ইলিশ পোনা-জাটকা আহরন বন্ধের ৪ মাস অতিক্রান্ত হলেও বেকার জেলেদের জন্য বরাদ্বকৃত খাদ্য সহায়তা এখনো মেলেনি। এমনকি এবার ‘জাটকা আহরন প্রতিরোধ সপ্তাহ’ পালনের বিষেয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। অন্যান্য বছর মার্চের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে এ সপ্তাহ পালিত হয়ে আসছিল। তবে দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকলীয় এলাকার ৬টি অভয়াশ্রমে সব ধরনের মৎস্য আহরন নিষেধাজ্ঞা ক্রমান্বয়ে কার্যকর হচ্ছে। এরমধ্যে ৪টি অভয়াশ্রমে সোমবার রাতের প্রথম প্রহর থেকে দু মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। আর সারা দেশেই গত ১ নভেম্বর থেকে জাটকা আহরন,পরিবহন ও বিপননে যে নিষধাজ্ঞা বলবত রয়েছে, তা চলবে ৩০ জুন পর্যন্ত। নিরাপদ প্রজনন ও বংশ বিস্তার নির্বিঘœ করতে উপকূলীয় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে সব ধরনের মৎস্য আহরন সহ সারা দেশে ইলিশ আহরন, পরিবহন ও বিপননে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা গত বছর ১৩ অক্টোবর মধ্যরারত থেকে ৪ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত বলবত ছিল। ইলিশ প্রজনন নির্বিঘœ করতে ২২ দিনের আহরন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আগেই জাটকা আহরন নিষিদ্ধ হয় ।
সরকার জাটকার আহরন নিরুৎসাহিত করতে জেলেদের খাদ্য সহায়তা হিসেবে গত কয়েক বছর ধরেই খাদ্য সহায়তা প্রদান করে আসছে। চলতি বছরও গত ১৫ ফেব্রুয়ারী ত্রান ও দূর্যোগ ব্যাবস্থাপনা মন্ত্রনালয় থেকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়ে সুপারিশে দেশের উপক’লীয় ২০টি জেলার ৯৮টি উপজেলার প্রায় ৩ লাখ ২৯ হাজার জেলের জন্য দু মাসের খাদ্য সহায়তা বাবদ ২৬ হাজার ৩০৫ টন চাল বরাদ্ব করা হয়েছে। কিন্তু গত ১৬ দিনেও তা উপক’লীয় সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে পৌছেনি। ৮ মাস জাটকা আহরন নিষিদ্ধ থাকলেও সরকারী সিদ্ধান্তনুযায়ী চার মাসের জন্য জেলেদের ৪০ কেজি করে চাল বরাদ্ব হবার কথা। তবে গত ১৫ ফেব্রুয়ারী দু মাসের জন্য ২৬ হাজার ৩০৫ টন চাল বরাদ্ব করা হয়েছে বলে জানা গেছে। পরবর্তিতে আরো দুমাসের জন্য অনুরূপ চাল বরাদ্বের কথা রয়েছে।
বরাদ্বকৃত এসব চালের মধ্যে বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলার ৪২টি উপজেলার মধ্যে ৪১ টির ২ লাখ ১ হাজার ৭৮ জন জেলের জন্য ১৬ হাজার ৮৬ টন চাল বরাদ্ব করা হয়েছে। গত বছর এ বিভাগে চালপ্রাপ্ত জেলোর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৫ হাজার ৪৮০। এবার চাল বরাদ্বপ্রাপ্ত জেলের সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার বাড়লেও এখনো দক্ষিণাঞ্চলে আরো বিপুল সংখ্যক জেলে সরকারী খাদ্য সহায়তার বােির রয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে দক্ষিণাঞ্চলে নিবন্ধিত জেলোর সংখ্যা ৩ লাখ ৬০ হাজার ১৯১। তবে মৎস্য বিভাগের মতে এরা সব ধরনের মৎস্য আহরন করে থাকে। শুধু ইলিশের ওপর নির্ভরশীল জেলের সংখ্যা কিছুটা কম।
মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ১% এবং মৎস্য খাতে প্রায় ১২%অবাদন রাখা ইলিশ আহরনে দেশের দক্ষিনাঞ্চল ও উপকূলীয় ৪০টি জেলার ১৪৫ উপজেলার দেড় হাজার ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৫ লাখ জেলে পরিবার সম্পৃক্ত। যার ৩২% সার্বক্ষণিক এবং ৬৮% খন্ডকালীন। এছাড়াও ইলিশ বিপনন, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরন সহ জাল, নৌকা, বরফ তৈরী এবং মেরামত কাজেও প্রায় ২০-২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলাতেই প্রায় সোয়া ৩ লাখ জেলে এ পেশার সাথে জড়িত। যার ৬৫% সার্বক্ষণিক ইলিশ আহরনে সরাসির জড়িত বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।
এদিকে গত ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশেই ইলিশ জাটকার আহরন, পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধ থাকার মধ্যেই মৎস বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকে অন্যান্য বছরের মত এবারও ৬টি অভয়াশ্রমে পর্যায়ক্রমে ইলিশ সহ সব ধরনের মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ থাকছে। এরমধ্যে নিম্ন মেঘনা নদী, শাহবাজপুর চ্যানেল ও তেতুলিয়া নদীতে গত ১ মার্চ মধ্যরাত থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। এছাড়াও শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিনে চাঁদপুর জেলার মতলব ও শরিয়তপুর উপজেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবিস্থিত পদ্মা নদীর ২০কিলোমিটার এলাকায়ও একই সাথে নিষেধাজ্ঞা কর্যকর হয়েছে। এর আগে পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে নভেম্বরÑজানুয়ারী মাসের সময়কালকে অভআশ্রম হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছিল। পাশাপাশি বরিশালের হিজলা উপজেলার নাছকাটা পয়েন্ট, হরিনাথপুর পয়েন্ট, ধুলখোলা পয়েন্ট এবং মেহেদিগঞ্জ উপজেলার ভাষান চর পয়েন্ট এলাকার মেঘনার শাখা নদী, হিজলা উপজেলার ধর্মগঞ্জ ও নয়া ভাঙনী নদী এবং মেহেদিগঞ্জ উপজেলার লতা নদীর ৬০কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ ও জাটকার ষষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেব ঘোষনা করে মার্চ ও এপ্রিল মাসে সব ধরনের মৎস্য আহরনে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে।
অপরদিকে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখার লক্ষ্যে সামুদ্রিক মৎস সম্পদের মজুদ ও জীব বৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করতে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজর্ভ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ তার জীবনচক্রে স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। একটি পরিপক্ক ইলিশ প্রতিদিন শ্রোতের বিপরিতি ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলতে পারে। উপক’লের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মূক্তভাবে ভাসমান ডিম থেকে ফুটে বের হবার পরে ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নর্সারী ক্ষেত্রসমুহে বিচরন করে। এরা খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে। নার্সারী ক্ষেত্রসমুহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে জাটকা হিসেব সমুদ্রে চলে যায় পরিপক্কতা অর্জনের লক্ষ্যে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্কতা অর্জন করে প্রজননক্ষম হয়ে তারা আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে আসে। সমুদ্রে যাবার সময় পর্যন্ত যেসব এলাকায় জাটকা খাদ্য গ্রহন করে বেড়ে ওঠে, সেগুলোকে মৎস বিজ্ঞানীগন ‘গুরুত্বপূর্ণ নার্সারী ক্ষেত্র’ হিসেবে চিহিৃত করায় অভয়াশ্রম ঘোষনা করা হয়েছে।
গত দুই দশক ধরে নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহনের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন সোয়া দ্ ুলাখ টন থেকে গত অর্থ বছরে ৫ লাখ ৩৩ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। যা চলতি অর্থ বছরে ৫.৪০ লাখ টনে ও আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৫ লাখ টনে উন্নীত হবার ব্যাপারে আশাবাদী মৎস্য অধিদপ্তর। আর সারাদেশে ৬৬Ñ৭০% ইলিশ উৎপাদন হচ্ছে বরিশাল বিভাগের অভ্যন্তরীন ও উপকূলীয় মূক্ত জলাশয়ে। গত দুই দশকে বরিশাল বিভাগে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১৫০%-এরও বেশী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন