বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পঞ্চাশ বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে?

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:০২ এএম

কোনো দেশের জন্য সময়ের হিসাবে ৫০ বছর কম-না বেশি, এ নিয়ে মত-দ্বিমত থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে শিক্ষাব্যবস্থা ও এর কাঠামোকে সময়োপযোগী করার মতো যথেষ্ট সময় পাওয়া গেছে। শিক্ষাকে সময়োপযোগী ও কর্মমুখী করার সুযোগ হয়েছে। এ দুটোর কোনোটিই যে যথাযথভাবে হয়েছে তা বলা যায় না। কেন করা যায়নি এবং ব্যর্থতা কোথায় তা পঞ্চাশ বছরের নিরিখে নিরূপণ করার সময় এসেছে। দরকারও বটে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতি এক জায়গায় থাকেনি। বরং বহু ধারায় বিভক্ত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রধানত চারটি ধারায় বিভক্ত। সেগুলো হলো সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যম, মাদরাসা শিক্ষা ও ক্যাডেট শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিবন্ধিত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনিবন্ধিত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা ইত্যাদি। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো হলো কিন্ডারগার্টেন ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল (ব্রিটিশ কারিকুলাম, এনসিটিবি কারিকুলাম, ইত্যাদি)। মাদরাসা শিক্ষায়ও দুইটি ধারা। একটি আলিয়া মাদরাসা, অন্যটি কওমী মাদ্রাসা।

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, একটি শিশুকে তার অভিভাবক পাঠদানের জন্য কোন ধারায় নিয়ে যাবেন তা সবসময় ঐ অভিভাবকের আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। যেমন অপেক্ষাকৃত বেশি বেতনের স্কুলগুলোতে ভালো মানের শিক্ষা পাওয়া যায়। বাবা-মা সামর্থ্যবান না হলে সন্তানের জন্য অল্প বেতনের স্কুলে সন্তানদের পড়ান। প্রাথমিক শিক্ষার মতোই বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে মেধাবী ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এক্ষেত্রেও শিক্ষকদের বেতনভাতা ও স্বীকৃতির অভাব মেধাবীদের এই পেশায় টানছে না। মাধ্যমিক স্তরে বিশেষ করে ইংরেজী ও গণিত শিক্ষকের অপ্রতুলতাই শিক্ষার্থীদের বেশি ভোগাচ্ছে। আবার কারিগরি শিক্ষা অনেকটা অবহেলিত। এ শিক্ষায় শিক্ষিতের হার মাত্র ৩ শতাংশ। অথচ উন্নত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। দেশের কারিগরি শিক্ষা খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আধিক্য থাকলেও শিক্ষার মান এবং বৈষম্য বিরাজমান। শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার হার বাড়লেও বাড়েনি শিক্ষার মান। অথচ শিক্ষা খাতে ব্যয়-বরাদ্দ কমেনি। কেবল বেড়েছে। ১৯৭২ সালে ৪৩ কোটি টাকার শিক্ষা বাজেট ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার কোটি টাকা। ৩০ ভাগ স্বাক্ষরতার হার বেড়ে হয়েছে ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ। একইভাবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সাড়ে ৭ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ । ১৯৭২ সালে প্রায় ২৪ লাখ শিক্ষার্থী থাকলেও বর্তমানে তা চার কোটিরও বেশি। বেড়েছে শিক্ষক সংখ্যাও। পৌণে এক লাখ থেকে এ সংখ্যা এখন ১৩ লাখের বেশি। শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন র‌্যাঙ্কিংয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান পড়ে যাওয়া শিক্ষাসচেতনদের জন্য কষ্টদায়ক। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষার সনদ নিয়েও শিক্ষার্থীদের বেকারত্বের বোঝা বইতে হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাস্তব ও কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ, তা দিয়ে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা বৈষম্যহীন করার চিন্তা ¯পষ্ট নয়। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে পূর্ণতা দিতে দরকার ছিল সুশিক্ষা ও দক্ষ মানবস¤পদ তৈরি। সরকারিমহল থেকে এই দরকারি কথা গত ৫০ বছর ধেরেই শোনানো হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া খাতগুলোর একটি হিসেবে ব্যয়-বরাদ্দও দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাখাতকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের ছয় মাসের মধ্যেই শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে গঠন করা হয় একটি কমিশনের। ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে গঠিত কমিশনটি ১৯৭৪ সালের ৩০ মে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে শিক্ষাব্যবস্থার অভাব, ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো একটি জাতি গড়ে তুলতে সুচিন্তিত অনেক পরামর্শ ছিল। পরবর্তীতে প্রণীত পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতিতেও এই কমিশনের প্রভাব ¯পষ্ট। আমাদের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে রাষ্ট্রীয় অন্যতম নীতি হিসেবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা স্থান পেয়েছে। সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে রাষ্ট্র: (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যমূলক শিক্ষাদানের জন্য জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
সাংবিধানিক এমন বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডের জমতিয়েন সম্মেলনে সবার জন্য শিক্ষা বিশ্ব ঘোষণা আসার পর বাংলাদেশে পাশ হয় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন। ১৯৯২ সালে ৬৮টি থানাকে এবং ১৯৯৩ সাল থেকে দেশের সকল থানাকে এই আইনের আওতায় আনা হয়। এর প্রায় ১০ বছর পর ২০০৩ সালের ২ জুন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে রূপান্তর করা হয়। এর সুফল হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ঝরে পড়া কমেছে। শিক্ষার মূল ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। দেশে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার জন্য আইন ও বিধিবিধান রয়েছে। কম-বেশি এর সুফলও আসছে। একসময় শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিলো ছেলেদের তুলনায় নগণ্য। এখনকার চিত্র ভিন্ন। দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে শিক্ষার হার ৭৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে নারীশিক্ষার হার ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আর এই বয়সীদের মধ্যে পুরুষের শিক্ষার হার ৭৪ শতাংশ। এ হিসাবে নারীশিক্ষার হার পুরুষের চেয়ে ২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।
দিন দিন বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীও বাড়ছে। সমান্তরালে উচ্চশিক্ষিত বেকারও বাড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত জনশক্তি ব্যবহার করার কার্যকর পরিকল্পনা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তার মূল লক্ষ্য গবেষণা ও উদ্ভাবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আয়তনের তুলনায় দেশের জনসংখ্যা বেশি। সম্পদ সীমিত, সুযোগ-সুবিধাও কম। এই প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত শিক্ষিত করার বাস্তবমুখী গবেষণাও কম। উচ্চশিক্ষা মূলত গবেষণাধর্মী। কিন্তু উচ্চশিক্ষাতে গবেষণা নেই বললেই চলে। পড়াশোনার লক্ষ্যই যেন হয়ে পড়েছে সরকারি বা বড় অংকের বেতনের চাকরি। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘দেশের সবাই যদি চাকরির পেছনে ছোটে, তাহলে তো দেশটা চাকরে ভর্তি হয়ে যাবে; মালিক থাকবে না।’ বাস্তবতা হচ্ছে, প্রকৃত শিক্ষা নিশ্চিত করা না হলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। চলমান সার্টিফিকেটসর্বস্ব বেকার তৈরির শিক্ষাই চলতে থাকবে। দেশের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানে যে অস্থিরতা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নৈরাজ্য চলছে, তা দেশের জন্য ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখনও সেকেলে সিলেবাস ব্যবহার করা হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষিত বের হচ্ছে ঠিকই, একই সাথে শিক্ষার সাথে কর্মক্ষেত্রের সমন্বয় না থাকায় বেকারত্বের হারও বাড়ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকাংশে ‘শিক্ষিত’ বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। এ দুরবস্থা থেকে উত্তরণের দায়িত্ব শিক্ষক তথা শিক্ষা প্রশাসনের। উচ্চ শিক্ষার চাহিদা আর শিক্ষার্থীর অনুপাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এই যুক্তির ভিত্তিতে ১৯৯২ সালে সরকার প্রণয়ন করেছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইন। কিন্তু এর সমাধান কোনোভাবেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির মধ্যে দিয়ে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকারকে যুগোপযোগী কর্মমুখী শিক্ষা নীতি প্রণয়ন ও পর্যাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার সাথে মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বোধের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকে আবিস্কার করতে শেখে। তার শ্রেণী চেতনার বিকাশ সাধন হয়। সে তার চারপাশের জগতকেও সচেতনভাবে পরিবর্তন করতে চায়। এতে উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্র তৈরি হয়। দুঃখের বিষয়, আমাদের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতি সেই আশা দেখায় না।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack Ali ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:৪৩ পিএম says : 0
If our country rule by Qur'an then Our Education System would be based on Science and Technology. In the past muslim were super power and and also far ahead in Science and Technology because Allah ordered muslim to ponder upon deeply when you read Qur'an.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন