শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন কারিকুলাম কতটা উপযোগী?

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার | প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০২২, ১২:০৩ এএম

শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন কারিকুলাম প্রকাশের পর থেকেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে চলছে আলোচনা সমালোচনা। পক্ষে-বিপক্ষে, ভালো-মন্দের দিক নিয়ে আলোচনা করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে বারবার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠিত হয়, যা কুদরাত-এ-খুদা কমিশন নামে পরিচিতি পায়। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর পূর্বে ৬টি কমিশন কাজ করে। কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, শিক্ষা ব্যবস্থায় সকল বিষয় কার্যকর হয়নি বা অনেক কমিশনের রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। বারবার শিক্ষা পদ্ধতিতে রদবদল করেও সঠিক মান অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই মনে হয়। এতে শিক্ষা ব্যবস্থা অগোছালোভাবই প্রকাশ পেয়েছে। তবে একথা ঠিক নয় যে, শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন করা যাবে না। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা কারিকুলামেও পরিবর্তন আসবে। তবে ঘনঘন পরিবর্তন কাম্য হতে পারে না। এতে শিক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত আসে, বিশৃংখলা দেখা দেয়। গত দুই যুগে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে দুটি বিষয় বেশি আলোচিত তার মধ্যে অন্যতম হলো, মুখস্ত নির্ভরতা কমিয়ে এবং নকল বন্ধের যুক্তিতে ১৯৯২ এমসিকিউ পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া ও বর্তমান সময়ে দক্ষতাভিত্তিক (এমসিকিউ) ও সৃজনশীল (সিকিউ) প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণ। এ দুটি বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকলেও একথা বলা যায় যে, শিক্ষা ব্যবস্থায় এনীতিা কার্যকর ফল দেয়নি। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, এ দুটি পদ্ধতি বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষে যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তা নেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীদের অধিক যাচাইয়ের কথা বলা হলেও সেভাবে প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয়নি, এমনকি বাজারে প্রচুর পরিমাণে গাইড বইয়ের আগমন ঘটে। যার ফলে এ পদ্ধতি থেকে সুফল পাওয়া সম্ভব হয়নি। ২০১০ সালে মাধ্যমিক স্তরে, ২০১১ সালে দাখিল ও ২০১২ সালে এইচএসসি পর্যায়ে দক্ষতাভিত্তিক সৃজনশীল পদ্ধতি কার্যকর শুরু হয়। মুখস্ত করার যে প্রক্রিয়া, তা থেকে বের হয়ে আসার কথা থাকলেও নীতি বাস্তবায়ন করতে না পারায় তা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি অনুমোদন পাওয়া বিষয়গুলো আলোচনার পূর্বে জানা দরকার কি কি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন রয়েছে নতুন কারিকুলামে। সম্প্রতি চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২২’ থেকে জানা যায়, এ শিক্ষানীতি কার্যকর হবে আগামী শিক্ষা বছর থেকে। ২০২৩ সালে প্রাথমিকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এবং ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এ কারিকুলামে পাঠদান করা হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে পুরোপুরি কার্যকর হবে এ কারিকুলাম। কারিকুলামে উঠে আসা মূল আলোচিত বিষয়গুলো হলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুদিন ছুটি, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখা, সব শ্রেণিতেই শিক্ষকদের হাতে নম্বর, পিএসসি, জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা বাতিল, স্কুল পর্যায়ে বিভাগ বিভাজন না থাকা, পাবলিক পরীক্ষায় যোগ হবে শিখনকালীন মুল্যায়ন, এসএসসি পরীক্ষা পদ্ধতি বদল এবং একাদশ ও দ্বাদশে আলাদা পাবলিক পরীক্ষা। প্রথমেই সার্বিক বিষয় যেটি এসেছে তা হচ্ছে, আগামী বছর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকবে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত। কিন্তু কেন এ বন্ধ? তা থেকে কি লাভ হবে শিক্ষা ব্যবস্থার? এ ক্ষেত্রে হয়তো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একটু রিলাক্স হতে পারে, যা দুটি পক্ষকেই পাঠ্যক্রমে মনোযোগী করে তুলতে পারে। এবার নজর দেওয়া যাক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল পরিবর্তিত বিষয়ের দিকে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকছে না। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা (পিএসসি) যা চলে আসছে ২০০৯ সাল থেকে এবং ২০১০ সালে শুরু হওয়া ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষা (পিডিসি) বন্ধ হচ্ছে শিক্ষাথীদের উপর থেকে চাপ কমানোর লক্ষ্যে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাবিদরা এ ব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এসব পরীক্ষা বাদ দেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে পড়া লেখার আগ্রহ কমে যেতে পারে বলে অভিভাবকরাও চিন্তিত। মাধ্যমিক পর্যায়ে বাতিল হচ্ছে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষাও। এসব পরীক্ষা বাদ দেওয়ার ফলে প্রাইভেট ও কোচিং প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে এটা সকলের বিশ্বাস। এসব পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর শিক্ষক ও পেশাদার কিছু প্রাইভেট টিউটর প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য ঘরে তুলেছিল। সবচেয়ে বড় যে পবির্তনটি লক্ষণীয় তা হলো, বিভাগ বিভাজন তুলে দেওয়া। এটা নিয়ে শিক্ষক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। একটা পক্ষ বলছে, এতে করে একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের বিষয়গুলো আয়ত্বে আনতে কষ্ট হবে বিশেষ করে বিজ্ঞান বিভাগের। যষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও গণিতেও শ্রেণিকক্ষে শিখনকালীন মূল্যায়ণ করা হবে ৬০ ভাগ। আর পরীক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক মূল্যায়ণ করা হবে ৪০ ভাগ। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় শিখনকালীন মূল্যায়ণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কতটা কার্যকর? ঠিক একইভাবে নবম ও দশম শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ণ ৫০ আর পরীক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক মূল্যায়ণ ৫০ ভাগের কথা বলা হয়েছে। আর কিছু বিষয় থাকেবে কেবল শিখনকালীন মূল্যায়ণের উপর। এ নীতির আলোকে এটা স্পষ্ট যে, ক্লাসের উপর গুরুত্ব দিয়ে পরীক্ষা পদ্ধতির উপর চাপ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় এ পদ্ধতি বাস্তবায় করার জন্য আমাদের শিক্ষক সমাজ কতটুকু প্রস্তুত? বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভালো মানের শিক্ষক সংকট চরমে। যার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ক্লাসে গুরুত্ব না দিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট ও কোচিংয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এসব পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে শিক্ষকদের ক্লাস করানোর ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালোমানের অধিক পরিমাণে শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিখনকালীন মূল্যায়ণের যে অংশটা পরীক্ষার সাথে অন্তর্ভুক্ত হবে তার প্রয়োগটা সঠিকভাবে হওয়া উচিত। আমরা ইতোমধ্যে ব্যবহারিক পরীক্ষার যে নম্বর প্রেরণ করি তা আদৌ সঠিকভাবে হয় কিনা তা ভেবে দেখা উচিত। শিখনকালীন নম্বর পরীক্ষায় যোগ হওয়ার কারণে এক শ্রেণির শিক্ষকদের প্রাইভেট কোচিং বাণিজ্য বেড়ে যেতে পারে যার ফলে সরকারের এ উদ্যোগের বাস্তবায় কঠিন হবে। সর্বশেষ যে বিষয়টি লক্ষণীয়, তাহলো একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেনিতে প্রতি বর্ষের শেষে আলাদা চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া। দুই ক্লাসের ফল সমন্বয় করে দেওয়া হবে এইচএসসি ও সমমানের পাবলিক পরীক্ষার ফল। এখানের শিখনকালীন নম্বর যোগ করার কথা বলা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ কারিগরি বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত এইচএসসি (বিএমটি) পরীক্ষায় এ পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে। এ পদ্ধতিটি শিক্ষা ব্যবস্থায় মঙ্গল বয়ে আনবে বলেই মনে হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে নীতি নৈতিকতার বিষয়গুলির উপর চাপ বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের যেনতেনভাবে পাস করিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ ধারা থেকে বের হতে না পারলে যত শিক্ষানীতিই আমরা প্রণয়ন করি না কেন তা সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষার্থী বের হয়ে আসবে, যারা সমাজের বোঝায় পরিণত হবে। পৃথিবীর বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারিগরি শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাই সাধারণ শিক্ষার চেয়ে শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষায় উৎসাহিত করে তুলতে হবে এবং শিক্ষকদেরও সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় আসতে হবে যাতে করে সুশিক্ষায় জাতিকে সুশিক্ষিত করা যায়।

লেখক: শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন