শবে বরাত মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। মহিমান্বিত এক রাত। কিন্তু এ দিনটিকে অজ্ঞতা বা অন্য যে কারণেই হোক আমরা হয় বাড়াবাড়ি না হয় ছাড়াছাড়ির পর্যায়ে নিয়ে গেছি। নবী করিম (সা.) এর হাদীস ও সুন্নাহ থেকে শবে বরাত সম্পর্কে অতীতে আমরা আলোচনা করেছি। এ আলোচনায় আমরা কিছু বরেণ্য আকাবিরের উক্তিসমূহের সার-সংক্ষেপ উল্লেখ করা সঙ্গত মনে করছি। এ পর্যায়ে শুধু নির্বাচিত ব্যক্তিদেরই উক্তির ভাবানুবাদ সংক্ষিপ্তভাবে উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ করা হচ্ছে। তাঁদের হুবহু উক্তি উদ্ধৃত কিতাবসমূহে দেখা যেতে পারে।
১. শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে আব্দুল হালীম ৭২৮ হি.) : শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, ‘পনেরো শাবানের রাতের ফজিলত সর্ম্পকে একাধিক ‘মারফ‚’ হাদীস ও ‘আসারে সাহাবা’ বর্ণিত রয়েছে। এগুলো দ্বারা ওই রাতের ফজিলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয়। সালাফে সালেহীনের কেউ কেউ এ রাতের নফল নামাজের ব্যাপারে যতœবান হতেন। আর শাবানের রোজার ব্যাপারে তো সহীহ হাদীসসমূহই রয়েছে।
কোনো কোনো আলেম যদিও এই রাতের ফজিলত অস্বীকার করেন; কিন্তু হাম্বলী ও গায়রে হাম্বলী অধিকাংশ আলেমই এই রাতের ফজিলতের কথা স্বীকার করে থাকেন। ইমাম আহমাদ রাহ.-এর মতও তাই। কেননা এর ফজিলত সম্পর্কে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং এগুলোর সমর্থনে সালাফ (সাহাবী ও তাবেয়ী)-এর ‘আসার’ও বিদ্যমান আছে; যেগুলো ‘সুনান’ ও ‘মুসনাদ’ শিরোনামে সংকলিত হাদীসের কিতাবে (বরং কতক ‘সহীহ’ শিরোনামের কিতাবেও যেমন সহীহ ইবনে খুযাইমা (কিতাবুত তাওহীদ) সহীহ ইবনে হিব্বান প্রভৃতিতে) রয়েছে।
অবশ্য শুধু পনেরো তারিখের দিনে রোজা রাখার ব্যাপারে যত্মবান হওয়া মাকরূহ। (ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর মত এটিই। তার মতে পনেরো তারিখের সাথে দু-একদিন মিলিয়ে নেয়া উত্তম।) আর এই দিন বা রাতে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা এবং সাজ-সজ্জার ব্যাপারে যত্মবান হওয়া ইত্যাদি বিদআত ও ভিত্তিহীন। তেমনি এই রাতে ‘সালাতে আলফিয়া’ নামের মনগড়া নামাজের জন্যে সমবেত হওয়াও বিদআত।’ (ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ২/৬৩১-৬৩২)
ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর যুগে ‘সালাতে আলফিয়া’-এর রেওয়াজ ছিল। লোকেরা একটি জাল রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে মনে করত যে, শবে বরাতে প্রতি রাকাতে ১০ বার করে সূরা ইখলাস পড়ে ১০০ রাকাত নফল নামাজ পড়া উচিত।
উক্ত রেওয়ায়াতটি সম্পূর্ণই জাল। (আললাআলিল মাসনূআ, ইমাম সুয়ূতী ২/৫৮-৬০; আলফাওয়াইদুল মাজমূআ, ইমাম শাওকানী ১/৭৬) আমার জানা মতে আজ কোথাও এর রেওয়াজ নেই। তবে এর স্থলে ‘মকসূদুল মুমিনীন’-এর বাতানো পদ্ধতির মনগড়া একটি নামাজ কতিপয় লোকের মাঝে প্রচলিত রয়েছে। মনে রাখতে হবে, ‘মকসূদুল মুমিনীন’-এর ওই বিশেষ পদ্ধতির নামাজ ও এর রেওয়ায়াতসমূহ সবই ভিত্তিহীন। (দেখুন, চলতি সংখ্যার প্রচলিত ভুল বিভাগ) এসব পরিহার করে এই রাতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাধারণ নফল নামাজের মতো নফল নামাজ পড়া উচিত। হাদীস দ্বারা শুধু এতটুকুই প্রমাণিত হয় যে, এই রাতের নফল হবে লম্বা, সেজদা হবে দীর্ঘ দীর্ঘ। দু’রাকাত করে যত ইচ্ছা পড়া যাবে; রাকাত সংখ্যাও নির্দিষ্ট নেই; কোনো নির্দিষ্ট সূরার সীমাবদ্ধতাও নেই। (আলআসারুল মারফ‚আ, আল্লামা আব্দুল হাই লাখনোভী : ৮০-৮৫; মারাকিল ফালাহ শরহে নূরুল ইযাহ : ২১৯)।
২. শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. (১০৫২ হি.) : তিনি তার ‘মা সাবাতা বিস্সুন্নাহ ফী আইয়ামিস সানাহ’ (যার উর্দূ অনুবাদ ‘মুমিন কে মাহ ও সাল’ নামে করাচি থেকে আরবিসহ প্রকাশিত হয়েছে)-এ যেখানে তিনি এই রাতের ফজিলত তুলে ধরেছেন, পাশাপাশি এই রাত সম্পর্কে কিসসা-কাহিনীকারদের বানানো মিথ্যা ও বাতিল বিষয়াবলির খন্ডন করেছেন এবং সেসব গর্হিত বিষয়েও সতর্ক করেছেন যেগুলো পরবর্তী লোকেরা আবিষ্কার করেছে।
তিনি বলেন, ‘এই রাতের নিকৃষ্টতম বিদআতসমূহের মাঝে নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত- ঘর-বাড়ি, দোকান-পাটে আলোকসজ্জা করা, খেলাধুলা ও আতশবাজির উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়া ইত্যাদি। এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং এগুলোর সপক্ষে কোনো জাল রেওয়ায়েতও কোথাও নেই। প্রবল ধারণা যে, এগুলো হিন্দুদের ‘দেওয়ালী’ প্রথা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।’ (মা সাবাতা বিস্সুন্নাহ : ৩৫৩/৩৬৩)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন