আফতাব চৌধুরী
সাম্প্রতিক সময়ে সুশিক্ষা, মানব সম্পদ এবং শিক্ষার আধুনিকায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো জাতীয় স্বার্থে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। শুধু পরিমাণগত বিস্তার নয় গুণগতমানের শিক্ষা সুনিশ্চিতকরণ এখন সময়ের দাবি। বিশেষত কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির আগমন ও বিশ্বায়নের কারণে শিক্ষা এখন দেশ ও জাতির গ-ি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীদেরও একই ধারায় ঐ অঙ্গনে প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে সৃজনশীলতা বিকাশের বিষয়টিও।
শিক্ষার গুণগত মানসহ অনেক লক্ষ্যেই অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে প্রবর্তিত হয় গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফলাফল প্রকাশের বিষয়টি। এসএসসি ও এইচএসসিতে কার্যকরী হওয়ার পর উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও এটি সমন্বিতভাবে প্রয়োগের আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। এসএসসি ও এইচএসসিতে গ্রেডিং পদ্ধতি কার্যকর হওয়ায় একটি সুস্থ ধারার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীগণ স্ব স্ব মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির এটি একটি প্রত্যাশা পূরণ ও আশান্বিত হবার বিষয়। গ্রেডিং পদ্ধতির পাশাপাশি নকল প্রতিরোধে প্রশাসনের কঠোর অবস্থান, মাধ্যমিক সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষাসমূহের সময়সীমা নির্ধারণ ও নির্দিষ্টকরণ, উপস্থিতির বিষয়ে সতর্কতা ইত্যাদি কার্যক্রম ইতিবাচক এবং ফলপ্রসূ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং কিছুটা হলেও প্রাণসঞ্চার ঘটে এবং গতিময়তা পায়। বোর্ড কর্তৃপক্ষের কিছু নির্দেশনাও সহায়ক হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ আয়োজন করে কৃতি শিক্ষার্থীদের জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের। উদ্দেশ্য একটিই, আগামী নাগরিকদের উৎসাহ যোগানে আত্মবিশ্বাসী করা। এসএসসি-এইচএসসিতে অর্জিত ফলাফলের ভিত্তিতে সরকারিভাবে বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডে মেধাবৃত্তি প্রদান করে আসছে যা সবসময় উদ্দীপক ও সহায়ক ভূমিকা রাখছে। উপরন্তু এটি শিক্ষার্থী-অভিভাবক সকলের কাছেই সম্মানজনক বৃত্তি হিসেবে বিবেচিত এবং এটি উচ্চ শিক্ষা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা এতই ব্যয়বহুল, অনেক ক্ষেত্রে পণ্য হিসাবে বলা হয়ে থাকে। শিক্ষা উপকরণের পাশাপাশি সব অনুসঙ্গই ব্যয়বহুল, সাধারণের নাগালের বাইরে। এ কথা আমাদের সবার জানা যে, শিক্ষার ধারা বিশেষভাবে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরী অবদান রাখছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। এসব পরিবার সন্তানকে সুশিক্ষিত করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়াস চালান কিন্তু বাস্তবতা হল, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে মাঝপথে পড়াশোনার পাঠ-চুকাতে হয় যা জাতির জন্য বিরাট ক্ষতি ও দুভার্গ্যরে বিষয়। একথা সবাই স্বীকার করেন যে, দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের উপযুক্তভাবে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে এরা হয় পরিবারের সত্যিকারের সম্পদ। পরবর্তীতে এরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিবারের দায়িত্ব নেয়, শিক্ষার প্রসার ঘটায়।
আশার কথা, এসব মেধাবীর সমস্যা অনুধাবন করে, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখেই মেধাবীদের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম করতে বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, এনজিও, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘শিক্ষা ঋণ প্রকল্প’ চালু করেছে। শিক্ষা সমাপনান্তে কর্মজীবনে প্রবেশের পর এ ঋণ নির্ধারিত নিয়মে পরিশোধযোগ্য। এ ধরনের সুযোগ ও উদ্যোগ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। আমাদের দেশে এ উদ্যোগ আরো প্রসার লাভ করুক, শিক্ষার্থীরা নির্ভাবনায় পড়াশোনার সুযোগ লাভ করুক, এটাই কাম্য। শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি শিক্ষার মান উন্নয়নেও এটি পরোক্ষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। যেসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষা ঋণ দেবে তারা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অগ্রসরতার বিষয়টি নিরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে পারে। যেমন প্রতি বছর/টার্মে টাকা তোলার সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ফলাফল বিবরণী জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা বা এ ধরনের অন্য কিছু। অবশ্যই এসব ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যেন কোনভাবেই হয়রানির শিকার না হয় কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়টি দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের বরাদ্দ বা মঞ্জুরীকৃত ঋণের টাকা যেন সময়মতো শিক্ষার্থী বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে যায় তাও দেখতে হবে যাতে তাকে যেন ঋণের টাকার জন্য পড়ার সময় নষ্ট করতে না হয়, ঋণ কার্যক্রম সেভাবে পরিচালিত হবে। প্রাপ্ত সুযোগ ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীগণ প্রকৃত অর্থে সুশিক্ষিত হবে, অর্জিত শিক্ষা তাদের মূল্যবোধ অর্জন ও ভালভাবে বেঁচে থাকার উপকরণাদি উদ্ভাবন ও আয়ত্বকরণে সহায়তা করবে। এটাই প্রত্যাশিত। শিক্ষা ঋণ প্রকল্পের যথার্থ অর্থে আরো প্রসার ঘটুক সরকার বা বিভিন্ন ব্যাংক গবেষণার ক্ষেত্রে অর্থায়ন করার চিন্তা ভাবনা করুক, এটাও কাম্য।
কথা উঠেছে, বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী আকর্ষণের কৌশল হিসাবে এ প্রকল্প চালু করেছে তা হলে সেটি জাতির দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, আর্থিক বিষয় নিয়ে নতুন সংকটে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। মানুষ মানুষের জন্য। মানুষের শুভবোধের প্রতি আস্থা রেখে বলতে চাই সকল অপবাদ, প্রতিবন্ধিকতা দূর করে এ উদ্যোগ জাতির জন্য সুফল বয়ে আনুক। শিক্ষা গ্রহণ শেষ করে ঋণ গ্রহীতাগণ ঋণ পরিশোধের ধারাটি শুধু শিক্ষা সহায়ক হিসেবে নয় শিক্ষার অধিকার প্রাপ্তির সাথে দায়িত্ব পালনের বিষয়টিকে সুদৃঢ় করবে। একজন সুশিক্ষিত মানুষ তার বিবেকের স্বপক্ষে, নীতি ও মূল্যবোধ রক্ষায় দৃঢ়তার পরিচয় দিবে এটা সমাজ আশা করে।
বাংলাদেশে ক্রমাগত উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলছে সম্পদের বৈষম্য। বেসরকারি হিসাব মতে, এখনও শতকরা ৪০ জন মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করছে। বিষয়টির বাস্তবচিত্র দেখাতে আমাদের খুব বেশি দূর যেতে হয় না। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। অবস্থার পরিবর্তনে একটু ভাল থাকার আশায় গ্রামের ভিটেমাটি ছেড়ে অনোন্যপায় হয়ে শহরমুখী যারা তারা ক্রমান্বয়ে আরো অসহায় হয়ে পড়ছে। তাদের নতুন নামকরণ হচ্ছে ‘ছিন্নমূল’। শহরে রেল স্টেশন, বড় রাস্তার পাশে, রেল লাইনের ধারে গড়ে উঠে বস্তি। ঝড়, বৃষ্টি, রোদ সব মাথার উপর দিয়ে যায়। এ এক করুণ, অমানবিক, অসহায় অবস্থা। সারাদিনের পরিশ্রম করে কোন রকমে উদরপূর্তি। কোন রকমে প্রাণ টিকানো এইত চিত্র। উপরন্তু গ্রামে নিজ ভিটায় থাকাকালীন সন্তানকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর যে সুপ্ত ইচ্ছেটুকু ছিল, বৈরী পরিবেশের তপ্ত হাওয়ায় তা হারিয়ে যায়। গ্রামে খাবার কষ্ট থাকলেও শহরে কাজ করব খাব, এ আশায় গুড়ে বালি। বরং গ্রামের সৎ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত মানুষগুলো ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নানাবিধ অসামাজিক, অমানবিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে। মাকড়সার জালের মতো সমস্যার জাল তাদেরকে কেবল জড়িয়ে ধরে।
তাদের নিয়ে আমাদের আলাদা করে ভাবতে হবে, নিতে হবে প্রতিকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। অন্যথায় আমাদের শিক্ষার হার, স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সন্ত্রাস দমন সব হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। এরা (ছিন্নমূল) নিজের জন্য ভাবে না কিন্তু সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চায়, সুন্দর জীবন যেন তারা পায় তা দিতে চায়। কিন্তু পারে না, কারণ জীবন বাঁচান যখন দায় তখন অন্য ভাবনা স্থান পায় না। এদের সন্তানদের (প্রাথমিক) শিক্ষার আওতায় আনা প্রয়োজন। প্রয়োজন মানব সম্পদে পরিণত করা।
সাধারণত দেখা যায়, যেখানে বস্তি গড়ে উঠে সেখানে শিক্ষার সুযোগ থাকে না। শিক্ষার পরিবেশ তো নয়ই। বস্তিবাসীদের অধিকাংশই নিরক্ষর। সন্তানকে লেখাপড়ায় সাহায্য করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে সাধারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এদের নাম ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এছাড়া পরিবেশ অস্বাস্থ্যকরসহ আরো অনেক সমস্যাতো আছেই।
সমস্যার আলোকে সমাধান অর্থাৎ বর্তমানে যারা বস্তিতে রয়েছে তাদের সন্তানদের শিক্ষার আওতায় আনতে এবং গ্রামের ভিটে-মাটি ছেড়ে বস্তিবাসী হবার স্রোত বন্ধ করতে আমাদের স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সমন্বিতভাবে করা প্রয়োজন। আমরা দেখি, অনেক এনজিওও কিছু কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান এদের নিয়ে কাজ করছে। আমরা জানি, বলা যত সহজ কাজ করে লক্ষ্য অর্জন তত সহজ নয়। আবার এটাও প্রমাণিত, মানুষের সাহস, প্রজ্ঞা ও মমতার কাছে সবই পরাভূত। দারিদ্র্য নিরসনে দরিদ্রদের শক্তি ও সামর্থ্যকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের সরকারি-বেসরকারি অনেক ব্যাংক ও অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান, কৃষি ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক, বিসিক-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা দেশে প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছে। জাতীয় দায়বদ্ধতা থেকে সমন্বিতভাবে এদিকে লক্ষ্য রেখে উদ্যোগের মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদী ঋণ দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারে। প্রচলিত ব্যাংকিং এর পাশাপাশি প্রয়োজন হবে অতিরিক্ত কিছু প্রকল্প।
মানুষের জয়রথ ক্রমশ ধাবমান, আকাশ, সাগর জয় করে দৃষ্টিসীমা প্রসারিত দূরে আরও দূরে। আমাদের কাছে অতি কাছে অমিত সম্ভাবনাধারী মানুষের শিক্ষার সুযোগটুকু সমবেতভাবে অবারিত করা যায় না? পারিনা মানুষকে বোঝা না ভেবে সম্পদে পরিণত করতে? অনেক কাজ আমাদের করতে হবে কিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন সৎ মানুষের। সে সাদাকালোর নির্দেশিকা দেবে, বোধ জাগাবে শিক্ষাই। কাজেই সবার আগে চাই শিক্ষার সুযোগ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন