বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

লকডাউন : কার্যকরই বড় চ্যালেঞ্জ

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার | প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৭ এএম

ছোট দেশ। প্রচুর মানুষ। চাহিদা বেশি। প্রাপ্তি কম। নেই-এর পাল্লা ভারী। ফলাফল হতাশা। এত সব চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভালো থাকা- এ যেন কেবলই বেঁচে থাকা। সারা পৃথিবীর ন্যায় আমাদের বাংলাদেশও আক্রান্ত করোনায়। বির্পযস্ত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। দেশের মানুষ অনেকটাই নির্ভার হয়েই গিয়েছিল হয়তো মুক্তি মিলেছে করোনা থেকে। কিন্তু এর মধ্যেই শুরু হয়েছে আবার করোনার ভয়াবহতা। যে লকডাউন শব্দটি মানুষের মুখ থেকে চলে যাচ্ছিল, সেটি আবার চলে এলো আরো জটিল আকারে। এ পরিস্থিতিতে জীবনকে চালিয়ে নেয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম করতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষদের। যাদের দু’বেলা খাবার জোগাড় করার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়। এ শ্রমের অর্থে চুলায় খাবারের হাঁড়ি বসে। গত বছর করোনা শুরুর সময় থেকে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল তার চেয়ে এবছর আরো বেশি হওয়ার আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের পক্ষ থেকে আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। বিভিন্ন কারণে ইচ্ছে করলেই প্রয়োজন মতো লকডাউন দেওয়া সম্ভভপর হয় না সরকারের পক্ষে, এ কথা অনেকের পক্ষেই বুঝা কঠিন। মানুষের জীবন বাঁচানো যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি খেয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখাও সরকারের একটা দায়িত্ব। উচ্চ আয়ের মানুষ যেমন স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, ঠিক তেমনি নিম্ন আয়ের মানুষও সরকারের মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা ঘোষণা করেছে। এই ১৮ দফা নির্দেশনার কিছু অংশ মেনে চলছে জীবন সংগ্রাম। একদিকে পেটের চিন্তা, অন্যদিকে বেঁচে থাকা। দুটোর মধ্যে সেতু তৈরি করতেই মূলত এ নির্দেশনা। যেসব নির্দেশা প্রদান করা হয়েছে সত্যিকার অর্থেই সকল নির্দেশনা বাস্তবায়ত করা গেলে অবশ্যই করোনা থেকে আমরা দূরে থাকতে পারবো, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে এতে মানুষের স্বাভাবিক কর্মজীবনে ব্যাঘাত ঘটবে, সেটা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে, খেটে খাওয়া মানুষের চিন্তা অনেকটাই বেশি। কারণ স্বাভাবিক কাজ কর্ম বন্ধ থাকলে তাদেরই বেশি ক্ষতি। এসব খেটে খাওয়া মানুষের প্রয়োজনীয় অভাব থেকে মুক্ত রেখে দীর্ঘদিন চালিয়ে নেওয়া সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয়।

অন্যদিকে দেখা যায়, শহর এবং গ্রামের লকডাউনের চিত্র ভিন্ন। এ যেন ভিন্ন দেশ, ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন দর্শন। গ্রামের ক্ষেত্রে যেন করোনার সংজ্ঞাই পাল্টে যায়। সচেতনতার বালাই নেই গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থায়। ইতোমধ্যে দেশের প্রতিটি উপজেলায় মাঠ প্রশাসন লকডাউন কার্যকর করার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু এসব প্রস্তুতি দিয়েই কি জীবনযাত্রা লক করা সম্ভব? জীবন বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে ঘর থেকে বের হয়ে আসছে মানুষ। আবার অপ্রয়োজনেও মানুষ বাহির হচ্ছে। সরকারের যেসব প্রস্তুতি মাঠ পর্যায়ে রয়েছে তাতো অনেকটাই আইন মানতে বাধ্য করার প্রস্তুতি। অন্যদিকে আমাদের দেশের মানুষ আইন ভাঙ্গতেই পছন্দ করেন বেশি। অনেক ক্ষেত্রে আইন না মানাটা সমাজের মানুষের একটা অংশ ক্রেডিট মনে করেন। এই অবস্থায় সরকারের মানুষকে ঘরে রাখার পলিসি কতটা কার্যকর করতে পারবে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। তথাপি ভেবেচিন্তে মানুষের কল্যাণে আইনের প্রয়োগ ঘটানো জরুরি। যেদিন লকডাউন ঘোষণা করা হলো সেদিন থেকেই দল বেঁধে মানুষ শহর ছাড়তে শুরু করে। অথচ, এসব বিধি কার্যকর করার জন্য মানুষকে কিছু দিন নিজ নিজ অবস্থানে রাখাই শ্রেয় ছিল। কিন্তু শহর ব্যবস্থায় জীবনকে ধরে রাখতে হলে কর্মের বিকল্প নেই। গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থা থেকে শহরের জীবন ব্যবস্থা অনেক ব্যয়বহুল এবং বেশি যান্ত্রিক।

ইতোমধ্যে সারাদেশে লকডাউন বিরোধী আন্দোলনও দানা বেঁধে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের দাবি রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলে দেওয়ার জন্য। গত বছরও করোনার কারণে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়। তাদের দাবির মুখে ৯ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার অনুমোতি দিয়েছে সরকার। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এবারের লকডাউন আর বিগত বছরের লকডাউনের মধ্যে সরকার অনেকটাই পার্থক্য রেখেছে, এটা সকলকে অনুধাবন করতে হবে। এটাকে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর বিধি নিষেধ নামেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। অবশ্য বিষেজ্ঞরা বলছেন, এ লকডাউন করোনা প্রতিরোধে বাস্তবসম্মত কোনো ভূমিকা নয়। প্রশাসনের লোকজন জনগণকে সম্পৃক্ত করে মাঠ পর্যায়ে লকডাউন বাস্তবায়ন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে করেও খুব একটা সুফল আসছে বলে মনে হয় না। সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনায় যেসব বিধিমালা আরোপ করা হয়েছে, এর মধ্যে অনেক ফাঁক রাখা হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। সরকারের চিন্তা হয়তো মানুষকে খেয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখা। অনেক জায়গায় কঠোর বিধি নিষেধ দেখাতে গিয়ে প্রশাসনকে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে বলেও জানা যায়। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় সরকার এসব বিধি নিষেধ বাস্তবায়নে অনেকটাই নমনীয়।

ইতোমধ্যে সকল সিটি কর্পোরেশনে গণ পরিবহন চলার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এমনিকি বিধি নিষেধ থাকলেও শহর থেকে গ্রাম পর্যন্তু সিএনজি অটো রিক্সা চলছে নিয়মিত। মানুষ বের হয়ে আসছে ঘর থেকে। কেবলমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় লকডাউনের বিধি নিষেধ দৃশ্যমান। মোট কথা হচ্ছে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ এখনও বুঝে উঠতে পারেনি করোনার ভয়াবহতা। করোনার করুণ অবস্থা মনের মধ্যে প্রবেশ না করলে আইন প্রযোগ করা সম্ভব নয়। উপজেলা পর্যায়ের বাজারে লকডাউনের কিছু চিত্র দেখা গেলেও গ্রাম পর্যায়ের বাজারগুলোতে অবস্থা ভয়াবহ। মানুষ বসবাসের ঘনত্ব শহর ব্যবস্থায় বেশি হওয়ায় করোনার ঝুঁকিটাও শহরে বেশি। করোনার সংক্রমণ রোধকল্পে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সময়োপযোগী হলেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া করোনা নির্মূল না হওয়ার পরও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারের বিধি নিষেধ কঠোর ছিল না বলে অনেকেই মনে করেন। এক্ষেত্রে সরকারের আরো কঠিন পদক্ষেপে থাকলে হয়তো করোনা থেকে মুক্তির পথটা সহজ হতো। সব কিছু মিলিয়ে সরকারের বর্তমান লকডাউন ব্যবস্থাটা বাস্তবায়ন করা অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে বাধ্য। তাতে করোনার প্রকোপ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং প্রচুর জানমালের ক্ষতি হবে, যা দেশের জন্য অশনি সংকেত। এ থেকে উত্তোরণের জন্য সরকারের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেমন জরুরি, তেমনি মানুষকে সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনা মেনে চলাও জরুরি। কারণ সরকারের পক্ষে কোন নীতিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব না, যদি জনগণ সহায়তা না করে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, এইসব বিধি-নিষেধ আমাদের জন্য এবং আমাদের বাঁচানোর জন্য। নিজে বেঁচে না থাকলে জীবিকা কিসের? প্রত্যেকেই তার নিজ পরিবারের জন্য একটি স্বপ্ন। স্বপ্নই যদি বেঁচে না থাকে তাহলে পরিবারের গতি থাকবে না। তাই করোনার বিস্তার রোধে সরকারের যাবতীয় বিধি-নিষেধ না মানার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য সর্বোপরি দেশের কল্যাণের জন্য আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।
লেখক: শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন