মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

জিলহজের প্রথম ১০ দিনের ফজিলত

প্রকাশের সময় : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান
মহান আল্লাহ বান্দাদের ক্ষমা ও তওবার সুযোগ দিয়ে থাকেন। তিনি চান বান্দারা ইবাদতের মাধ্যমে ক্ষমা ও নৈকট্য লাভ করুক। এ উদ্দেশ্যে তিনি আমাদের জন্য বছরে কিছু বরকতময় ও কল্যাণবাহী দিন রেখেছেন, যাতে আমলের সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়। ইসলামে যতগুলো মর্যাদাবান ও ফজিলতপূর্ণ দিবস রয়েছে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন। এই ১০ দিন আমাদের জন্য পরকালের পাথেয় সঞ্চয়ের এক সূবর্ণ সময়, যাতে বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি নেকি ও কল্যাণ বয়ে আনে। রাসূল (সা.) কিছু দিনকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন ও আমলের প্রতি সবিশেষ উদ্বুদ্ধ করেছেন। আমরা যদি পরীক্ষার দিনগুলোতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাই ভালো ফলাফল অর্জনের জন্য, তবে কেন আখেরাতের নাজাত ও কামিয়াবির জন্য এসব মর্যাদাবান ও ফজিলতপূর্ণ দিনগুলোকেও সর্বাধিক প্রচেষ্টায় ব্যয় করব না? যে ব্যক্তি কোনো ভালো কাজের সংকল্প করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। তার জন্য সাহায্যকারী, উপায় ও উপকরণ প্রস্তুত করে দেন। কেউ যখন জানতে পারে কী বড় অর্জনই না তার জন্য অপেক্ষা করছে, তখন যে কোনো কষ্ট সহ্য করা তার জন্য সহজ হয়ে যায়। তাই আমাদের কর্তব্য এ দিনগুলোকে পুণ্যময় কাজে সুশোভিত করার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করা।
জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের ফজিলত, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রমাণে শুধু এতটুকুই যথেষ্ট যে, আল্লাহপাক এ ১০ দিনের কসম করেছেন। ‘শপথ ফজরের ও ১০ রাতের’ (সূরা ফজর)। ইবনে কাসির (রহ.)সহ সকল মুফাসসির বলেন, ১০ রাত বলতে এখানে জিলহজের ১০ রাতকে বুঝানো হয়েছে। আকাশ, পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, বাতাস ইত্যাদি বড় কোনো বিষয় ছাড়া আল্লাহপাক কসম খান না। কাল ও সময় নিয়ে কসম করলে এর মধ্যে যা উত্তম তা নিয়েই তিনি কসম করেন, যেমনÑ ফজর, আসর, দুহা, রাত, দিন এবং জিলহজের ১০ দিন। স্থান নিয়ে কসম করলে সর্বোত্তম স্থান নিয়েই তিনি কসম করেন, যেমনÑ মক্কা। যদিও আল্লাহতায়ালা তাঁর সৃষ্ট যে কোনো বিষয় নিয়েই কসম করতে পারেন, তবে মানুষের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কসম করা হারাম। আল্লাহপাক বলেন, ‘যেন তারা নিজেদের কল্যাণের স্থানসমূহে হাজির হতে পারে এবং তিনি তাদের চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিজিক দিয়েছেন তার ওপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে’ (সূরা হজ)। ইবনে উমর ও ইবনে আব্বাস (রা.)সহ জমহূর উলামার মতে, আয়াতে নির্দিষ্ট দিনসমূহ বলে জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনকে বুঝানো হয়েছে।
জিলহজের এই দিনগুলোকে রাসূল (সা.) শ্রেষ্ঠতম দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। ‘এমন কোনো দিন নেই যার আমল জিলহজ মাসের এই দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জানমাল নিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধে বের হলো এবং এর কোনো কিছু নিয়েই ফেরত এলো না (তার কথা ভিন্ন)।’ ‘এই ১০ দিনের আমল অপেক্ষা অন্য দিনের আমল প্রিয় নয়’ (বুখারি)। হাদিসের বর্ণনায় ‘আহাব্বু’ সর্বাধিক প্রিয়, কোনো বর্ণনায় ‘আফযালু’ সর্বোত্তম শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। জিলহজ মাসের প্রথম দশকে রয়েছে আরাফা ও কোরবানির দিন। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিন আল্লাহপাক অধিক সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দাগণ আমার কাছে কি চায়’? (মুসলিম)। জিলহজের এই দশকে যদি ফজিলতের আর কিছু না থাকত তবে এ দিবসটিই তার মর্যাদার জন্য যথেষ্ট হতো। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আরাফা দিবসই হজ’।
মৌলিক ইবাদতের সমাবেশ : হাফেজ ইবনে হাজর (রহ.) তার ফাতহুল বারি গ্রন্থে বলেন, ‘জিলহজের প্রথম দশকের বৈশিষ্ট্যের কারণ যা প্রতীয়মান হয় তা হলো, এ দিনগুলোতে মৌলিক ইবাদতের সন্নিবেশ ঘটে। যথাÑ সালাত, সিয়াম, সাদাকা, কোরবানি, হজ ইত্যাদি। অন্য কোনো সময় এতগুলো ইবাদতের সমাবেশ ঘটে না।’ আল্লাহপাক জিলহজের প্রথম দশকেই মুসলমানদের জন্য তার দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দেয়া এমনি এক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা যা ইহুদিদেরকেও ঈর্ষান্বিত করে দিয়েছিল। জনৈক ইহুদি আলেম উমর (রা.) কে বলেছিল, আপনাদের কিতাবের একটি আয়াত যদি আমাদের ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর নাজিল হতো, তাহলে আমরা ওই দিনটিকে ঈদ হিসেবে পালন করতাম। আয়াতটি হলো : ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর আমি তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম’। উমর (রা.) বললেন, আমি জানি, উক্ত আয়াত কখন নাজিল হয়েছে, কোথায় নাজিল হয়েছে। আরাফার দিন শুক্রবারে আয়াতটি নাজিল হয়েছে (বুখারি)। নিয়ামত পরিপূর্ণ করার আরেকটি দিক হলো, ইসলামকে সকল দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ও প্রকাশ করে দেয়া। আরব উপদ্বীপে ইহুদি, খ্রিস্ট, পৌত্তলিক, অগ্নিপূজা ছিল। ইসলাম সবগুলোকেই জাজিরায়ে আরাবিয়া থেকে বিদায় করে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ফলে মানুষ শান্তির আশায় স্বেচ্ছায় দলে দলে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিতে শুরু করে।
একটি প্রশ্ন থাকতে পারেÑ রমজানের শেষ দশক অধিক ফজিলতপূর্ণ না জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন? জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিবস অধিক ফজিলতপূর্ণ, এ ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই। তবে মতভেদের অবকাশ রয়েছে রাত্রির ফজিলত নিয়ে। বিশুদ্ধতম মত হলো, রাত হিসেবে রমজানের শেষ দশকের রাত আর দিবসের ক্ষেত্রে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিবস অধিক মর্যাদার অধিকারী।
প্রথম দশ দিনের আমল : প্রত্যেকেরই উচিত ইবাদতের মৌসুমগুলোকে সুন্দর প্রস্তুতির মাধ্যমে স্বাগত জানানো। জিলহজ মাসকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি নিচের আমলগুলোর মধ্য দিয়েÑ
সিয়াম পালন : জিলহজের ১ থেকে ৯ তারিখে যে কোনো দিন বা পূর্ণ ৯ দিন সাওম পালন করা যেতে পারে। তিরমিজি শরিফে এসেছে এই মাসের প্রথম ১০ দিনের যে কোনো দিনের সাওম পুরো বছরের সাওমের সমান এবং এই রাতগুলোর ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের সমান। উলামাদের মত হলো, এই রোজার দিন হলো যার যার দেশের ৯ জিলহজ যখন আসে তখন, সৌদি আরবের ৯ জিলহজের সাথে মিলিয়ে নয়। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের সাওম আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন’। তবে আরাফার ময়দানে অবস্থানকারী হাজিগণ সাওম পালন করবে না। এ ছাড়াও ১০ তারিখ ঈদুল আজহার দিন রোজা রাখা যাবে না।
তাকবির পাঠ : ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ জিলহজ মাসের সূচনা থেকে আইয়ামে তাশরিক শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ তাকবির পাঠ করা মুস্তাহাব। তবে ৯ তারিখ ফজর সালাতের পর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক সালাতের পর এ তাকবির পাঠ করার জন্য বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘এ ১০ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলিল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার) ও তাহমিদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়।’
চুল, নখ ইত্যাদি না কাটা : জিলহজের চাঁদ দেখার পর থেকে যারা কোরবানির নিয়ত করবে তাদের হাত, পায়ের নখ, মাথাসহ অবাঞ্ছিত চুল ইত্যাদি কাটবে না। যদি ৪০ দিনের বেশি হয়ে থাকে তাহলে এসব কেটে ফেলা আবশ্যক। নতুবা ১০ দিন পর কোরবানির পর পরিষ্কার করা।
কোরবানি করা : এ দিনগুলোর দশম দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কোরবানি করুন’ (কাউসার)। কোরবানির পশু জবাই ও গরিবদের মধ্যে এর গোশত বিতরণের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভ হয়। এর দ্বারা গরিবদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পায় এবং তাদের কল্যাণ সাধন হয়। রাসূল (সা.) বলেন, কোরবানির দিন কোনো ব্যক্তি (কোরবানির পশুর) রক্ত ঝরানোর ন্যায় আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় অন্য কোনো কাজই করতে পারে না।
হজ ও উমরা সম্পাদন : এ দুটি হলো এ দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। যারা এ দিনগুলোতে হজ আদায়ের সুযোগ পেয়েছেন তারা যে অনেক ভাগ্যবান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ যাকে তাঁর নির্দেশিত এবং রাসূল (সা.) প্রদর্শিত পন্থায় হজ বা উমরা করার তাওফিক দান করেন তার পুরস্কার শুধুই জান্নাত। রাসূল (সা.) বলেন, ‘এক উমরা থেকে আরেক উমরা এতদুভয়ের মাঝের গুনাহগুলোর কাফফারা এবং মাবরূর (কবুল) হজের প্রতিদান কেবলই জান্নাত’ (বুখারি, মুসলিম)।
সালাত কায়েম : সালাত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, সম্মানিত ও মর্যাদাবান আমল। তাই এ দিনগুলোতে আমাদের সবার চেষ্টা করা উচিত ফরজ সালাতগুলো জামাতে আদায় করা। নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল, তাওবা-ইস্তিগফার ও রোনাজারি ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে রাত কাটানো।
দান-সাদাকা : ‘সাদাকা সম্পদকে কমায় না’, এ দিনগুলোতে যে আমলগুলো বেশি বেশি দরকার তার মধ্যে অন্যতম হলো দান-সাদাকা।
একনিষ্ঠ তওবা : তওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন করা বা ফিরে আসা। যেসব কথা ও কাজ আল্লাহপাক অপছন্দ করেন তা বর্জন করে যেসব কথা ও কাজ তিনি পছন্দ করেন তার দিকে ফিরে আসা। প্রকৃত তওবা সেটি যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমানÑ ১. গুনাহের কাজ সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা। ২. গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং ৩. গুনাহের কাজ ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করা। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, যে তওবা করেছিল, ঈমান এনেছিল এবং সৎকর্ম করেছিল, আশা করা যায় সে সাফল্য অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে (কাসাস)। ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (জুমার)।
সৎ কর্মের মাধ্যমে যেমন আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়, গুনাহের কাজের মাধ্যমে তেমন আল্লাহর রহমত ও করুণা থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আল্লাহপাক আমাদেরকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, গ্রহণযোগ্য আমল এবং উত্তম রিজিক দান করুন। সেসব ব্যক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন যারা সময়ের সূবর্ণ সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করেছেন।
abunoman72@ymail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন