মো. তোফাজ্জল বিন আমীন
২৪ আগস্ট কাকরাইলে প্রকাশ্য দিবালোকে জনাকীর্ণ প্রধান সড়কের ওভারব্রিজে বখাটের ছুরিকাঘাতে আহত হয় কিশোরী সুরাইয়া আক্তার রিশা। সে রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্ট্রম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় রমনা থানায় রিশার মা তানিয়া হোসেন বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের বৈশাখী টেইলার্সের কাটিং মাস্টার ওবায়দুল খানকে আসামি করা হয়। পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, প্রায় ছয় মাস আগে রিশা মায়ের সাথে গিয়েছিল স্কুলের ড্রেস বানাতে। এটি তৈরি করতে দেয়া হয়েছিল এলিফ্যান্ট রোডে ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের একটি টেইলারিং দোকানে। খুনি ওবায়দুল ওই দোকানের কাটিং মাস্টার। দোকানের রসিদ থেকে সে ফোন নম্বর পেয়ে রিশাকে উত্ত্যক্ত করত। ফোন নম্বরটি বন্ধ করে দেয়া হলে ওবায়দুল স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে রিশাকে উত্ত্যক্ত করতো। তবু রিশা ওই বখাটের কথিত প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। তার কুপ্রস্তাবে সাড়া না দেয়ার কারণে রিশার জীবন কেড়ে নেয় ওই নরঘাতক।
জাতিসংঘের বয়সের হিসাব অনুযায়ী রিশা বয়সে শিশু। শিশু অধিকার নিয়ে বিধিবিধান প্রণীত হয়েছে। সর্বজনীন ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ। তারপরেও শিশুর বাসযোগ্য বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্র বা সরকার। শিশুর প্রতি নৃশংসতা এটাই প্রথম তা নয়! যে সময়ে রিশা হত্যা নিয়ে এ লেখা লিখছি সে সময়েও পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়েছে বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলায় সাদিয়া আকতার নামের এক স্কুলপড়–য়া মেয়েকে খুন করেছে এক পাষা- বাবা। শিশুর প্রতি নৃশংসতা থেমে নেই। ফুলের মতো শিশুদের হত্যা করতে নরঘাতকরা কুণ্ঠাবোধ করছে না। দেশে যখন আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হয় তখনই হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ, ধর্ষণের বীভৎসতা বেড়ে যায়। রিশার অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবরটি যে কোনো সুস্থ বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে দুমড়েমুচড়ে দেবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই সমাজে রিশার মতো শিশু মেয়েদের জীবন ও ইজ্জত যেন কচুপাতার পানিতে পরিণত হয়েছে। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো তাকে।
রিশার মৃত্যু শুধু এক স্বপ্নের অপমৃত্যু নয়, এর দ্বারা এই সমাজের অন্ধকারের দিকটা ভেসে উঠেছে। ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়েটির করুণ মৃত্যুর দায় সমাজ ও রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। আমরা যে সমাজে বসবাস করছি সে সমাজে নানা ধরনের অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিছু অপরাধ চরম রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে ইভটিজিং বা যৌন হয়রানি উল্লেখযোগ্য। ওইসব অপরাধীর অব্যাহত দৌরাত্ম্যে আমাদের দেশের মেয়েদের লেখাপড়া, যাতায়াত, বিয়ে ও সাংসারিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে উঠেছে। ইভটিজিংয়ের ব্যাধি অতীতে ছিল না এমনটা বলা যাবে না। তবে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে ইভটিজিংয়ের ভয়াবহতা বহুগুণ বেড়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৪৮ জন। এর মধ্যে ইভটিজিংয়ের ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৫৭ জন আহত হয়েছে। একশ্রেণীর নেত্রী আছেন যারা নারীদের অধিকারের কথা বলে ইসলাম বিদ্বেষ প্রচার করেন। তারা এখন কোথায়? তাদের চেতনা আর কত রিশা হত্যার পর জাগ্রত হবে? ইসলাম নারীর যে অধিকার দিয়েছে তা যদি আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকত তাহলে নারীর ইজ্জত ও জীবন এভাবে ভূলুণ্ঠিত হতো না। প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে ধর্ষণ থেকে শুরু করে হাজারো রকমের নারী নির্যাতনের খবর দেখতে হয়। গ্রামের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ ও করুণ। গ্রামের হাজারো মেয়ে রিশার মতো বখাটেদের ভয়ে স্কুলে যেতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ রাজনৈতিক কারণে এ ধরনের অপরাধের অধিকাংশেরই সঠিক বিচার হচ্ছেনা। রিশা হত্যার দায় আসলে আমাদের সবার। আইন আগের চেয়ে কঠোর হলেও বখাটেরা আগের মতোই অবাধে ও বেপরোয়াভাবে মেয়েদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। আমরা মনে করি, সামাজিকভাবে এই অবক্ষয় প্রতিরোধ করতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে আরো রিশার জীবন হুমকির মুখে পড়বে। আমরা রিশার ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি, যাতে করে আর কোনো নরঘাতক নতুন কোনো রিশার জীবন কেড়ে নিতে সাহস না দেখায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন