রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সমাজ এত নির্বিকার কেন?

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

পত্রিকায় কিংবা লোক মুখে আমরা এমন সব ঘটনার কথা জানছি, যা বিশ্বাস করতে মন চায় না। অথচ প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে। যেমন, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করার পরও শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে। অন্য দিকে, অভাবের কারণেও অনেকে করছে আত্মহত্যা। হত্যার তো কথাই নেই। বাবা বা মায়ের হাতে সন্তান হত্যা, সন্তানের হাতে বাবা-মা হত্যা। এসব ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। সন্তানদের হত্যা করে পরে নিজের আত্মহত্যা, স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যা, স্ত্রীর হাতে স্বামী হত্যা এখন প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের ঘটনার বিস্তার অত্যন্ত দুর্ভাবনার, যার সমাধান নিয়ে ক‚লকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না।

ধরে নেয়া যাক, অভাবের তাড়নায় মানুষ তার সন্তানকে হত্যা করার পর নিজে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার প্রচেষ্টায় কেউ কোথাও মরে, কোথাও বেঁচে যায়। কিন্তু ‘সোনার চামচ’ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করা পরিবারের ছেলেমেয়েরা আত্মহত্যা করছে কেন? রূপযৌবনে ভরপুর এমন মেয়েরা বিশেষ করে নায়িকা-মডেলরা আত্মহত্যা করছে কেন? খেয়ে পরে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। তারপরও কিসের অভাবে তাদের আত্মহত্যা করতে হয়?

বাবার সাথে অভিমান করে গত ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় টুপিওয়ালা বাড়িতে চামেলী ভৌমিক নামে ১১ বছরের এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে বলে খবরে প্রকাশ। পুলিশের বরাত দিয়ে পত্রিকা জানিয়েছে, দুষ্টমি করায় বাবা স্বপন ভৌমিক কন্যাকে গালমন্দ করায় সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করে। স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন মনে জেগে ওঠে যে, জীবন, সমাজ বা পরিবার সম্পর্কে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামান্য গালমন্দ করায় কিশোরীটি কেন আত্মহত্যা করল? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। এ ধরনের আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমাজের কি দায়দায়িত্ব নেই? না কি সমাজ দিনে দিনে বিকারগ্রস্ত হওয়ার পথে?

যে বাবা জন্ম দিয়েছে, কষ্টার্জিত অর্থে লালন পালন করছে, যে মা গর্ভে ধারণ করে নিজের চেয়ে বেশি যত্নে সন্তানকে লালন-পালন করছে, একটু সম্পত্তির লোভে সেই বাবা-মাকে হত্যার কাহিনী যেন এখন আর থামছে না। এর কারণ কী? সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে না পারাই কি এর কারণ? যদি তাই হয়, তবে শিক্ষিত সন্তানরাও তো পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছে অথবা সন্তানদের অযত্ন অবহেলার কারণে নিজেরাই বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে নিজেদের আশ্রয় খুঁজছেন। বৃদ্ধাশ্রমে যারা রয়েছেন, তাদের ইতিহাস হৃদয় দিয়ে পর্যালোচনা করলে পৃথিবীটা যে কত নিষ্ঠুর তা সহজেই অনুমান করা সম্ভব। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেয়া বাসিন্দাদের জীবনকাহিনী শুনলে কোনো বিবেকবান মানুষ তার চোখের পানি আটকে রাখতে পারে না। বিয়ের পর অনেক ছেলে (কোনো কোনো ক্ষেত্রে) বাবা-মাকে অবহেলার চোখে দেখে এবং স্ত্রীকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু তাদের তো বোঝা দরকার, আজ সে বৃদ্ধ বাবা-মাকে অবহেলা করছে, কোনো দিন তাকেও তো বৃদ্ধ হয়ে তার সন্তানদের সেবা প্রত্যাশা করতে হবে। পবিত্র কুরআনে পিতা-মাতা সম্পর্কে আল্লাহ পাক কঠোর নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, তোমরা হাত উঁচিয়ে বাবা-মায়ের সামনে উপস্থিত হবে না এবং এমন কোনো আচরণ করবে না যাতে তারা সামান্য আঘাত পেয়ে ‘উহ’ শব্দ উচ্চারণ করে। আল্লাহপাক বাবা-মার জন্য দোয়া করার শিক্ষা দিয়ে কুরআনে বলেছেন, ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছগিরা’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, আপনি আমার পিতা-মাতাকে এমনভাবে লালন-পালন করুন, যেমনিভাবে আমাদের পিতা-মাতা আমাদের লালন-পালন করেছেন। আল্লাহপাক স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘আমি তো সবাইকে তার মা-বাবার সাথে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। একজন মা কষ্টের পর কষ্ট স্বীকার করে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে। তার বুকের দুধ ছাড়াতে লাগে পুরো দুই বছর। অতএব, আমার প্রতি এবং তোমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। কারণ, আমার কাছেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে।’ (সূরা লোকমান, আয়াত-১৪)

সন্তান হত্যা, বিশেষ করে ‘মা’ কর্তৃক সন্তান হত্যার অন্যতম কারণ পরকীয়া প্রেম। সমাজে পরকীয়া জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন পরকীয়া বৃদ্ধি পেয়েছে, তারও কারণ নানাবিধ। আল্লাহপাক (স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে) বলেছেন যে, তোমরা একে অপরের পরিচ্ছদ অর্থাৎ পোশাক। এ কথার অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, তোমরা একে অপরের জন্য ‘আমানত’। ‘আমানতের’ খেয়ানত ঘটলেই পরকীয়া পরিবারে প্রবেশ করে বিভিন্ন ঘটন-অঘটনের মাধ্যমে পরিবারটিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। যার ফলে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুন বা উভয় কর্তৃক সন্তান খুনের ঘটনা ঘটছে। বিকৃত রুচির কারণে সমাজের অভিজাত শ্রেণীতেই পরকীয়া বেশি হচ্ছে। এর পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। কারণ, ১. যে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে সে আরো সুখ কামনা করে। যার প্রচুর অর্থ রয়েছে সে আরো অর্থশালী হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। এ ধরনের মহিলাদের উচ্চাকাক্সক্ষা ও অতি লোভের কারণে লম্পট শ্রেণীর পুরুষেরা তাদের সহজে কাবু করছে। ঘটনা জানাজানি হলেই শুরু হয় খুনের পরিকল্পনা। পরকীয়া দেখে ফেলায় সন্তানকে খুন করার অনেক ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। ২. অনেক সময় স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতন (শারীরিক ও মানসিক), স্ত্রী কর্তৃক স্বামী নির্যাতন ছাড়াও সুখকর দাম্পত্য জীবনের ব্যত্যয় ঘটলে ঘরে পরকীয়া প্রবেশ করে। অনেক সময় স্বামী দীর্ঘদিন বিদেশে থাকলে বা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও পরকীয়ার পথ খুলে যেতে পারে। ৩. আকাশ সংস্কৃতি বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে যেসব ত্রিকোণ সম্পর্কের কাহিনী প্রদর্শিত হয়ে থাকে, সেগুলোও অনেককে পরকীয়ায় উৎসাহিত করে। ৪. মূলত বেপর্দা ও খোলামেলা চালচলন বিশেষ করে ফ্রি মিক্সিং পরকীয়ার প্রধান কারণ। পরকীয়া সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। আল্লাহপাক এ কারণেই ‘পর্দা’ প্রথার ওপরে গুরুত্ব অর্পণ করেছেন। পর্দা প্রথা দিনে দিনে বিলীন হওয়ার কারণেই ‘পরকীয়া’ নামক গজব সমাজে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে।

সমাজকে বিপর্যস্ত করার আরেকটি মাধ্যম ‘মাদক’। মাদকাসক্ত সন্তানেরাও বাবা-মাকে অর্থের জন্য খুন করছে। ঐশী নামে এক পুলিশকন্যা মাদকাসক্তির কারণেই দুধের সাথে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে ঘুমের মধ্যেই বাবা-মাকে খুন করেছে। বহু চেষ্টা করেও মাদকের ব্যবহার সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। যাদের দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করবে সেই পুলিশ বাহিনীর অনেকেই মাদক ব্যবসায় জড়িত। এই অভিযোগে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা কারাগারে অন্তরীণ হয়েছেন। অন্য দিকে পিতা নেশাগ্রস্ত হওয়ার কারণেও সন্তান নেশার পথে পা বাড়িয়েছে। ঢাকার বস্তিতে বস্তিতে কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরাও নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বস্তির মধ্যে নানা ধরনের নেশাসামগ্রী পাওয়া যায়। অভিজাত শ্রেণীর ছেলেমেয়েরাও নেশার সামগ্রী পাওয়ার জন্য বস্তিতে যায়।
মহান সৃষ্টিকর্তা মানবজাতিকে গজব থেকে মুক্ত থাকার জন্য এই বলে সতর্ক করেছেন যে, যেখানে পাপাচার সীমালঙ্ঘন করে সেখানেই আল্লাহর গজব আবির্ভূত হয়। করোনা (কোভিড-১৯) পৃথিবীতে এক প্রকার গজব, যা একটি অদৃশ্য শক্তি। অথচ পৃথিবীর সব শক্তি মিলেও এই অদৃশ্য শক্তিকে পরাভূত করতে পারছে না। এই রহস্য কোথায় লুকিয়ে আছে তাও মানুষ বিবেচনায় নেয় না। পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার জন্য আল্লাহপাক স্পষ্টভাবে বলেছেন, পূর্ব বা পশ্চিমমুখী হওয়ার মধ্যে কোনো পূণ্য নেই। পূণ্য রয়েছে ১. আল্লাহ, আখেরাত, ফেরেশতা, সব কিতাব ও নবীদের ওপর বিশ্বাসে। ২. আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, অসহায়, মুসাফির ও সাহায্যপ্রার্থীকে সাহায্য এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থদান। ৩. নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায়ের মধ্যে। ৪. ওয়াদা রক্ষায়। ৫. দুঃখকষ্ট, বালা-মুসিবত ও (সত্যের পথে যেকোনো) দুর্যোগে ধৈর্যধারণ করায়। যারা তা করবে, তারাই প্রকৃত সত্যানুসারী ও আল্লাহ-সচেতন। (সূরা : বাকারা, আয়াত-১৭৭)।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack+Ali ৩০ জানুয়ারি, ২০২১, ৬:১৩ পিএম says : 0
Root cause is that our country rule by man made law, not by the Law of Allah as such every body is committing crime in our beloved mother land.. We must rule our mother land by Qur'an then all the problem will flee from our sacred land.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন