শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

বিদ্যুতের প্রয়োজন আছে, তবে সুন্দরবন ধ্বংস করে নয়

প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন
সুন্দরবন শুধু আমাদের নয়, এটি সারা বিশ্বের জন্য একটি অনন্য প্রাণীবৈচিত্র্যপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বন। সুন্দরবন না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। এটি বাংলাদেশের মানুষের ফুসফুস। বাংলাদেশকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচাতে এটি একটি চিরন্তন ও অতুলনীয় ভূমিকা পালন করে থাকে। রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের যারা বিরোধিতা করছেন তারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য করছেন বিষয়টি এমন ভাবা সঠিক হবে না। দেশের মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করুক এটা যেমন সবাই প্রত্যাশা করে, তেমনি সুন্দরবন বিনাশী রামপালকেও অনেকে অযৌক্তিক মনে করে। রামপালের বিরুদ্ধে আপত্তি করার প্রধানতম কারণ হচ্ছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমির পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষতির বিষয়টি। কারণ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের অসাধারণ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে ফেলবে। সুন্দরবন না থাকলে যে বাংলাদেশ থাকবে তা হবে বিকৃত পরিবেশবিনাশী একটি দেশ। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বনের নানা ধরনের ক্ষতির কারণ হবে এটা সচেতন জনগণ বুঝতে পারলেও রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট মহল যখন বুঝতে পারে না বা বুঝতে চান না তখন সত্যিই দুঃখ হয়। আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন আছে এটা মানি কিন্তু সুন্দরবন ধ্বংস করে নয়। এমনিতেই পরিবেশগত দূষণ বা ক্যাইমেট চেঞ্জের দিক থেকে অন্য দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আবার এর মধ্যে রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে পরিবেশ বিনষ্ট করার কোনো মানে হয় না। রামপাল হলে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসবে দেশ এই নীতি পরিহার করা প্রয়োজন। আমরা উন্নয়নের নামে সুন্দরবনকে হারাতে চাই না।
এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে সুন্দরবন ধ্বংসের কাজটাও সম্পন্ন হয়ে যাবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এই আশংকা শুধু পরিবেশবাদীদের মধ্যে এখন সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। সবার একটাই কথা, সুন্দরবন বাঁচাও। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনকে বাঁচানোর এ দাবি জোরালো হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপিত হতে যাচ্ছে সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে। এ দূরত্ব আরও কমে যাবে যদি বাফার জোন তথা বন্য পশুপাখির জন্য সংরক্ষিত এলাকা ধরা হয়। এর আগে এই একই কোম্পানী পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিনষ্টের আশংকায় ভারত সরকার নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। তাহলে বাংলাদেশ কেন দিচ্ছে?
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশে নির্মাণ করতে যাচ্ছে ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে। আমরা যদি ভারতের পরিবেশ আইনের দিকে একটু লক্ষ করি তাহলে অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। ভারতীয় এনটিপিসি বাংলাদেশে রামপাল যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার কথা বলছে সেটা ভারতের পরিবেশ আইনে নিষিদ্ধ। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ইআইএ গাইড লাইন ২০১০-এ স্পষ্ট করে বলা আছে যে, নগর, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পরিবেশগত এলাকার ২৫ কিমি সীমার মধ্যে এ ধরনের কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিষিদ্ধ। অথচ সুন্দরবন বাংলাদেশের আইনে একটি অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত পরিবেশগত বনাঞ্চল এলাকা। ভারতের ২৫ কিমি সীমার মধ্যে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা নিরাপদ নয়, সেটা কোন বিবেচনায় ১৪ কিমি দূরত্ব সীমার মধ্যে বাংলাদেশে নিরাপদ? ১৪ কিমি দূরত্ব সীমা যে মোটেই নিরাপদ কোনো দূরত্ব সীমা নয় তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের অতীত অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে বোঝা সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ফায়েত্তি কাউন্টিতে ১৯৭৯-১৯৮০ সালে ১২৩০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সময়ও স্থানীয় জনগণকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর দেখা গেল এই প্রকল্প জনগণের কল্যাণ তো দূরের কথা উল্টো বৃক্ষগুলো ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে, যার মধ্যে পেকান বৃক্ষ অন্যতম। পেকান বৃক্ষ হচ্ছে একধরনের শক্ত বাদাম। ১৯৮০ থেকে ২০১০ সালের হিসেবে ফায়েত্তি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস বিশেষত সালফার-ডাই অক্সাইডের বিষক্রিয়ার পেকান, এলম, ওকসহ বিভিন্ন জাতের গাছ আক্রান্ত হয়েছে, বহু পেকান বাগান ধ্বংস হয়েছে। এমনকি এই ক্ষতিকর প্রভাব কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে থেকে ৪৮ কিমি দূরেও পৌঁছে গেছে।
সরকারের কিছু ভাড়াটে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের পক্ষে সাফাই গাইছেন। তারা বলছেন, এ ধরনের প্রকল্পের কারণে জাতি উপকৃত হবে। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতি হবে। আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিপক্ষে নই। তবে যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভারত সরকার সাতটি অভিযোগ এনে ভারতে কাজ করতে দিচ্ছে না, সে প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কীভাবে কাজ পেল? এই বিষয়টি দেশবাসীর জানা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বহু সমস্যা রয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এসব সমস্যার সমাধান করা কোন বিষয়ই না। সুশাসন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ভূলুণ্ঠিত হলে তা আবার ফিরে পাওয়া যায়। কিন্তু সুন্দরবনের মতো এমন একটি প্রাকৃতিক সম্পদ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন কোনো সরকারের না, এটি রাষ্ট্রের। সরকারের প্রতি অনুরোধ, সুন্দরবনের স্বার্থে এই প্রকল্প বাতিল করুন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন