ প্রস্তাব বলে উল্লেখ করে এবং মুসলিম লীগও পরবর্তীকালে এ নামকরণ মেনে নেয়। ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ লেজিসলেটার্স কনভেনশনে লাহোর প্রস্তাব আংশিক সংশোধনের মারফৎ উপমহাদেশের দুই প্রান্তের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহের সমবায়ে একাধিক রাষ্ট্রের স্থলে একটি মাত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেদিন উপমহাদেশের মুসলমানদের দাবি-দাওয়ার বিরুদ্ধে হিন্দু-ব্রিটিশ অশুভ আঁতাতের মোকাবেলায় বৃহত্তর মুসলিম সংহতির জন্য এই সংশোধনের প্রয়োজন অনুভ‚ত হয়েছিল, এরূপ ধারণা করার যথেষ্ট সঙ্গত কারণ আছে।
লাহোর প্রস্তাবে হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চলের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্ত করার কথা বলা হলেও এ প্রস্তাবের কোথায়ও সা¤প্রদায়িকতার লেশমাত্র ছিল না। এ প্রস্তাব বরং ছিল সা¤প্রদায়িক নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার একটি বাস্তব প্রচেষ্টা মাত্র। লাহোর প্রস্তাবের যাঁরা প্রবক্তা, শেরেবাংলা, কায়েদে আজম প্রমুখ, সবাই জীবনভর হিন্দু স¤প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার প্রয়াস পান। কিন্তু তাঁদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বাস্তব ও তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলেই মুসলিম নেতৃবৃন্দ শেষ পর্যন্ত নিরূপায় হয়ে দেশ বিভাগ দাবি করতে বাধ্য হন। এই দাবি হিন্দু নেতৃবৃন্দ মুখে স্বীকার করলেও পরবর্তীকালে অবশ্য প্রমাণিত হয়, তাঁরা কখনো এ দাবি অন্তর থেকে স্বীকার করেনি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত এই চব্বিশ বছর নানা কারণেই জাতির ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলিম শাসনের অবসানের পর উনিশশো সাতচল্লিশ পর্যন্ত ছিল দেশি-বিদেশি অমুসলিম শক্তির মোকাবেলায় যে সংগ্রাম হয়েছে, আসলে তা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার সংগ্রাম। শেষ পর্যায়ে এ সংগ্রাম মুসলিম নবজাগরণের আন্দোলনে উন্নীত হয়েছিল। এক হিসাবে সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত ছিল যেন এই রেনেসাঁ থেকে পশ্চাদপসরণের পালা। একটা দুর্ভাগ্যজনক ভুল বোঝাবুঝি, আত্ম-বিস্মৃতি, অবিবেচনা ও বিদ্বেষ হলাহলের পরিণতিতে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে উন্নয়নশীল মুসলিম রাষ্ট্রের দ্বিধাবিভক্তি ঘটে। চিত্রের এ হচ্ছে একটি দিক। চিত্রের আরেক দিক হচ্ছে, বৈষম্য, অবিচার, অত্যাচারের অবসানে স্বাধীনতার এক নব উদ্বোধন। এরই ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নবতর স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের সংযোজন। উপমহাদেশের পরিস্থিতির বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে হলেও একটি স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীর নবতর পদচারণা শুরু হয়। শতাব্দীর ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় দোদুল্যমান মনে হলেও দুঃসাহসিকতার অভিধায় উচ্চকিত এক নব অভিযাত্রা এটি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলার ভ‚মিকা ছিল যে কোনো বিচারে গৌরবদীপ্ত। বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তান আন্দোলনকারী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নিখিল ভারত মুসলিম লীগেই জন্ম দেয়নি, পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপকও ছিলেন বাংলার কৃতী সন্তান শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। ব্রিটিশ-ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাংলায় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন বাংলার মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভাই সেই চরম দিনগুলোতে পাকিস্তান আন্দোলন কায়েদে আজমের হাতকে সর্বাধিক শক্তিশালী করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন দেখা গেল এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বাংলার স্থান হয়ে গেল অত্যন্ত সঙ্কুচিত। প্রশাসন, সেনাবাহিনী, ব্যবসায়-বাণিজ্য সর্বত্রই তাদের এই দুর্বল অবস্থানে বাঙালিদের কারো কারো মনে যদি অভিমান সৃষ্টি করে থাকে, তবে তাকে অস্বাভাবিক বা অসঙ্গত বলা যাবে না।
পাকিস্তান আন্দোলনে বাংলার বিশিষ্ট ভূমিকার একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায়- পরাধীনতার অভিশাপ বাংলাকেই সবচাইতে অধিক সহ্য করতে হয়। আর যেহেতু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ার পূর্বে এ দেশের শাসনকর্তা (নবাব) ছিলেন মুসলমান, তাই ইংরেজ রাজত্বে বাংলার মুসলমানদেরই সর্বাধিক বৈষম্য-বঞ্চনা ও শোষণ-নিপীড়নের শিকার হতে হয়। ইংরেজদের এসব শোষণ-নিপীড়নে সহযোগী শক্তি হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা দেয় এক শ্রেণীর হিন্দুকে। তাই ব্রিটিশ-হিন্দু যৌথ শোষণ-নিপীড়নের যন্ত্রণা বাংলার মুসলমান যতটা সহ্য করেছে, ততটা অন্যেরা করেনি। বাংলাদেশে পাকিস্তান আন্দোলন বিশেষ জনপ্রিয় হওয়ার এটা ছিল বড় কারণ। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার এই প্রেক্ষাপটেই পাকিস্তান থেকে বাংলার মুসলমানদের পাওয়ার আশা ছিল বিরাট। কিন্তু তুলনামূলকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে তারা পেয়েছে যথেষ্ট কম।
এই কম পাওয়ার অবশ্য অন্য কারণও ছিল। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা প্রদেশ) হিসেবে যে অঞ্চল চিহ্নিত হয়, তা ইংরেজদের চক্রান্তে বিভাগপূর্বে আমলে ছিল একটি চরমভাবে অবহেলিত অনুন্নত অঞ্চল। মুসলিম শাসনামলে বাংলায় ছিল গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, মাঠ ভরা সবুজের সমারোহ। তা দুঃশাসন ও সেখানে নিঃশেষ হয়ে যায়। যে বাংলার মসলিন সমেত গোটা বস্ত্রশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রয় হতো- সেই বাংলার বস্ত্রশিল্প একেবারে ধ্বংস করে দেয়া হলো। দুনিয়ার সেরা পাট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পূর্ববঙ্গ বিখ্যাত হওয়া সত্তে¡ও পাটকল সব পরিকল্পিতভাবে স্থাপন করা হলো ভাগিরথী নদীর পশ্চিম তীরে। পূর্ববঙ্গকে পরিণত করা হয় কলিকাতাসহ হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গের হিন্টারল্যান্ডে।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় দেখা গেল, নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনসংখ্যার মেজরিটি অংশ পূর্ববঙ্গের হলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থান অনেক পেছনে। ব্রিটিশ শাসনকালেই পাঞ্জাবে গড়ে উঠেছিল একটি অতি উন্নত সেচ ব্যবস্থা, যার ফলে সুফল পড়েছিল সেখানকার কৃষির ওপরে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্নে ১৩টি বস্ত্রকলের এবং ১১টি চিনিকলের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই ছিল পশ্চিমাঞ্চলে। এ ছাড়া সরকারি প্রশাসনযন্ত্রে অবাঙালি মুসলমানদের অবস্থা বাঙালি মুসলমানদের অবস্থা থেকে পূর্ব থেকেই উন্নত ছিল। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় প্রশাসনে প্রথম দিকে তাদের প্রভাব ছিল প্রবল। সেনাবাহিনীতেও একই অবস্থা। উপমহাদেশের বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশ থেকে মোহাজের হিসেবে আগত-মুসলমানদের অনেকেই শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কারিগরি ক্ষেত্রে অগ্রসর থাকায় এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব গোড়া থেকেই অধিক অনুভূত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে এই বৈষম্য নিয়েই পাকিস্তানের যাত্রা শুরু হয়। এ সবের ফলে উভয় অঞ্চলের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়া ছিল প্রায় অবশ্যম্ভাবী।
পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের মাতৃভাষার পার্থক্য পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের পার্থক্যকে বাড়িয়ে তুলতে সর্বাধিক সাহায্য করে। সেটা হলো উভয় অঞ্চলের মধ্যেকার বিরাট ভৌগোলিক ব্যবধান। প্রায় পনের শত বাইশ মাইল শত্রæভাবাপন্ন দেশের দ্বারা বিছিন্ন দুটি পৃথক ভূখন্ডের সমবায়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের নজির বিশ্ব ইতিহাসে ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। একাজ এমনিতেই ছিল দুরূহ এবং প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। ভূখন্ড, ভাষা, আবহাওয়া প্রভৃতি বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পার্থক্য সত্তে¡ও দু’অঞ্চলের মধ্যে বন্ধন অটুট রাখতে পারত, যা তা হলো ইসলাম। অর্থাৎ, ইসলামের বাস্তব অনুসরণ। দুঃখের বিষয় পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ইসলামের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারে যতটা উৎসাহী ছিলেন, ইসলামের সাম্যভ্রাতৃত্ব ও সুবিচারের নীতি প্রতিষ্ঠায় ততটা উৎসাহ কখনো বোধ করেননি। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পাকিস্তানে ইসলামের ন্যায়নীতি কায়েম করা হবে বলে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রæটি দেয়া হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা এমনিতেই যথেষ্ট সুকঠিন কাজ। তদুপরি পাকিস্তানের মতো দুটি বিচ্ছিন্ন ভূখন্ড ভিত্তিক রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার জন্যও প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট প্রজ্ঞাবান ও ত্যাগী নেতৃত্বের, পাকিস্তানে যার অভাব ছিল অত্যন্ত বেশি। পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ দুটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন পৃথক ভূখন্ড নিয়ে রাষ্ট্র গঠন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে যে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, সে সম্পর্কে সস্তা গলাবাজি যত করেছেন, উপমহাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে এ ঐতিহাসিক পদক্ষেপ টিকিয়ে রাখার জন্য একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তার তুলনায় যথেষ্ট কম। একাত্তর-পূর্ববর্তী (অবিভক্ত) পাকিস্তানের মতো চ্যালেঞ্জিং রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা তো দূরের কথা, একটি সাধারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পচিালনার যোগ্যতার প্রমাণও তাঁরা দিতে পারেননি- এ এক ঐতিহাসিক সত্য। ফলে কায়েদে আজমের মতো বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের তিরোধানের পর থেকেই পাকিস্তানে যে নেতৃত্ব সঙ্কট শুরু হয়, তা থেকে জাতি কখনো মুক্ত হতে পারেনি।
এগুলো ছিল যেখানে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সেখানে পাকিস্তানের বৈদেশিক সমস্যা ছিল গোড়া থেকেই কঠিনতর এবং এক হিসাবে জটিলতর। অবতীর্ণ ধর্মাদর্শের যে সর্বশেষ ও আধুনিকতম রূপ ইসলাম নামে পরিচিত, তা আধুনিকতম হওয়ার সুবাদে পূর্ববর্তী ধর্ম স¤প্রদায়সমূহের কোপ দৃষ্টিতে পতিত হয়েছে স্বাভাবিক কারণেই। ইসলামের প্রসার ঘটেছে ঐসব ধর্মাদর্শের ব্যর্থতার পটভ‚মিতে। তাই তাদের ইসলামবিরোধী ক্ষোভ, বিদ্বেষ ও মর্মবেদনার যৌথ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ইতিহাসের বহু ঘটনাতেই। যেহেতু পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল আধুনিক বিশ্বের অন্যতম মুসলিম নবজাগরণ আন্দোলনের ফলশ্রæতি, তাই ক্রুসেডের উত্তরসূরী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্তরসূরী ভারতীয় স¤প্রসারণবাদ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক অলিখিত আঁতাতে আবদ্ধ হয় গোড়া থেকেই। উনিশশো সাতচল্লিশের নেহেরু-মাউন্টব্যানের মাখামাখি আদপেই ছিল দুটি কায়েমি স্বার্থের আঁতাত, শুধু দুজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব মাত্র নয়। এ আঁতাতের প্রথম ফলশ্রæতিতে কায়েদে আজমের আশীর্বাদপুষ্ট বসু-সোহরাওয়ার্দীর সার্বভৌম বাংলার পরিকল্পনাকে গান্ধীর এই অন্যায় প্রস্তাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে শরৎচন্দ্র বসু এক পত্রে তাঁকে লেখেন : ‘যে কংগ্রেস একদা মহান জাতীয় প্রতিষ্ঠান ছিল, তা দ্রæত একটি হিন্দু স¤প্রদায়ের প্রতিষ্ঠানের পরিণত হতে চলেছে দেখে আমি মর্মাহত’ (In Retrospection, Abul Hashim. P. 161)।
১৯৪৭ সালের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা যে বিট্রিশ সমর্থনও লাভ করেছিল, সে খবর হয়তো অনেকেই রাখেন না। এ বিষয়ে কমরুদ্দিন আহমদ বলেন, Jinnah, however, soon found out that the idea of partitioning Panjab and Bengla was engineered by Lord Mountbatten and it was futile to convince the leaders of Congress or sikhs regarding the danger of partitioning the provinces. Mountbatten later on admitted his part in his address to Royal Empire Soitry in London on 6th October 1948Õ (Vide- A Socity-Political Hisory of Bengla and the Birth of Bangladesh'- Kamruddin Ahmad, 4th edition, 1975. P. 83).
এই বিষয়ে পন্ডিত নেহেরুর ভূমিকা ছিল আরো তাৎপর্যপূর্ণ। তদানীন্তন কংগ্রেস নেতা কুমিল্লার আশরাফদ্দিন চৌধুরীর এক পত্রের জবাবে ১৯৪৭ সালের মে মাসে নেহেরু তাঁকে যে চিঠি লেখেন, তাতে তিনি বলেন: ‘অখন্ড ভারতের নীতিকে আমরা জলাঞ্জলি দিয়েছে, এ কথা সত্য নয়। তবে আমরা কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। ভারত বিভাগ মেনে নেবো আমরা একটি শর্তে যে, বাংলা ও পাঞ্জাবকে বিভক্ত করতে হবে। কারণ একমাত্র এ পথেই অখন্ড ভারত পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে।’ (‘রাজবিরোধী আশরাফউদ্দিন আহমদ চৌধুরী’ -জামালুদ্দিন আহমদ চৌধুরী)।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি ব্রিটিশ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের এই দৃষ্টিভঙ্গির ভয়াবহ প্রতিফলন ঘটেছিল কুখ্যাত র্যাডক্লিফ রোয়েদাদে, যার মাধ্যমে বেশ কতকগুলো মুসলিম সংখ্যগুরু জেলা অন্যায়ভাবে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। মোটের উপর পাকিস্তান যাতে আঁতুড় ঘরেই ধ্বংস হয়ে যায় তার জন্য ব্রিটিশ ও কংগ্রেস কারোরই চেষ্টার কোনো ক্রটি ছিল না। এই যেখানে বাস্তব আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, সেখানে পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের যে প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি ও সাবধানতার পরিচয় দানের প্রয়োজন ছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে তা তাঁরা দিতে পারেননি এবং তাঁরা এ ব্যর্থতার পরিচয় দেন বলতে গেলে গোড়া থেকেই।
সর্বপ্রথম যে ক্ষেত্রে পাকিস্তানি শাসকবর্গের এই ব্যর্থতার প্রমাণ প্রকটভাবে ধরা পড়ে, তা হলো রাষ্ট্রভাষা। যে কোনো জনগোষ্ঠীর উন্নতি ও বিকাশের জন্য মাতৃভাষাই যে শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম, এ স্বাভাবিক সত্যের স্বীকৃতি রয়েছে পবিত্র কুরআনও। পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলার দাবিকে অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানি শাসকবর্গ চাইলেন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। উর্দু ভাষায় বিকাশে মুলসমানদের অবদান ঐতিহাসিক এবং ইসলামী উপাদানেও উর্দু ভাষা যথেষ্ট সমৃদ্ধ। সেই সুবাদে বাংলার বহু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বই ছিলেন উর্দুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই শ্রদ্ধাশীলতার সুযোগ নিয়ে মুদ্রা, মানিঅর্ডার, ফর্ম, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় দলিলপত্রে ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দু ব্যবহারের প্রচেষ্টা হলো। পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিসে কমিশনের ইংরেজ সচিব মি. গুডইন স্বাক্ষরিত একটি সার্কুলার সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরিত হয়। তাতে কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষার যে বিষয়সূচি ছিল, তার মধ্যে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, উর্দু, হিন্দি, এমন কি সংস্কৃত ও ল্যাটিনের মতো মৃত ভাষাও অন্তর্ভুক্ত ছিল- কিন্তু ছিল না পাকিস্তানের মেজরিটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা। বাংলার প্রতি এ ধরনের অবহেলার প্রতিবাদে সাতচল্লিশের সেপ্টেম্বরেই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ক্রমেই এ আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। প্রথম প্রথম কর্তৃপক্ষ এ আন্দোলনকে রাষ্ট্রদ্রোহীদের কারসাজি বলে বুঝতে চেষ্টা করেন, কিন্তু আন্দোলন জোরদার হলে তার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। আন্দোলনকারীদের মূল দাবি ছিল বাংলাকে উর্দুর সঙ্গে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদি ও শিক্ষার মাধ্যম করতে হবে বাংলা ভাষা। ১৯৪৮ সালের মার্চ পাকিস্তানের অফিসাদি ও শিক্ষার মাধ্যম এসে একটি জনসভায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ কনভোকেশনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উপরে বক্তৃতা দেন। পরবর্তীতে তিনি ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকেও তাদের দাবির বিরোধিতা করেন। নেতৃবৃন্দ কিন্তু তাঁদের বক্তব্যে অটল থাকেন। ঢাকা ত্যাগের পর থেকে ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বরে তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কায়েদে আজম আর কোনো কথা বলেছেন বলে জানা যায়নি। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের লিখিত ‘সাংবাদিকের রোজনামচা’ গ্রন্থ পাঠে জানা যায়- কায়েদে আজম পরবর্তীকালে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তাঁর ভুল বোঝতে পেরেছিলেন। তবে কায়েদে আজম তাঁর ভুল বুঝলেও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রধান মন্ত্রিত্বের আমলে পুনরায় বাংলা ভাষায় বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এ সময় বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলার তরুণ ছেলেরা ১৯৫২ সালে ভাষায় দাবি প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রসর হয়।
ভাষা আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বসূরী বলে অভিহিত করা হয়। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই পরবর্তীকালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, যা ১৯৭০ সালে স্বাধিকার আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে এবং আরো পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের কালো রাতে টিক্কা শাহীর বর্বর হামলার পরিণতিতে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে।
বাংলার দামাল ছেলেরা ঘটনার আকস্মিকতায় কিন্তু এতটুকু মুষড়ে পড়েনি, যেমন কর্তব্য নির্ধারণে এতটুকু ভুল করেনি বাংলার মুক্তিকামি জনগণ। একাত্তরের ৯ মাসের মুক্তিযদ্ধ যে কোনো বিচারে ছিল একটি অসম যুদ্ধ। একটি দুর্র্ধষ বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জনতার প্রতিরোধের পেছনে জনগণের শক্ত মনোবল না থাকলে এ যুদ্ধ অঙ্কুুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত। তা যে হয়নি তার কারণ জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছে তাদের এ সংগ্রাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, তারা এও জানত, জুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনো সংগ্রামে আল্লাহর মদদ অবশ্যম্ভাবী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ। যারা এ যুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, তারা ছাড়াও প্রায় ৯ কোটি মানুষ সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা পর্যায়ে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কেউ খাবার দিয়ে, কেউ আশ্রয় দিয়ে, কেউ অর্থ দিয়ে, কেউ অস্ত্র দিয়ে, কেউ পরামর্শ দিয়ে, কেউ শত্রæর অবস্থায় সম্পর্কে গোপন খবরাদি সরবরাহ করে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এই যুদ্ধে শামিল থাকার সন্দেহে বাংলার কত মানুষ যে পশ্চিমা বাহিনীর অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয়েছে। কত বাড়িঘর, দোকানপাট ধ্বংস হয়েছে, কত লোক গৃহহারা হয়ে স্বদেশে পরবাসী হয়ে বনে-জঙ্গলে রাতে পর রাত কাটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
এই যুদ্ধের কারণে যারা দেশে ত্যাগ করে বিদেশের মাটিতে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেষ্টা করেছে, তাদেরও অনেকেই বিদেশ-বিভুঁইয়ে শান্তিতে থাকতে পারেনি। যুদ্ধের গতিধারাকে বিদেশি শক্তি বারবার নিজেদের স্বার্থে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করেছে, বহু মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দী ও হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে, তবুও চরম ধৈর্য সহকারে সব কষ্ট স্বীকার করে হলেও তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। বিদেশি জমিনে বিদেশি শক্তির মনমতো লোকদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে, বৈষম্য করা হয়েছে শত শত মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে, তবুও মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহে স্তব্ধ করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়া দেয়া হতো, যে জাতি তার ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে না, আল্লাহও তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না। আল্লাহর এই বাণীর আলোকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৯টি মাস ধরে লড়ে যান। অবশেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে এলো তাদের ঈস্পিত দিন- যেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় স্বীকারের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হলো স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। দুঃস্বপ্ন ঘেরা অমানিশার অবসানে মুক্তির আলোয় জলমল করে উঠল একটি জাতি।
লেখক: ভাষাসৈনিক ও ফিচার সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন