শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নৌকার ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৪ এএম

দেশে এক সময় অযান্ত্রিক ও শব্দহীন ছোট-বড় নৌকাই ছিল যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন। সত্তুর এবং আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই বাহনটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্ষায় গ্রাম-গঞ্জের আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, হাট-বাজার, বেড়াতে যাওয়া এমনকি বিয়ে-সাদীর বর-কনের যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে নৌকাই ছিল প্রধানতম ভরসা। মালামাল বহন করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য বাহন ছিল পালতোলা কিংবা গুণটানা বড় বড় নৌকা। পদ্মা-মেঘনাসহ দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে নানা রঙের পালতোলা নৌকার অপূর্ব বর্ণীল দৃশ্য চোখে পড়ত। কালক্রমে সময়ের প্রয়োজনে এবং সময় বাঁচাতে স্থলপথে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠায় ধীর গতির নৌকার ব্যবহারও কমে আসে। দ্রুতগতির এ যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে অযান্ত্রিক নৌকায় ইঞ্জিন যুক্ত হলেও এর ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে। তবে এখনো বর্ষায় দুর্গম অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর বাহন হিসেবে বিবেচিত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নৌকার ছোট-বড় হাট বসে। সে হাটে হস্তচালিত কোষা নৌকাসহ বিভিন্ন ধরনের নৌকা বিক্রি হতে দেখা যায়। ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়ায় প্রতি বর্ষায় নৌকার হাট বসতে দেখা যায়। নৌকার ছোট-বড় সাইজ অনুযায়ী, গড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি হয়। উত্তরবঙ্গসহ দেশের অন্যন্য স্থানেও নৌকার হাট বসে। দেখা যাচ্ছে, স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রসার লাভ করলেও নৌকার অপরিহার্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকার ব্যবহার অনস্বীকার্য হলেও নৌপথ সংকীর্ণ হওয়ায় তার ব্যবহার কমে গেছে। একসময় প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ থাকলেও তা কমে পাঁচ-ছয় হাজারে নেমেছে। এতে নৌকার ব্যবহার কমলেও প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। এক সময় নদীমাতৃক বাংলাদেশের সৌন্দর্য দেখানোর জন্য বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের নৌভ্রমণ করানো হতো। নৌবিহারে বাংলাদেশের সৌন্দর্য দেখে তারা বিমোহিত হতেন। নদ-নদীর নাব্য হ্রাস এবং পরিবেশ দুষণের কারণে এখন আর বিদেশি অতিথিদের নৌভ্রমণে দেখা যায় না। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ধীরগতির নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। নৌকার ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে। স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও দ্রুতগতির অনিবার্যতা স্বীকার করতেই হবে। তারপরও নৌপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে নৌপথই বিশ্বের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে। আমাদের আভ্যন্তরীণ যোগযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও নৌকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। মালামাল পরিবহনের পাশাপাশি ভাসমান হাট ও পর্যটনের ক্ষেত্রে নৌকা ব্যবহার করা হচ্ছে। বৃটিশ আমল থেকে চলে আসা বরিশালের বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে ধান-চালের ভাসমান হাট এখনও রয়েছে। দেশের অন্যান্য স্থানেও নৌকার এ ধরনের ভাসমান হাট বসে। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলেও নৌকায় ফল-ফলাদি ও বিভিন্ন ফসলের হাট বসে। এসব হাট আমাদের ঐতিহ্যের ধারক। থাইল্যান্ড এখনও তার নৌকার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। পর্যটকরা নৌকায় চড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে। ইটালির ভ্যানিসে ইঞ্জিনবিহীন হস্তচালিত নৌকার মাধ্যমে পর্যটকদের ঘুরিয়ে শহর দেখানো হয়। আমাদের দেশে রাঙ্গামাটি, সিলেট ও বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় নৌকার মাধ্যমে পর্যটকদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করানোর জন্য নৌকা ব্যবহার করা হয়। সিলেটের রাতারগুলের পানিতে অর্ধনিমগ্ন বন এমনকি সুন্দরবনের ভেতরের অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নৌকায় চড়ে পর্যটকরা ঘুরে বেড়ান। বর্ষায় কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নৌকা ছাড়া কল্পনা করা যায় না। এ অঞ্চলের মূল বাহন হচ্ছে নৌকা। মিঠামাইন, ইটনা ও অষ্টগ্রামে হাওরের বুকচিরে সাবমারসিভ সড়ক নির্মিত হওয়ায় তা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বর্ষায় সড়কের দুই পাশে অথৈ পানির যে অপূর্ব দৃশ্য সৃষ্টি হয়, তা দর্শনের জন্য হাজার হাজার পর্যটক সেখানে ছুটে যায়। এ সময় হাওর ঘুরে বেড়ানোর জন্য নৌকা অন্যতম বাহনে পরিণত হয়। পুরো হাওর অঞ্চলকে ঘিরে সরকার আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে পর্যটনের ক্ষেত্রে নৌকা হয়ে উঠবে প্রধানতম আকর্ষণীয় বাহন। দেশের অন্যন্য পর্যটন কেন্দ্রে এবং লেক ঘুরে বেড়ানোর জন্য নৌকা ব্যবহার করা হচ্ছে।

যেকোনো দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং তা ধরে রাখার দায়িত্ব সরকারসহ সকলের। স্থলপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো দ্রুতায়িত হলে নৌকার ব্যবহার আরো কমবে। তবে এর ব্যবহারের উপযোগিতা কমেনি। নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব এ বাহনের ঐতিহ্য ধরে রাখা আমাদের কর্তব্য। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, মানুষ যাতায়াত, মালামাল পরিবহন কিংবা বিনোদনভ্রমণে আরাম ও নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে নিরাপদ ও দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা অধিকতর প্রাধান্য পাবে। তারপরও নৌকার ব্যবহার ও উপযোগিতা থাকবে। আমাদের ঐতিহ্য হিসেবেই নয়, যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবেও নৌকার ব্যবহার বজায় থাকবে। এ কারণে, নৌপথ সচলে নদ-নদীর নাব্য বৃদ্ধির কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র এবং আকর্ষণীয় লেক ও জলাশয়ে নৌকার ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। এতে ভ্রমণপিপাসুরা যেমন নৌভ্রমণে আগ্রহী হবে, তেমনি পর্যটন খাতও সমৃদ্ধ হবে। নৌকার ঐতিহ্যও ধরে রাখা যাবে। যেসব এলাকায় নৌকায় ভাসমান হাট বসে সেগুলো সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে হবে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন