বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য

শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিস

| প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:৪৪ এএম

শৈশবে যেসব অসুস্থতা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে ডায়াবেটিস মেলাইটাস তার মধ্যে অন্যতম। শরীরের কোষগুলোকে বেঁচে থাকতে ও জৈবনিক বিক্রিয়াগুলো পরিচালিত করতে শক্তি দরকার হয়; যা কোষগুলো গ্লুকোজ থেকে পায়। অগ্নাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোষের ভেতরে গ্লুকোজের প্রবেশ ও কোষে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। ইনসুলিন ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। যদি কোন কারণে দেহে ইনসুলিনের পরিমাণ কমে যায় বা ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে না পারে তবে গ্লুকোজ দেহকোষের বাইরে জমা হয় এবং একটা সময় পর এই গ্লুকোজ প্রসাবের সঙ্গে বের হয়ে আসতে থাকে।

অধিকাংশ শিশুর ডায়াবেটিস হয় অগ্নাশয়ের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে (টাইপ-১)। এক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলো অটোইমিউন প্রতিক্রিয়ার কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এছাড়া ইনসুলিন যথেষ্ট পরিমাণে নিঃসৃত হওয়ার পরও যদি তার মাধ্যমে কাজ করতে না পারে তাহলে ডায়াবেটিস (টাইপ-২) হয়। এসব রোগীর দেহে ইনসুলিনের বিপক্ষে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। আবার কিছু শিশু-কিশোর টাইপ-১ ও টাইপ-২ উভয় প্রকার ডায়াবেটিসেই একসঙ্গে আক্রান্ত হয়। এছাড়াও জিনগত কিছু ত্রুটির কারণে কম বয়সি শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিস হয়।

জীবনঘাতী জটিলতা এড়ানোর জন্য রোগের শুরুতেই চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে। আমাদের দেশে যেসব শিশু-কিশোর ডায়াবেটিসে ভোগে, তাদের বেশিরভাগই ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা নিয়েই প্রথমবার চিকিৎসকের কাছে যায়- এর ফল যথেষ্ট ভাল হয় না।

সঠিক চিকিৎসা ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ও পরিমিত পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারলে ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশু-কিশোররাও প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তাই এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকা জরুরি।

লক্ষণসমূহ:
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া এবং এর পরেই পানি পিপাসা পাওয়া, ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া তা সত্বেও ওজন বৃদ্ধি না হওয়া বা কমে যাওয়া, সাম্প্রতিক সময়ে রাত্রে প্রস্রাবের জন্য উঠা বা বিছানায় প্রস্রাব করা। যৌনাঙ্গের আশে-পাশে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হওয়া, ঘন ঘন ত্বকে জীবাণুর সংক্রমন হওয়া, দূর্বল লাগা, খেলা-ধুলায় অনাগ্রহ ইত্যাদি প্রধানতম লক্ষণ হতে পারে। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে লক্ষণগুলো সাধারণত: বেশ দ্রুত দেখা দেয়। অনেক সময় এতটাই দ্রুততরভাবে রোগ বিস্তার লাভ করে যে, চিকিৎসা শুরুর আগেই ডায়াবেটিস কিটোঅ্যাসিডোসিস নিয়ে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার হতে পারে। আর যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস বা অন্য কোন ধরণের ডায়াবেটিস হয় তাদের উপরিউক্ত লক্ষণগুলোর কোন তীব্রতা নাও থাকতে পারে বা অনুপস্থিত থাকতে পারে।

রোগ নির্ণয়:
সারা পৃথিবীব্যাপী ডায়াবেটিস শনাক্তকরণের জন্য যে ক্রাইটেরিয়া বা মানদন্ড ব্যবহার করা হয়, তাহলো আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের ডায়াবেটিস নির্ণয় ক্রাইটেরিয়া। ক্রাইটেরিয়া নিম্নরূপ:-

টেবিল:
রক্তের গ্লুকোজ: খালিপেটে রক্তের গ্লুকোজ রোগীর শ্রেণী বা অবস্থা প্রি-ডায়াবেটিস: ৫.৬ - ৬.৯ মিলিমোল/লিটার ডায়াবেটিস: ≥ ৭.০ মিলিমোল/লিটার

রক্তের গ্লুকোজ: ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ানোর ২ ঘণ্টা পর রক্তের গ্লুকোজ রোগীর শ্রেণী বা অবস্থা প্রি-ডায়াবেটিস: ৭.৮ - ১১.০০ মিলিমোল/লিটার ডায়াবেটিস: ≥ ১১.১ মিলিমোল/লিটার

রক্তের গ্লুকোজ: গ্লাইকোসাইলেটেড হিমোগ্লোবিন রোগীর শ্রেণী বা অবস্থা প্রি-ডায়াবেটিস: ৫.৭ - ৬.৪% ডায়াবেটিস: ৬.৫%

রক্তের গ্লুকোজ : যে কোন সময় রক্তের গ্লুকোজ (রক্তের গ্লুকোজ বৃদ্ধিজনিত সুনির্দিষ্ট লক্ষণ থাকলে) রোগীর শ্রেণী বা অবস্থা প্রি-ডায়াবেটিস: -------- ডায়াবেটিস: ≥ ১১.১ মিলিমোল/লিটার

ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং
টাইপ-১:
যে সমস্ত ছেলে-মেয়ের রক্তের গ্লুকোজ বৃদ্ধি পেয়েছে বা ডায়াবেটিসের সুনির্দিষ্ট লক্ষণ আছে, তাদেরকে গ্লুকোজ খেয়ে ডায়াবেটিসের পরীক্ষা (ওজিটিটি) করে ডায়াবেটিস আছে কিনা শনাক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্লাইকোসাইলেটেড হিমোগ্লোবিন কোন সহায়ক পরীক্ষা নয়।

টাইপ-২:
প্রি-ডায়াবেটিস ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস শনাক্তকরণের জন্য হিমোগ্লোবিন এ১সি একটি সহজসাধ্য পরীক্ষা। তবে টেবিল-এর যে কোন একটি পরীক্ষায় ব্যবহার করা যেতে পারে। শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং এর আওতায় আনার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচ্য।

১। যাদের দৈহিক স্থূলতা আছে (বিএমআই ৮৫ শতাংশের বেশি, বয়স ও লিঙ্গ বিবেচনায়; অথবা ১২০ শতাংশের বেশি) এর সাথে নিম্নলিখিত যে কোন দুইটি বিষয় উপস্থিত থাকতে হবে।

ক) বাবা-মা, ভাই-বোন কারো যদি টাইপ-২ ডায়াবেটিস থাকে।
খ) অতিরিক্ত ডায়াবেটিসের ঝুঁকিময় জনগোষ্ঠী (দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার, ভ‚মধ্য সাগরীয় ও আফ্রিকা)।
গ) ইনসুলিন অকার্যকারীতার শারীরিক লক্ষণ থাকলে (ঘাড়ে-গলায় কালোদাগ, উচ্চ রক্তচাপ, পলিসিস্টিক ওভারী সিনড্রোম, রক্তের লিপিডের অস্বাভাবিকতা ও ছোট আকৃতি নিয়ে জন্ম গ্রহন করা।
ঘ) মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে।

১০ বছর বয়স থেকে শিশু-কিশোরদের এর আওতায় আনতে হবে।

যাদের পরীক্ষার ফলাফল স্বাভাবিক হবে, তাদেরকে প্রতি তিন বছরে একবার করে পরীক্ষাটি করতে হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষা (হিমোগ্লোবিন এ১সি)

ডায়াবেটিস নির্ণয়ের প্রচলিত পরীক্ষাগুলো সর্ম্পকে আমাদের মোটামুটি জানা হয়েছে। চিকিৎসকগণ প্রয়োজন মত সকালে নাস্তার আগে, নাস্তার দু’ঘন্টা পর বা দিনের যে কোন সময় এবং বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ ২০০-৩০০ মিলিলিটার পর্যন্ত পানিতে মিশিয়ে পান করানো এবং এর আগে ও ২ ঘন্টা পরে রক্ত নিয়ে তাতে গুকোজ (শর্করা) এর পরিমান দেখে কোন লোকের ডায়াবেটিস আছে কিনা তা দেখেন। একই সাথে প্রস্রাবে গ্লুকোজ যায় কিনা তাও দেখা হয়। এক সময় প্রস্রাবে গ্লুকোজ যাচ্ছে কি না তা দেখেই সিদ্ধান্ত নেয়া হত। আজ তা গুরুত্ব হারিয়েছে। এসব পরীক্ষা করে কোন লোকের ডায়াবেটিস ঐ বিশেষ সময়টা তে আছে কি না তা জানা যায়। কিন্তু নিকট অতীতে তার রক্তের গ্লুকোজ সঠিক মাত্রায় ছিল কিনা বা ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ছিল কিনা তা জানা যায় না। সা¤প্রতিক কালে নূতন একটি পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছে যার মাধ্যমে সর্বোচ্চ গত চার মাসের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের হিসাব পাওয়া যাবে। এ টেস্টটির নাম হল গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিন বা হিমোগ্লুবিন এ১সি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এ পরীক্ষাটি ব্যাপক ভাবে সমাদৃত হচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক ল্যাবরেটরীতে এ পরীক্ষাটি অহরহই হচ্ছে। ২০১১ সনের শুরু থেকে এই পরীক্ষাটি ডায়াবেটিস নিরুপনের একটি গুরুত্বপূর্ন পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লুবিন কী?
মানুষের রক্তের লোহিত কনিকার অন্যতম গাঠনিক উপাদান হল হিমোগ্লুবিন। এ হিমোগ্লুবিনের জন্য রক্ত লাল এবং এটি দেহের ভিতরে অক্সিজেন পরিবহনের খুব গুরুত্বর্পূণ বাহক। এ হিমোগ্লুবিনের সাথে গ্লুকোজ লেগে থাকতে পারে এবং এর জন্য কোন এনজাইমের প্রায়োজন পড়ে না। এরূপ গ্লকোজ লেগে থাকা হিমোগ্লুবিনকে গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লুবিন বলে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমান যত বেশি হবে গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লুবিনের পরিমানও তত বেশি হবে। হিমোগ্লুবিনের সাথে লেগে থাকা গ্লকোজ ঐ লোহিত কনিকা যতদিন বেঁচে থাকে ততদিনই লেগে থাকবে। যেহেতু লোহিত কনিকা প্রায় ১২০ দিন (চার মাস) বেঁচে থাকে তাই এ পরীক্ষটি করে আমরা ডায়াবেটিস রোগীর গত প্রায় চার মাসের ডায়াবেটিসের অবস্থার (রক্তে গ্লুকোজের পরিমাপের) হিসাব পাব। আর এ গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লুবিনের পরিমান সাময়িক অন্যান্য সমস্যা (যেমন মানসিক অবস্থা, খাওয়া দাওয়া, শারীরিক শ্রম, বা অন্যান্য ওষুধের প্রভাবে) পরিবর্তিত হয় না ।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা: দ্রুত নির্ণয়ের পাশাপাশি ডায়াবেটিসের সঠিক নিয়ন্ত্রণ ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। এ ব্যাপারে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও রক্তের চর্বি, ওজন, রক্তচাপ নির্দিষ্ট মাত্রার ভিতর রাখা জরুরী।

নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা হলো:
অভুক্ত অবস্থায় রক্তের গ্লুকোজ : ৬.০ মি.মোল/লি এর নীচে
খাবার ২ ঘন্টা পর রক্তের গ্লুকোজ : ৮.০ মি মোল/লি এর নীচে
শোবার সময় রক্তের গ্লুকোজ : ৭.০ মি মোল/লি এর নীচে
হিমোগ্লুবিন এ১সি : ৭% এর নীচে
ট্রাইগ্লিসারাইড : ১৫০ মি গ্রাম/ডি এল এর নীচে
এল.ডি.এল : ১০০ মি গ্রাম/ডি এল এর নীচে
এইচ.ডি.এল : ৪০ মি গ্রাম/ডি এল (পুরুষ) এবং ৫০ মি গ্রাম/ডি এল (মহিলা) এর উপরে
বিএমআই : ২৫ কেজি/মি২ এ নীচে
রক্তচাপ : ১৩০/৮০ মি মি মার্কারী এর নীচে

ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
কমফোর্ট ডক্টর’স চেম্বার
১৬৫-১৬৬, গ্রীনরোড, ঢাকা।
ফোন ঃ ৮১২৪৯৯০, ৮১২৯৬৬৭, ০১৭৩১৯৫৬০৩৩।
Email: selimshahjada@gmail.com.

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন