বুড়িগঙ্গা খনন করে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি দূষণমুক্ত করতে নেওয়া প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও নদীর প্রাণ ফেরেনি। হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হলেও যমুনা নদী থেকে নতুন ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেমে পানি প্রবেশ করার কথা থাকলেও এক ফোটা পানিও আসেনি। ৯৪৪ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় তিন দফায় বাড়িয়ে ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দীর্ঘ ১১ বছরে প্রকল্পের হাজার কোটি টাকা লোপাট হলেও বাড়েনি বুড়িগঙ্গার পানিপ্রবাহ, কমেনি নদীর দূষণ। বরং দূষণ বেড়ে বুড়িগঙ্গা এখন প্রাণহীন এক মৃত নদী। দীর্ঘ ১১ বছর পর বলা হলো এই প্রকল্পের পরিকল্পনায় ভুল ছিল। বুড়িগঙ্গার খনন নিয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। গত ২৭ ডিসেম্বর সংসদ ভবনে এ কমিটির এক বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বুড়িগঙ্গার তলদেশে জমাটবাধা পলিথিন দ্রæত অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন বুড়িগঙ্গা খনন, দখলমুক্তকরণ এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে লোটপাটের জন্য। হাজার কোটি টাকা লোটাপাট হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং দিন দিন দখল ও দূষণ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং নদীও মৃত্যুবরন করছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, নদী খনন, দখলমুক্তকরণ এসব প্রকল্প নেওয়া হয় লুটপাটের জন্য। নদী খননের নামে হাজার কোটি টাকা লোপাট হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে বুড়িগঙ্গা দখলমুক্ত করার জন্য উচ্ছেদ অভিযান চলে। তবে এসব কাজ সমন্বয়হীন, অপরিকল্পিত হচ্ছে। স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হচ্ছেনা। নদী দখলমুক্ত করার নামে অবৈধ দখলদারদের আরও বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। যথাযথভাবে চিহ্নিত না করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে অতি সু²ভাবে দখলদারদের বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এতে নদী তার চরিত্র হারিয়ে শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদী এখন একটা সরু খালে পরিণত হয়েছে। তাই আগে নদীকে তার প্রকৃত সীমানা ফিরে দিতে হবে। তা না হলে খনন করেও কোন লাভ হবে না।
বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশ খনন করে এর পানিপ্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি নদীদ‚ষণমুক্ত করতে সরকার ৯৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১০ সালে একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের কাজ যথাযথভাবে শেষ হয়নি। যমুনা নদী থেকে নতুন ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেমে পানি প্রবেশ করার কথা থাকলেও তার কিছুই হয়নি। ২০১৩ সালে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারকাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয় ৯৪৪ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের জুনে যেনতেনভাবে এর কাজ শেষ করা হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি যখন ২০১০ সালে হাতে নেওয়া হয়, তখনই এর পরিকল্পনায় ভুল ছিল। কোনো ধরনের গাণিতিক মডেল সমীক্ষা ও বেজলাইন সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছিল। এ ছাড়া ভৌত মডেল সমীক্ষাটি শুধু প্রধান উৎসমুখ থেকে পুংলী নদীর ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় টঙ্গী খাল ও বুড়িগঙ্গার অফটেক পানিপ্রবাহের যথার্থতা যাচাই করা হয়নি।
আইএমইডির সরেজমিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদীতে বর্জ্য পড়তে পড়তে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। অবৈধভাবে নদী দখল করে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। ওই সব শিল্পকারখানা থেকে আসা বর্জ্য নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলছে। এতে নদীর স্রোত দুর্বল হয়ে গেছে। এর ফলে নদীতে চর জেগেছে। কারখানার আবর্জনা ও কেমিক্যাল নদীতে পড়ে পানির রং পরিবর্তন করে দিচ্ছে। আইএমইডি বলেছে, যমুনা নদী থেকে নতুন ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেমে পানি প্রবেশ করার পথ প্রতিনিয়ত বালি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীর উৎস মুখে চরের সৃষ্টি হচ্ছে। জমি অধিগ্রহণে জটিলতা এবং ২২টি সেতুর কারণে প্রকল্পটির কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হয়নি।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা বলে ঘোষণা করেছে। সেই সাথে এই জীবন্ত সত্তার জীবন ফিরিয়ে দিতে গত বছর বিভিন্ন নির্দেশনাও দিয়েছে আদালত। বুড়িগঙ্গা নদীতে পতিত ওয়াসার সকল সুয়ারেজ লাইন সরাতে হাইকোর্ট ৬ মাস সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবেদন অনুসারে বুড়িগঙ্গায় এখন ৬৮টি সুয়ারেজ লাইন রয়েছে। এর বাইরেও বুড়িগঙ্গার দুই পাড়ে জরিপ করে যদি সুয়ারেজ লাইন পাওয়া যায়, তাহলে সেগুলো ৭ জানুয়ারির মধ্যে বন্ধ করে বিআইডব্লিউটিএকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া রাজধানীর শ্যমপুর ও পোস্তগোলা এলাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে থাকা ২৭টি অবৈধ ডায়িং কারখানা ও বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধ করতেও পরিবেশ অধিদফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে জমাটবাধা পলিথিন অপসারণ করার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৭ ডিসেম্বর এক বৈঠকে কমিটি গ্রেভ ড্রেজার সংগ্রহ করে জরুরি ভিত্তিতে এ কার্যক্রম শুরু করার জন্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহবান জানিয়েছে। এছাড়া নদী তীরে অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম অব্যাহত রাখার কথা বলেছে কমিটি। কমিটির সভাপতি মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, শাজাহান খান, রনজিত কুমার রায়, মাহফুজুর রহমান, ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল, মো. আছলাম হোসেন সওদাগর এবং এস এম শাহজাদা অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বিভিন্ন কার্যক্রম এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এর সকল উন্নয়ন কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
পরিবেশবিদরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা হলো ঢাকার প্রাণ। এই বুড়িগঙ্গা যদি প্রাণহীন থাকে তাহলে ঢাকার অস্তিত্ব চরম সঙ্কটের মুখে পড়বে। তাই ঢাকাকে বাঁচাতে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হবে। সেই সাথে বাঁচাতে হবে তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষানদীকে। বুড়িগঙ্গা নদীতে পানির প্রবাহ বাড়াতে পারলে কৃষি সেচের পানি পাওয়া যাবে। নদীপথে সহজে যাতায়াত করা যাবে। সারা বছর মাছ পাওয়া যাবে। মাছ চাষ করাও সম্ভব হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন