ছিটমহলের বাসিন্দারা অনেক আশা-ভরসা নিয়েই এসেছিলেন ভারতে। তবে সুখ-শান্তি তো দূরের কথা, বড় দুঃখ-কষ্টেই দিন অতিবাহিত হচ্ছে ৫৮টি পরিবারের। এখন তাদের বড্ড আপসোস। দুটো লোকসভা(একটা উপনির্বাচন), একটা পঞ্চায়েত, একবার বিধানসভায় ভোট দিয়েছেন। বিধানসভা নির্বাচনের দুদিন আগেই দিনহাটার আবাসনে ৬ বছর আগে ভারতে আসা ছিটমহলের বাসিন্দারা জানিয়ে দিলেন, তারা এখানে এসে সব হারিয়েছেন। ফিরে যেতে চান আগের জায়গায়। রাষ্ট্রহীন জীবনে নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তবে তারা মনে করছেন ভারতে এসে জীবন বিপন্ন হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের জয়প্রকাশ দাস ছিটমহলের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানিয়েছেন তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা।
গত বৃহস্পতিবার দিনহাটার অধুনা ছিটমহলবাসীদের নতুন আবাসনে গিয়ে শুধু আক্ষেপের গলাই শোনা গেল। চোখে-মুখে হতাশা ও না-পাওয়ার ছাপ স্পষ্ট। শুধুই যেন আর্তনাদ। নতুন আবাসনে এসেছেন, কেমন লাগছে? একথা শুনে বছর ৩৭-এর ওসমান গনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ওসমান গনি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করেন। ওসমান বলেন, ‘আমাদের ঘরের কোনো কাগজপত্র নেই। সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে তবু সরকারি কাগজ ছিল। তাছাড়া কর্মসংস্থান থেকে কোনো প্রতিশ্রুতি রাখেনি সরকার’। ওসমানের বাবা-মা ভারতে আসেননি। তারা থেকে গিয়েছেন কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারিতে। ওসমানের কথায়, ‘তখন সরকার বলেছিল যা বাজেট রয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। এখানে যারা এসেছে সবাই দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছে’।
বছর তিরিশের মুহাম্মদ আবু তাহেরের স্ত্রী ও ছোট্ট দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার। দিনমজুরের কাজ করে সংসার অতিবাহিত করেন। রোজ দিন কাজও থাকে না। ‘নিজের দেশ ভেবেই এসেছিলাম, এখানে এসে ঠকে গিয়েছি’- বক্তব্য ওসমানের। তবে বাবা-মা ও দুই ভাই থেকে গেছেন বাংলাদেশে। ওসমান বলেন, ‘এটাও ভেবেছিলাম ধনী দেশ, এখানে এলে লাভ হবে। এখন মনে হচ্ছে ওখানে ভালই ছিলাম। এসে ভুল করেছি। এদেশে এসে কষ্ট বেড়েছে। সীমান্তে গিয়ে ছেড়ে দিলে ওপারেই চলে যাব’। তার আক্ষেপ, ‘নিজের জন্মভূমি ভেবেই এসেছিলাম। না পেয়েছি ঘরের কাগজ, কোনো কাজ, একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেছে এখানে এসে’। পেটের তাগিদে এই ভ‚মি ছেড়ে কাজের জন্য দিল্লি ও দেশের অন্যত্রও পাড়ি দিতে হয়েছে কিছু যুবককে।
১৫০ নম্বর দাসিয়াসারা ছিটমহল থেকে আসা বহু পরিবার রয়েছেন এখানে। আগে এরা সবাই ছিল কৃষিমেলার সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে। সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি দেখেই ক্ষোভ উগরে দিলেন নারায়ণ চন্দ্র বর্মন, নরেশ বর্মন, কামিনী বর্মন, রঞ্জিত বর্মনরা। কী পেয়েছি এখানে এসে, সব কিছু হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। সকলের মুখে একই কথা। বছর তিরিশের কামিনী বর্মনের চারজনের সংসার। তিনি বলেন, ‘ভারত সরকার ভূমিহীন করে দিল। কোনো রকমে দিন গুজরান চলছে। যা কাজ জোটে তাই করি। পুরনো ছিটমহলে ফিরিয়ে দিলেও আমি চলে যাব। এভাবে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে’? নরেশ বর্মন বলেন, ‘আমাদের হাজারো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। তার একটাও পূরণ করা হয়নি। আমরা একজোট হয়ে জেলাশাসককে স্মারকলিপি দিয়েছি। কোনো কাজ হয়নি। এখানে এসে যন্ত্রনার জীবন বয়ে বেড়াচ্ছি’।
অভিযোগ শুধু ঘরের কাগজ, নিজের নামে বিদ্যুৎ বা কর্মসংস্থান নয়, একেবারে যেন নেই রাজ্যের বাসিন্দা হয়ে রয়েছেন অধুনা ছিটমহলের বাসিন্দারা। ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে এই আবাসনে নিয়ে আসা হয়েছিল গত বছর সেপ্টেম্বরে। তারপর থেকে শুধুই হতাশা। জন্ম সার্টিফিকেট নিয়ে সমস্যা, স্বাস্থ্য সাথীর কার্ডে কোনো সুরাহা হচ্ছে না বলেও তাদের দাবি। ৫৯ বছরের গীতা বর্মনের দাবি, ‘একাধিকবার বিধবাভাতার জন্য আবেদন করলেও মেলেনি’। গৃহবধূ ভারতী বর্মনের কথায়, ‘এদেশে থেকে কী হবে, ওদেশে ফিরিয়ে দিলেই ভাল হয়’। ৭২ বছরের রজনীকান্ত বর্মনের গলার স্বর যেন রুদ্ধ হয়ে আসে। বৃদ্ধের খেদ, ‘ওখানে বিঘে ছয় জমিও ছিল। এদেশে এসে পায়ের তলার মাটিটা সরে গিয়েছে’।
২০১৫-এর ৩১ জানুয়ারি অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ভারত-বাংলাদশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হয়েছিল। ভারতের ১১১টি ছিটমহল ছিল বাংলাদেশের ঘেরাটোপে এবং বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ছিল এদেশের ভূখন্ডে। মূলত এক দেশের ভূখন্ডের চারিদিকে দ্বীপের মত ছোট্ট জমির খন্ডটি অন্য এক দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যার পরিচিতি ছিল ছিটমহল বলে। বলা হত ছিটের বাসিন্দা। ইতোমধ্যে দিনহাটার নতুন আবাসনও ছিটমহল নামেই এলাকায় পরিচিতি পেয়ে গেছে। এখানে এসে নতুন জীবন নয়, দুর্বিষহ জীবনের অভিজ্ঞতার কাহিনীই শোনালেন বাংলাদেশের ভারতীয় ছিটমহল থেকে আসা প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা। আজ শনিবার দিনহাটা কেন্দ্রে নির্বাচন। ভোট চাইতে এসেছেন বিজেপি, তৃণমূল ও সংযুক্ত মোর্চা। তবে এরাও কেউ কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি। ভোটের পরেই দাবি আদায়ে বৃহত্তর আন্দোলনের পথে পা বাড়াবেন, সেই পথেই এগোচ্ছেন ছিটমহল থেকে আসা ভারতীয়রা। সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন