কে এস সিদ্দিকী
(২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিতের পর)
আবদুল মোত্তালেবের পুত্র কোরবানির মানত
স্বপ্নের ইশারা অনুযায়ী মহাত্মা আবদুল মোত্তালেব (তখন) একমাত্র পুত্র হারেসকে নিয়ে লুপ্ত জমজম কূপের সন্ধানে নির্দেশিত স্থানে গমন করেন এবং পিতা-পুত্র খনন কাজ আরম্ভ করেন। এক পর্যায়ে কূপের উপরিভাগ দেখা দিলে তিনি আনন্দে তকবীর বলে ওঠেন। খবরটি জানাজানি হলে তিনি কোরেশ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অবশিষ্ট খনন কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হন এবং মানত করেন যে, আল্লাহ তাকে দশটি পুত্র সন্তান দান করলে এবং তিনি তাদেরকে বলিষ্ঠ যুবক দেখতে পেলে তাদের একজনকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করবেন। এ বর্ণনায় প্রশ্ন আসে, আবদুল মোত্তালেব দশটি যুবক পুত্রের জন্য কূপের অবশিষ্ট খনন কাজ কত বছর স্থগিত রেখেছিলেন? এ প্রশ্নের জবাব কোনো লেখকের বর্ণনায় দেখা যায় না। এতে সংশয়ের উদ্রেক হতে পারে, বর্ণনাটি সঠিক হলে কূপ খননের কাজ দীর্ঘকাল বন্ধ ছিল। কিন্তু এটি কীভাবে যৌক্তিক হতে পারে যে, সুদীর্ঘকাল কূপটি লুপ্ত থাকার পর যখন আবিষ্কৃত হলো তখন বাধার মুখে খনন কাজ অসমাপ্ত থেকে যাবে দীর্ঘকাল। বিষয়টি আরো গবেষণাযোগ্য বলে মনে করি।
কিন্তু অপর বর্ণনা অনুযায়ী, উল্লিখিত সংশয়ের অবকাশ থাকে না। পূর্বে বলা হয়েছে যে, আমর ইবনে হারেস ইবনে মাযায জুরহুমী কাবা ত্যাগ করার সময় দুটি স্বর্ণ নির্মিত হরিণ ও পাথর নিক্ষেপ করে জমজমকে এমনভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলেন যে, দীর্ঘকাল যাবৎ কেউ চিহ্ন পর্যন্ত জানত না। আবদুল মোত্তালেব পুত্র হারেসকে নিয়ে খননকাজ আরম্ভ করলে দুটি হরিণ, কিছু তরবারি এবং কিছু লৌহ বর্ম বের হয়ে আসে। এ অবস্থা দেখে কোরেশরা বলে যে, এতে আমাদেরও অধিকার আছে। আবদুল মোত্তালেব মোকাবিলা করার পরিবর্তে বিষয়টি লটারির ওপর ছেড়ে দেন। লটারিতে হরিণ দুটি কাবার নামে এবং আবদুল মোত্তালেবের নামে আসে তরবারি ও লৌহ বর্মগুলো এবং কোরেশের নামে কিছুই আসে না। এভাবে আবদুল মোত্তালেব জমজম খনন করে তার সংস্কার করেন। সে সময় থেকেই জমজমের পানি হাজিদের কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে এবং মক্কার কূপগুলোর পানির প্রয়োজন আর থাকে না।
পুত্র কোরবানির স্বপ্ন
বর্ণিত আছে যে, জমজম কূপ খননকার্য সম্পন্ন করার পর একদিন আবদুল মোত্তালেব কাবা শরিফের কাছে নিদ্রা অবস্থায় ছিলেন। এ সময় তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, কেউ তাকে বলছে, হে আবদুল মোত্তালেব! ‘রাব্বুল বায়ত’ কাবার প্রতিপালকের কাছে তুমি যে মানত করেছ, তা পূরণ কর। নিদ্রা ভঙ্গের পর তিনি একটি দুম্বা কোরবানি করে মিসকিনদের খাওয়ালেন। দ্বিতীয় রাতেও তিনি নিদ্রা অবস্থায় একই স্বপ্ন দেখেনÑ হে আবদুল মোত্তালেব! তা অপেক্ষা বড় বস্তু দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ কর। জাগ্রত হয়ে তিনি একটি গরু কোরবানি করেন এবং দরিদ্র মিসকিনদের খাওয়া লেন। অতঃপর তৃতীয়বার স্বপ্নে দেখেনÑ হে আবদুল মোত্তালেব! তুমি তা অপেক্ষা উত্তম বস্তু দ্বারা নৈকট্য লাভ কর। জাগ্রত হয়ে তিনি একটি উট কোরবানি করে ফকির মিসকিনদের খাওয়ালেন। আবার যখন তিনি সেখানে নিদ্রা যান তখন স্বপ্নে দেখেনÑ হে আবদুল মোত্তালেব! তুমি আরো উত্তম বস্তু দ্বারা নৈকট্য লাভ কর। তখন আবদুল মোত্তালেব জিজ্ঞাসা করেন, এর চেয়ে উত্তম বস্তু আর কী হতে পারে? জবাব আসেÑ তুমি পুত্র কোরবানির জন্য যে মানত করেছিলে তা পূরণ কর।
আবদুল মোত্তালেব বিচলিত হয়ে জাগ্রত হন এবং তার পুত্রদের একত্রিত করে স্বপ্নের কথা জানালেন। সব ছেলে সন্তুষ্ট চিত্তে জবাব দেয় এই বলেÑ সম্মানিত পিতা! আপনি আমাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা কোরবানি করুন, আমরা রাজি। যখন লটারি করা হয়, তখন সবচেয়ে প্রিয় পুত্র আবদুল্লাহর নাম আসে। আবদুল মোত্তালেব ছোরাসহকারে আবদুল্লাহকে নিয়ে যখনই কাবার কাছে আসেন, যেখানে এসাফ ও নায়েলার প্রতিমা রাখা ছিল। আবদুল মোত্তালেব পুত্র আবদুল্লাহকে নিয়ে কোরবান গাহে পৌঁছালে কোরেশরা জিজ্ঞাসা করে, আপনি কি করছেন? তিনি আবদুল্লাহকে কোরবানি করবেন জানালে কোরেশরা নিষেধ করতে থাকে এবং বলে যে, আপনি যদি স্বীয় পুত্রকে কোরবানি করেন তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি তার পুত্রকে এখানে এনে কোরবানি করবে এবং এটি একটি প্রথা হিসেবে চালু হয়ে যাবে। আপনি কোনো পুরোহিতের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন, অবশ্যই কোনো উপায় বের হয়ে আসবে। এর পর আবদুল মোত্তালেব খায়বারে কাতবা নামে এক মহিলা পুরোহিতের কাছে যান এবং ঘটনা বর্ণনা করেন। মহিলা জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা একজন লোকের রক্তের বিনিময়ে কত আদায় করেন? জবাবে তিনি বলেন, দশটি উট। মহিলা বললেন, আপনি নিজের দেশে গিয়ে দশটি উটের নামে একটি লটারি নিক্ষেপ করুন এবং আবদুল্লাহর নামে যদি একটি লটারি আসে তাহলে আরো দশটি উঠের নামে লটারি বাড়িয়ে দেবেন। এ নিয়মে উটের নাম না আসা পর্যন্ত দশটি করে উটের নাম বৃদ্ধি করতে থাকুন। আবদুল মোত্তালেব প্রত্যাবর্তন করে লটারি নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং আল্লাহর কাছে এই মর্মে ফরিয়াদ করতে থাকেনÑ ‘হে আল্লাহ! আমি এদের মধ্যে একজনের কোরবানি মানত করেছিলাম, এখন তাদের প্রতি লটারি নিক্ষেপ করছি। তুমি যাকে ইচ্ছা তার নাম বের করে দাও।’
অপর একটি বর্ণনা হতে জানা যায় যে, লটারিতে প্রথম যখন আবদুল্লাহর নাম নির্দেশিত হয় তখন আবদুল মোত্তালেব আল্লাহর বিরাগভাজন হতে সাহসী হলেন না এবং আবদুল্লাহকে কোরবানি করতে উদ্যত হলেন। ইত্যবসরে আবদুল্লাহর কনিষ্ঠা বোন ওমায়মা এই নিদারুণ সংবাদ শুনে অশ্রু প্লাবিত হয়ে পিতার নিকট উপস্থিত হলেন এবং এই ভীষণ কার্যের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালেন। আবদুল মোত্তালেব তার কাতর ক্রন্দন সহ্য করতে না পেরে পুত্রের পরিবর্তে দশটি উট কোরবানি দেওয়ার জন্য পুরোহিতকে পুনরায় লটারি নিক্ষেপ করতে বলেন এবং লটারি আবদুল্লাহর নাম নির্দেশ করতে থাকে। অবশেষে একশ উটের সময় আবদুল্লাহর স্থলে উটের নামে লটারি ওঠে। আবদুল মোত্তালেব একশ উট কোরবানি করে প্রাণপ্রতিম পুত্রের প্রাণ রক্ষা করেন।
উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পূর্ব পুরুষ হজরত ইসমাঈল (আ.) ও তার পিতা আবদুল্লাহকে জবাই করার জন্য উৎসর্গ করা হয়েছিল। এ ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর নির্ভর করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলতেনÑ ‘আনা ইবনুজ-জাবিহাইন’Ñ আমি জবাই করার জন্য উৎসর্গকৃত দুই ব্যক্তির সন্তান।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পিতা হযরত আবদুল্লাহর প্রাণ রক্ষা পাওয়ায় সাধারণভাবে কোরেশদের মধ্যে এবং বিশেষভাবে আবদুল মোত্তালেবের মনে আনন্দ-উল্লাসের যে ঢেউ খেলছিল তা বর্ণনাতীত। কেননা, কোরেশদেরও আশঙ্কা ছিল, আবদুল্লাহ রক্ষা না পেলে ভবিষ্যতে তাদেরকে পরিবারপ্রতি একটি করে সন্তান কোরবানি করতে হবে এবং আরবে পুত্র কোরবানির প্রথা চালু হয়ে যাবে।
লুপ্ত জমজম কূপ অনুসন্ধানের নেপথ্যে ছিল একটি স্বপ্নের ইশারা। আর স্বপ্নের বাস্তবায়নে ছিল আবদুল মোত্তালেবের একটি পুত্র কোরবানির মানত। এ মানত পূরণ করতে গিয়ে সে যুগে প্রচলিত লটারির সাহায্য নিতে হয়েছে এবং লটারির মাধ্যমেই আবদুল্লাহর পরিবর্তে একশ উটের নাম আসায় তিনি বেঁচে যান। তিনি ছিলেন মহানবী (সা.)-এর মহান পিতা। তারা সবাই ছিলেন জাবীহুল্লাহ হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধরÑ অধস্তন পুরুষ যিনি ছিলেন তার মহান পিতা হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর স্বপ্নে আদিষ্ট কোরবানিতে উৎসর্গকৃত। তার পিতা আল্লাহর আদেশে পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর স্থলে একটি পশু (দুম্বা) কোরবানি করে ছিলেন। ১০০ উটের বিনিময়ে আবদুল্লাহ এবং একটি দুম্বার বদলে ইসমাঈল (আ.) বেঁচে যান। ফলে গোটা মানব জাতি ‘মানুষ বলি’ হতে বেঁচে যায়। (সমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন