কে. এস. সিদ্দিকী
মক্কার পৌত্তলিক কাফেরদের একটি ঘৃণিত কাজের নিদর্শন ছিল এই যে, জাহেলি যুগে তারা ‘এসফি’ ও ‘নায়েলা’ নামক দুটি প্রতিমা স্থাপন করে রেখেছিল পবিত্র কাবার সন্নিকটে। দুটির মাঝখানে অবস্থিত ছিল হজরত ইসমাঈল (আ.) ও তার মাতা হজরত হাজেরা (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক ‘জমজম’ কূপ। কোরেশদের কোরবানগাহ ছিল এখানে। এ কূপ বন্ধের সাথে যুক্ত আছে যেমন কাবা ধ্বংসের এক গভীর ষড়যন্ত্র ও ইয়েমেনে কৃত্রিম কাবা নির্মাণের দূরভিসন্ধি, তেমনি এ লুপ্ত জমজম তালাশের রয়েছে এক অপূর্ব কাহিনী। আবদুল মোত্তালেবের একটি স্বপ্ন এবং তার পুত্র কোরবানির ঘটনা এ জমজমের সাথে যুক্ত। বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতে গেলে ইতিহাসের গোড়াতে চলে যেতে হয়।
আরবগণ প্রাচীনকাল থেকে খানা-ই-কাবার পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় যথেষ্ট যতœবান ছিল। কাবার তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় যেসব গোত্র নিয়োজিত থাকত, তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব তাদেরকে সম্মান ও গৌরবের উচ্চ আসনের অধিকারী করত এবং কাবার তত্ত্বাবধানের জন্য তাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো। এটাকে স্বাভাবিক অবস্থা বলা যেতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী অবস্থারও সৃষ্টি হয়েছে কখনো কখনো। কাবাকে স্থানান্তরিত করার নিষ্ফল উদ্যোগ-প্রয়াসের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কথিত আছে যে, নজর ইবান কেনানার পর ফিহির ইবনে মালেক ছিলেন আরবের প্রধান নেতা। ইয়েমেনে তার সমসাময়িক আরেকজন নেতা ছিলেন হাসসান ইবনে আব্দে কেলাল হিমিয়ারি। সম্ভবত এ ইয়েমেনি হিমিয়ারিই ছিলেন কাবার ওপর প্রথম হস্তক্ষেপকারী।
হাসসান হিমিয়ারি সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি ইচ্ছা পোষণ করতেন যে, তিনি খানা-ই-কাবার সকল পাথর খুলে ইয়েমেনে নিয়ে যাবেন এবং সেখানেই হজের জন্য কাবা নির্মাণ করবেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি হিমিয়ারসহ অন্যান্য গোত্রের লোকদের নিয়ে ইয়েমেন থেকে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করে মক্কা থেকে এক মনজিল দূরে অবস্থিত ‘নাখলা’ নামক স্থানে অবস্থান করেন। এ সময় ফিহির খবর পেয়ে আরবের সকল গোত্রকে সমবেত করেন এবং হাসসান হিমিয়ারির মোকাবিলায় অবতীর্ণ হন এবং পরাজিত ও গ্রেফতার করেন। তিন বছর পর হাসসান হিমিয়ারি ‘ফিদিয়া’ অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে মুক্তিলাভ করেন। এ ঘটনার ফলে ফিহিরের সুনাম, খ্যাতি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়ে। কাবার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক কাবা নির্মিত হওয়ার পর প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ ব্যতীত কাবার ওপর কোনো মানব শক্তির আগ্রাসন-আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায় না। প্রাকৃতিক কারণে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। কাবা আক্রমণ করতে এসে আবরাহা বাহিনী ধ্বংস হওয়ার ঘটনার বর্ণনা সূরাফিলে রয়েছে। হাসসান হিমিয়ারির দুঃসাহসিকতার পূর্বে কাবা আক্রমণের কোনো ঘটনার খবর জানা যায় না। কাবার ওপর ইয়েমেনি হিমিয়ারিদের এরূপ নগ্ন হস্তক্ষেপ পরিকল্পনা তথা ষড়যন্ত্র যিনি বানচাল করেন তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ঊর্ধ্বতন পুরুষ ফিহির এবং তারই অধঃস্তন পুরুষদের মধ্যে ছিলেন আবদুল মোত্তালেব ইবনে হাশেম।
জমজম কূপ লুপ্ত হওয়ার নেপথ্যে
হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর পর তার পুত্র নাবত কাবার মোতাওয়াল্লী বা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব লাভ করেন। নাবতের পর তার নানা মাযায ইবনে আমর জুরহুমী মোতাওয়াল্লী হন। বনু জুরহুম যখন হেরম শরিফের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করে এবং কাবার অর্থ-সম্পদ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে থাকে তখন বনু বকর ইবনে আবদে মানাফ ইবনে কেনানা এবং গাবশান খোজায়ী মিলে বুনু জুরহুমকে মক্কা থেকে ইয়েমেনে বিতাড়িত করেছেন। তখন থেকে কাবার মোতাওয়াল্লী হন খোজায়ীরা। তাদের সর্বশেষ মোতাওয়াল্লী ছিলেন হালীল ইবনে হারশিয়া। অতঃপর কোসাই ইবনে কেলাব মোতাওয়াল্লী হন। পূর্বে আমর ইবনে হারেম ইবনে মাযাম জুরহুমী মক্কা ত্যাগ করার সময় কাবায় স্থাপিত দুটি সোনার হরিণ ও পাথর জমজমে নিক্ষেপ করে তার মুখ এমনভাবে বন্ধ করে দেন যে, দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার পরও তার চিহ্ন পর্যন্ত জানা যায়নি। হালীলের কোসাই মোতাওয়াল্লী হওয়ার পর জমজম কূপ অনুসন্ধানে তার কী ভূমিকা ছিল সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
কোসাই ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পঞ্চম ঊর্ধ্বতন পুরুষ। তার আসল নাম ছিল জাইদ। কাবার মোতাওয়াল্লী হওয়ার পর তিনি বনু খোজাআকে বায়তুল মাল থেকে বিতাড়িত করেন এবং কোরেশের সমস্ত ঘাঁটি পর্বতমালা এবং উপত্যকাগুলো হতে লোকদেরকে সমবেত করে মক্কার অভ্যন্তরে এবং বাইরে পুনর্বাসিত করেন। এ জন্য তাকে বলা হয় মোজতামে বা সমবেতকারী।
কোসাইয়ের চার পুত্রের মধ্যে আবদে মালাকের পুত্র হাশেমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার আসল নাম ছিল আমর। তিনি ছিলেন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। তার দস্তরখানকায় খাবারের পাত্র সর্বদা উন্মুক্ত থাকত। একবার ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তিনি শাম দেশ (সিরিয়া) থেকে শুকনো রুটি ক্রয় করে হজ মৌসুমে মক্কায় পৌঁছেন এবং রুটিগুলো চূর্ণ করে উটের গোশতের সুরায় মিশিয়ে হাজিদেরকে পেট ভরে খাওয়ান। সেদিন থেকে তাকে হাশেম রুটি চূর্ণকারী বলা হয়। কাবার প্রতি ছিল তার অসীম ভক্তি, ভালোবাসা এবং হাজিদের প্রতিও তার আন্তরিকতা ও দরদের কমতি ছিল না। তিনি জিলহজ মাসের প্রথম তারিখে ভোরে কাবার সাথে পৃষ্ঠ লাগিয়ে এইভাবে ভাষণ দিতেন : হে কোরেশগোত্র সকল! তোমরা আল্লাহর ঘরের পড়শি। আল্লাহ বনি ইসমাঈলের মধ্যে তোমাদেরকে তার তত্ত্বাবধানের সৌভাগ্য দান করেছেন এবং তোমাদেরকে তার পড়শি হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট করেছেন। আল্লাহর সাক্ষাৎ প্রার্থীগণ তোমাদের নিকট আসছেন যারা আল্লাহর ঘরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। তাই তারা আল্লাহর মেহমান এবং আল্লাহর মেহমানদের মেহমানদারি (আপ্যায়ন) করার অধিকার তোমাদেরই সর্বাধিক। সুতরাং তোমরা আল্লাহর মেহমানদের এবং তার জিয়ারতকারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর, যারা প্রত্যেক শহর থেকে তীরের ন্যায় দুর্বল ও দ্রুতগামী উটনিগুলোর ওপর আরোহণ করে আসছে তাদের মুখম-ল ফেকাশে মলিন ও ধুলাবালি মিশ্রিত।
এই গৃহের প্রভুর শপথ, আমার নিকট যদি এ কাজের জন্য পর্যাপ্ত পুঁজি থাকত, আমি তোমাদেরকে কষ্ট দিতাম না।
কোসাইয়ের বিভিন্ন কীর্তির মধ্যে একটি ‘দারুণ নাদওয়া’ বা পরামর্শ ভবন প্রতিষ্ঠা করা। গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয় এখানে পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো। যুদ্ধের জন্য এখানে পতাকা প্রস্তুত করা হতো। বিয়েশাদি ও অন্যান্য সকল অনুষ্ঠান এখানে হতো। হাজিদের খানাপিনার ব্যবস্থা এখানে করা হতো এবং এখানেই হাজিদের জমজমের পানি পান করানো হতো। কোসাই এসব কাজের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। হজের মৌসুমে তিনি কোরেশকে সমবেত করে ভাষণ দিয়ে আরো বলতেন :
তোমরা আল্লাহর প্রতিবেশী এবং তার গৃহের মোতাওয়াল্লী এবং হাজিগণ আল্লাহর মেহমান এবং গৃহের জিয়ারতকারী। তারা মেহমানদের তুলনায় তোমাদের আথিত্বের অধিক যোগ্য সুতরাং হজের দিনগুলোতে তাদের পানাহারের জন্য কিছু ধার্য কর। এ বক্তৃতা শ্রবণ করে কোরেশগণ বার্ষিক অর্থ ধার্য করে যদ্বারা প্রতি বছর মিনা দিবসে অর্থাৎ কোরবানির দিনগুলোতেও গরিব হাজিদের খাবার পরিবেশন করা হতো। পানি পান করার জন্য কোসাই চামড়ার পাত্র তৈরি করেন। সেগুলো হজের দিনগুলোতে কাবার আঙ্গিনায় রাখা হতো। এসব পাত্র ভরে রাখার জন্য মক্কার কূপসমূহের পানি মশক ভর্তি করে উটে বহন করে আনা হতো। এসব কর্মযজ্ঞ ছাড়াও কোসাই আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পালন করতেন। কোসাই প্রথম ব্যক্তি যিনি মোজদালেফায় আলোর ব্যবস্থা করেন, যেখান থেকে আরাফাত দৃষ্টিগোচর হতো।
কোসাই ছিলেন হালীল খোজায়ীর কন্যার স্বামী। তিনি বলতেন, আমি নিজের হালাল উপার্জন থেকে দিচ্ছি। তোমাদের মধ্যেও যারা আগ্রহী তারা অনুরূপ করবে। আমি এ ঘরের দোহাই দিয়ে নিবেদন করছি, যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহ জিয়ারতকারীদের নিজের মাল থেকে দিতে চায়, তা যেন হালাল উপার্জন ব্যতীত না হয়। এ বক্তৃতার ফলে কোরেশরা নিজেদের হালাল মাল থেকে দিতে আরম্ভ করে এবং দারুণ নাদওয়ায় জমা করতে থাকে।
মদিনায় বনু আদি ইবনে নাজ্জারে এক ব্যক্তির নাম ছিল আমর ইবনে জাইদ লাবীদ খজরজী। তার এক অপূর্ব সুন্দরী কন্যা সালমার সাথে বিয়ে হয় হাশেমের। আমর হাশেমের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, সালমা যে সন্তান প্রসব করবে তা তার পিত্রালয়ে করবে। বিয়ের পর হাশেম সিরিয়া চলে যায় এবং প্রত্যাবর্তনের পর সালমাকে মক্কায় নিয়ে আসেন, তখন সালমা গর্ভবতী। অঙ্গীকার অনুযায়ী, হাশেম সালমাকে তার পিত্রালয়ে মদিনায় রেখে আবার সিরিয়ায় চলে যান এবং সেখানে গাজ্জায় ২৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং সেখানে তাকে দাফন করা হয়।
এদিকে সালমা একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। তার মাথার কিছু চুল ছিল সাদা। এ জন্য তার নাম হয়ে যায় ‘শাইবা’ (বার্ধক্যের লক্ষণ মাথার চুল সাদা হয়ে যাওয়া)। সাত/আট বছর শাইবা মদিনায় অবস্থান করেন। হাশেমের ভ্রাতা মোত্তালেব খবর পেয়ে ভাতিজাকে আনতে যান। মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পর লোকেরা জিজ্ঞাসা করে এই ছেলে কে? মোত্তালেব বললেন, আমার গোলাম। এ কারণে শাইবাকে আবদুল মোত্তালেব নামে আখ্যায়িত করা হতে থাকে যিনি ছিলেন হুজুর (সা.) এর দাদা।
মহাত্মা আবদুল মোত্তালেব কাবার তত্ত্বাবধায়নকালে স্বপ্নযোগে লুপ্ত জমজম কূপ খনন করার সঠিক স্থান সম্পর্কে ইশারা পান। সে সময় আবদুল মোত্তালেবের শুধু একজন পুত্র সন্তান ছিল, তার নাম ছিল হারেস। পুত্রকে নিয়ে তিনি খননকার্য আরম্ভ করেন। কূপের উপরিভাগ দৃষ্টিগোচর হলে অতিশয় আনন্দে তকবীর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ওঠেন। কোরেশরা এ অবস্থা অবলোকন করে বলতে থাকে যে, এটি আমাদের পিতা ইসমাঈল (আ.)-এর কূপ। এর খননকার্যে আমাদেরকেও অংশীদার করতে হবে। আবদুল মোত্তালেব বললেন, এ বিষয়টি আমার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং তোমাদের মধ্যে বিশেষভাবে আমাকেই এটি প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং তোমাদের আমি এ কাজে অংশীদার করতে পারি না। ফলে খননকার্যকে কেন্দ্র করে কোরেশ ও আবদুল মোত্তালেবের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।
অপর বর্ণনা অনুযায়ী আবদুল মোত্তালেব যখন পুত্র হারেসকে নিয়ে (স্বপ্নে নির্দেশিত স্থানে) কূপ খনন করতে যান, তখন কোরেশদের বিরোধিতার দরুন খনন করতে পারলেন না। এ জন্য তিনি মানত করেন যে, আল্লাহ যদি আমাকে দশটি পুত্র সন্তান দান করেন এবং তাদেরকে আমি যুবক রূপে দেখতে পাই, তাহলে তাদের একজনকে কাবা শরিফের কাছে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করব। আল্লাহ তাকে দশটি পুত্র সন্তান দান করেন। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন