বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষায় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও এর মরণ কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। দূষণ আর দখলে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা দিন দিনই প্রাণহীন জীর্ণশীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। গত ১২ বছরে বুড়িগঙ্গা বাঁচানোর নামে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের মাধ্যমে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে নদীর তলদেশ থেকে পলিথিন পরিষ্কার, ওয়াকওয়ে, সীমানা পিলার, গ্রিনেজ, ইকোপার্ক প্রকল্প ইত্যাদি। এসব প্রকল্পেও কোনো কাজ হয়নি। দূষণ আর দখল এখনো চলছে। দূষণে নদীর পানি কালো বিবর্ণ হয়ে গেছে। নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। মাছ বা অন্যান্য জলজপ্রাণী এ নদীর পানিতে বেঁচে থাকতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে সব প্রকল্প নেয়া হয়েছে তা নদীকে বাঁচাতে নয়, উল্টো নদীকে ধ্বংস করা হয়েছে। সীমানা পিলার দিয়ে অবৈধ দখলদারদের বৈধতা দেওয়া হয়েছে, নদীকে খালে পরিণত করা হয়েছে। নদীর সঙ্গে যুক্ত ছোট ছোট খালগুলো ভরাট করা হয়েছে।
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরের বছর বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ভুল পরিকল্পনার কারণে একযুগের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়নি। যেসব কাজ করা হয়েছিল, সেগুলোও দৃশ্যমান নয়। বুড়িগঙ্গা নদীর পানির প্রবাহ দৃশ্যমান করার জন্য যেভাবে নদী খননের কথা ছিল, সেই নকশায় ছিল গলদ। জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে নানা বাধায় তা অগ্রসর হয়নি। বুড়িগঙ্গা নদী উদ্ধার করতে গিয়ে ২২টি সেতু ক্ষতির মুখে পড়বে তাই প্রকল্পের কাজসম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটিতে গিয়ে ঠেকলেও বুড়িগঙ্গার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এ প্রকল্প চলমান অবস্থার মধ্যেই ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর অবৈধ দখল বন্ধ করতে ৪ বছর আগে ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) আলাদা একটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের তীরভূমি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করা। কিন্তু এ প্রকল্পেও ভুল পরিকল্পনার কারণে পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে। ২ বছর পর এসে ভুল পরিকল্পনা সংশোধন করে এখন নতুন করে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পটির কাজ শেষ না হয়েও খরচ বেড়েছে, নতুন করে ঢাকার চারটি নদী রক্ষার প্রকল্পের ব্যয়ও অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় পরিকল্পনা কমিশন আপত্তি তুলেছে। সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদন না দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে ৮৫০ কোটি টাকার প্রকল্পটি কীভাবে বেড়ে ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকায় গেল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে এর তলদেশ থেকে পলিথিন ওঠানো, পাড় থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কিছুদিন পর আবার তা বন্ধ হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কোনো সংস্থার একার পক্ষে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। পরিবেশ, নৌপরিবহন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং এসব মন্ত্রণালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে কাজ করতে হবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, মন্ত্রণালয়টির নেতৃত্বে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নদীর দখল-দূষণ রোধে একটি টাস্কফোর্স রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা কমিটিতে রয়েছেন। এ কমিটি নিয়মিত বৈঠকও করে। দাবি করা হচ্ছেÑ এ কমিটি নদনদী রক্ষায় নানা পদক্ষেপও নিয়েছে। তবে এতেও বুড়িগঙ্গার পানি দূষণমুক্ত হচ্ছে না। বুড়িগঙ্গায় প্রাণপ্রবাহও ফিরছে না। অভিযোগ রয়েছে কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও অপরিকল্পিত প্রকল্পের কারণে নদী রক্ষা ও দূষণ বন্ধ করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হচ্ছে সরকারকে।
বুড়িগঙ্গা নিয়ে কেবল আশার কথাই শোনা যায়। বাস্তবে এ নদীর তীরে গেলে ওর মরণদশা দেখে বুক হু হু করে ওঠে। পরিবেশবাদীরাও এ নিয়ে হতাশ। বর্ষায় বুড়িগঙ্গা কিছুটা ফুলেফেঁপে উঠলেও শীতে ফের বিবর্ণ হয়ে যায়। চরম দূষণ ছাড়া আর কিছুই তখন দেখা যায় না। গত কয়েক বছরে বুড়িগঙ্গা রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেই বলেই নদীটি এখন মৃত অবস্থায় রয়েছে। বলা হতো হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি চলে গেলে বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত হবে। ট্যানারিগুলোকে সাভার ধলেশ্বরীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো, কিন্তু বুড়িগঙ্গার কোনো উন্নতি হলো না। বরং বুড়িগঙ্গার দূষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর পানি ময়লা-আবর্জনায় চরমভাবে দূষিত হয়ে কালো রং ধারণ করেছে।
ঢাকায় প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস। প্রায় সবার পয়ঃবর্জ্যই পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। এসব ড্রেনেজ ব্যবস্থার দায়িত্বে রয়েছে ওয়াসা এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি নদী ও খালে ফেলা হচ্ছে। যা গিয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার প্রধান ৪টি নদী (বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু) এগুলোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ৭০০০ শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যে নিষ্কাশনের জন্য নিজস্ব ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নেই। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশ্রিত তরল বর্জ্যরে পরিমাণ ৬০ হাজার কিউবিক মিটার। এ ছাড়া ঢাকা শহরের লোকালয় থেকে প্রতিদিন সৃষ্ট আবর্জনার পরিমাণ ৪৫ হাজার টন। যার ৮০ শতাংশ মিশে বুড়িগঙ্গায় পানিতে। প্রতিদিন ১২ হাজার কিউবিক মিটার পয়ঃবর্জ্য বুড়িগঙ্গায় মিশ্রিত হয়। দৈনিক গড়ে ৫ হাজার যান্ত্রিক নৌযান চলাচল করে বুড়িগঙ্গা দিয়ে। যাদের সব ধরনের বর্জ্যরে শেষ ঠিকানা হলো বুড়িগঙ্গা। শিপরিপ্রেয়ার ইন্ডাস্ট্রিগুলোর বর্জ্যে ডাম্প করা হয় বুড়িগঙ্গায়। বুড়িগঙ্গায় এখন কোনো মাছের আবাস নেই বললেই চলে। এ নদীর পানিতে এখন অক্সিজেনের পরিমাণ জিরো। তাই বিশেষজ্ঞরা একে নদী না বলে সেপটিক ট্যাংক বলেই অবিহিত করছেন।
কেন বুড়িগঙ্গা রক্ষার কোনো প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনিÑ জানতে চাইলে এ নদী বাঁচানোর চেষ্টায় নিয়োজিত সংস্থা ওয়াটার কিপারস বাংলাদেশের সমন্বয়কারী ও বাংলাদেশে পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল ইনকিলাবকে বলেন, বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর নামে এর আগে বেশ কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ওয়াকওয়ে, সীমানা পিলার, গ্রিনেজ, ইকোপার্ক প্রকল্প ইত্যাদি। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে; কিন্তু বুড়িগঙ্গার সামান্যতমও উন্নতি হয়নি। আসলে এসব প্রকল্প নদীকে বাঁচাতে নয়, উল্টো ধ্বংসের কাজ করছে। নদীকে খালে পরিণত করা হয়েছে। নদীর সঙ্গে যুক্ত ছোট ছোট খালগুলো ভরাট করা হয়েছে, হচ্ছে। যারা এই ধ্বংস রোধ করতে পারতেন, তারাই এর জন্য দায়ী।
তিনি বলেন, নদীকে বাঁচাতে আদালত যে আদেশ দিয়েছিলেন তাও ভুলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আদালতের আদেশ অনুযায়ী, নদী বাঁচাতে কাজ করবে নদী কমিশন। কমিশনকে শক্তিশালী করা এবং আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু নদী বাঁচাতে কাজ করছে অন্য সংস্থা। আদালতের আদেশ মানলেও বুড়িগঙ্গা বাঁচার কিছুটা সম্ভাবনা থাকে।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ঢাকার চারপাশে নদী রক্ষার জন্য যে নকশার ওপর ভিত্তি করে সীমানা পিলার বসানো হয়েছে, সেটি ঠিক হয়নি। নদীকে রক্ষার জন্য সীমানা পিলার নির্ধারণ করতে গিয়ে ঢাকার পাশে গাবতলী বিল, কাউন্দিয়া বিল, বিরুলিয়া বিল, আশুলিয়া বিল ও টঙ্গী বিল এ পাঁচটি বিল মেরে ফেলার আয়োজন করা হলো। এই পাঁচটি বিল বাঁচাতে হলে একটি পরিকল্পনা রাখতে হবে। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের আগেও অন্য একটি প্রকল্পের আওতায় ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল, কিন্তু সেসব ওয়াকওয়ে পরিকল্পনা করে নির্মাণ করা হয়নি। ফলে সেসব ওয়াকওয়ে এখন অব্যবহৃত।
পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এতদিন যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল সেগুলো নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করেছে। তাতে দুর্নীতি হয়েছে কি-না তা বলতে পারব না। বর্তমানে আমরা বুড়িগঙ্গাসহ দেশের নদনদী রক্ষায় একটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বুড়িগঙ্গাসহ দেশের প্রায় সব নদনদী দূষণমুক্ত হবে। সব নদীর প্রবাহ ফিরে আসবে।
বর্তমান সরকার দেশের নদ-নদীগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মাস্টার প্ল্যানের আওতায় ১৭৮টি নদী খনন ও পুনরুদ্ধার করে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চলাচলের উপযোগী করার কাজ শুরু করেছে। এ প্রকল্প ২০২০-২১ সালে শুরু হয়ে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
প্রথমাবস্থায়, ঢাকার চার পাশের নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদী খনন ও দূষণমুক্ত করা হবে। তা ছাড়া বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় চট্টগ্রাম থেকে আশুগঞ্জ হয়ে বরিশাল পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার খনন কাজ আগামী বছরে শুরু হবে। এ সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ঝিনাই, ঘাঘট, বংশী ও নাগদা নদী খনন ও বন্যা ব্যবস্থাপনায় ৪ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। তা ছাড়া ভারত, বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে দুই দেশের নৌ প্রটোকলভুক্ত ৪৭০ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়েছে। এর আওতায় কালনি ও কুশিয়ারা নদীর আশুগঞ্জ, জাকিগঞ্জ নৌপথের ২৮৫ কিলোমিটার এবং যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ-দৈখাওয়ার ১৮৫ কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন