দেশহীন মানুষের আবাসস্থল ছিটমহল। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিরপেক্ষ অঞ্চলের নামে বিগ্রহের কারণে এমনকি অপরাধীদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখার কৌশলে অবরূদ্ধ বিভিন্ন জনপদের সৃষ্টি করা হয়। ছিটমহল হল রাষ্ট্রের এক বা একাধিক ক্ষুদ্র অংশ যা অন্য রাষ্ট্র দ্বারা আবদ্ধ বা পরিবেষ্টিত। ওখানে যেতে হলে অন্য রাষ্ট্রের জমির উপর দিয়ে যেতে হয় অর্থাৎ অন্য একটি দেশের মূল ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে বিরাজমান জনপদ। যদি কোন একটি জনপদ দুটো দেশ দ্বারা ঘেরা থাকে তাহলে সেটা ছিটমমহল নয়। যেমন পর্তুগাল স্পেনের ছিটমহল নয় অথবা গাম্বিয়া সেনেগালের। ছিটমহল নানা ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক কারণে সৃষ্টি হয়েছে। নদীর পতিপথ পরিবর্তনের জন্য অনেক জায়গায় ছিটমহল সৃষ্টি হয়েছে। কিছু অঞ্চল এর মূল ভূখন্ডের সাথে একখন্ড মরুভূমি বা ঐ অঞ্চলে কোন জলস্রোত দ্বারা সংযুক্ত থাকে। ফলে এ অঞ্চলগুলোতে মূল ভূখন্ডের চেয়ে কোন প্রতিবেশী দেশ দ্বারা সহজে প্রবেশ করা যায়। এরকম অঞ্চলকে ব্যবহারিক ছিটমহল বলে। যেমন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মাঝে উত্তর-পশ্চিম কোনে স্প্যানীয় গ্রাম ওয় ডেসিডিস। যা স্পেন থেকে পাহাড়ের কারণে বিচ্ছিন্ন। প্রতিবেশী দেশ এ্যানডোরা থেকেই কেবল এ গ্রামে প্রবেশ করা যায়। আবার জাতিগত ছিটমহল হল একটি বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীর মাঝে আরেকটি বৃহৎ সমাজ বা গোষ্ঠি। উদাহরণ স্বরূপ-ঘেটো, লিটল, ইতালি, ব্যারিওস, চায়না টাউন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ অঞ্চলেসমূহের ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি ভিন্ন। সভ্যতার আদিতে রোমান সভ্যতার পথ ধরে রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রচলন হয়। সম্রাট জুলিয়াস সিজারের পালিত পুত্র বলদর্পী অক্টোভানের দোর্দন্ড প্রতাপ ছিল। তিনি ‘অগাস্টাস-সিজার’ পদবীর পরিবর্তে ‘ইম্পারেটর’ অর্থাৎ রাজ্যের প্রভু উপাধি গ্রহণ করে রাজ্য শাসন করেন। তার অত্যাচার-নির্যাতনে দেশে চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি এমন হয় যে, জনগণ তাকে ক্ষমতাচ্যুৎ করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। তাকে যে স্থানে নির্বাসনে পাঠানো হয় তা রোম সাম্রাজ্যের প্রান্তসীমা বেষ্টিত বিচ্ছিন্ন অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পায়। সম্ভবত এটাই পৃথিবীর প্রথম বিশেষ অবরুদ্ধ জনপদ বা ছিটমহল। ১৯১৫ সালে ম্যাক-মোহন ও শরীর হোসেনের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিতে প্যালেস্টাইন আরব রাষ্ট্রের বাইরে আন্তর্জাতিক এলাকা বা ছিটমহল হিসেবে অনিষ্পত্তি অবস্থায় রেখে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য পরাশক্তির দূরভীসন্ধি বাস্তবে রূপ লাভ করে। ‘হাইফা’ ও ‘আকরা’ কে বৃটিশ বন্দর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তারপরের ঘটনাপ্রবাহ আমরা জানি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ অবধি ফিলিস্তিনিরা নিজ ভূমে পরবাসীর ন্যায় জীবনযাপন করছে। আরেকটি তথ্য হল ভারতের গোয়া ছিল ঐতিহাসিক ছিটমহল। ১৫০০ সাল থেকে ভারতের রাজধানী ছিল গোয়া। ১৬৬১ সালে পর্তুগিজ রাজকুমারী ক্যাথরিনের সাথে বৃটিশ রাজপুত্র দ্বিতীয় চার্লস এর বিয়ে হয়। বিয়েতে চার্লসকে যৌতুক দেওয়া হয় মুম্বাই। সেই থেকে বৃটিশ-পর্তুগিজ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ছিটমহল, দামান, দিউ দাদরা, নগর, হ্যাভেনিসহ গোয়া যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের অধীনস্ত হয়। সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কূটকৌশল ও জিদের কারণে বিভিন্ন বিভিন্ন অঞ্চলে তথাকথিত নিরপেক্ষ অঞ্চল এবং করদ রাজ্যের ধারণা ছিটমহলের উদ্ভব ঘটিয়েছে। প্রভূত্ব, প্রবঞ্চ, সাম্রাজ্যবাদ, বশ্যতা ইত্যাদি অনুঘটক হিসেবে সক্রিয় ছিল। প্রাচীন নগর রাষ্ট্র থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও এর পরিব্যাপ্তি লক্ষ করা যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে, ছিটমহলের বৈশিষ্ট্য ভ্যাটিকান সিটির অবস্থান হয়েও তা সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। গ্রীনল্যান্ডের ছিটমহলের সমস্যা ন্যায়পরায়নতার ভিত্তিতে সমাধান করা হয়। চিলি ও আর্জেন্টিনার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ছিটমহল বিউগল আইল্যান্ডের সমস্যা বহু যুদ্ধবিগ্রহের পর নিষ্পত্তি হয়। পাক-ভারত উপমহাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এলাকা ছিল হিমালয়ের পাদদেশ, নেপাল, ভুটান, দার্জেলিং, পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) উত্তরাঞ্চল ও আসাম সংলগ্ন এলাকার চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। মাটির নীচে অফুরন্ত খনিজ সম্পদ আর কৃষিক্ষেত্রে উর্বরতায় সমৃদ্ধ এই অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশ বিভাগের পর জটিল সীমান্তরেখায় এই অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিধ্বস্ত বলয়ে আবদ্ধ রেখে এই জনপদকে অকার্যকর জনপদে পরিণত করা হয়। কুড়িগ্রামে ভারতের ছিল দাশিয়ারছড়া ছিটমহল। এর ভিতরেই ছিল চন্দ্রখানা নামে বাংলাদেশের ছিটমহল। এটি পৃথিবীর একমাত্র ছিটমহল ছিল যার অভ্যন্তরে অন্যদেশের আরেকটি ছিটমহল। আরেকটি সূত্রমতে, কুচবিহারেও সম্ভবত বাংলাদেশের ছিটমহল ছিল আবার এর ভেতরে ছিল ভারতের ছিটমহল। তিস্তার পাড়ে কুচবিহারের রাজা এবং রংপুরের মহারাজার মধ্যে দাবা, তাস ও পপাসা খেলায় বাজির পুরষ্কার হিসেবে এই এলাকাগুলো আদান-প্রদান হত। ফলে কুচবিহার এবং রংপুরের একে অপরের ভিতর কিছু অংশ ঢুকে যায়। ১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটেন বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমানারেখা টানার পরিকল্পনা করেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী বৃটিশ আইনজীবী স্যার সিরিল র্যাডক্লিফকে প্রধান করে সে বছরই গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন। ঐ বছরে ৮ই জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে এসে মাত্র ৪০ দিনে অর্থাৎ ১৬ আগস্ট তিনি সীমান্ত নির্ধারণী চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে তা প্রকাশিত হয়। সীমানারেখা আঁকার সময় তিনি বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করেননি। যেমন পরস্পর বিরোধী পরামর্শক, সেকেলের মানচিত্র এবং ভুলে ভরা আদমশুমারীর তথ্য আমলে নেননি। ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে তার কাজের যাবতীয় দলিল পত্র তিনি পুড়িয়ে ফেলেন এবং বলেন ‘৮ কোটি মানুষ চরম দুঃখ-দুর্দশা ও অভিযোগ নিয়ে আমাকে খুঁজবে। আমি চাইনা তাদের সাথে আমার দেখা হোক’। বিভাজনের কারিগর আর কখনোই ভারত বা পাকিস্তানে আসেননি। ফলে সীমানা রেখা অনেক স্থানে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের ভিতর অর্থাৎ একে অন্যের দখলে পড়ে। যাকে অপদখলীয় ভূমি বলা হয়। দীর্ঘ আটষট্টি বছরে ছিটমহলগুলো ছিল উভয় দেশের অপরাধীদের অভয়ারন্য। বাস্তবে তারা ছিল নিজ দেশেই পরবাসী। নিজ দেশের পরিচয় দিলেও তারা অন্য দেশের ভিতরে থাকা নাগরিকত্বহীন এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। ইতিহাসের পাতায় তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। শান্তিতে না ঘুমানোর বর্ণনা, বিকালেই খাওয়া দাওয়া সেরে সবাই চলে যেত জঙ্গলে। নাহলে ঘরের সম্পত্তি, মেয়ে, বউ লুট হবে অথবা বাড়িতে ঢুকে মেয়েদের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে। ছিটমহলবাসীদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায় ছেলে মেয়েদের পরিচয় গোপন রেখে পড়া-শোনা করাত কিন্তু নাগরিকত্বের অভাবে ঐ শিক্ষিত যুবক যুবতীরা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা অর্থাৎ চাকরি পেত না। হাসপাতালে ডাক্তার তাদের পরিচয় জানতে পারলে চিকিৎসা প্রদান করত না, বলত-দু’দিন পরে আস। সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও মৌলিক অধিকার থেকে তারা ছিল বঞ্চিত। ১নং দহলা খাগড়াবড়ির ছিটমহলের একজন বাসিন্দার খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অসহায়, ছিটমহলবাসীদের আবেদন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদাধিকারী বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ এবং কুচবিহার জেলার প্রশাসনিক পদাধিকারীদের পাঠানো হয়েছিল কিন্তু বিচার হয়নি। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল ও দক্ষিন বেড়–বাড়ী অনেকেরই জানা। এই ছিটমহল দু’টি বাংলাদেশের কিন্তু চারদিকে ভারত। ফলে এখানে থাকা লোকজন মাত্র একটি করিডোর তিনবিঘার (১৭৮ দ্ধ ৮৫ মিটার) জন্য বন্দী ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হলেও ছিরটমহলসহ তিন বিঘার সমাধান হয়নি। ১৯৫৮ সালে নুন-নেহেরু চেষ্টা করেও ভারতের উচ্চ আদালতের আদেশের কারণে এগুলো আলোর মুখ দেখেনি। তিন বিঘার বিনিময়ে ভারত ১২ নং দক্ষিন বেরুবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিণের অর্ধাংশ এবং সংলগ্ন এলাকার দখল পায়। কিন্তু করিডোর ভারত প্রদান করেনি। কথা ছিল উভয় দেশ নিজ নিজ সংসদে চুক্তি অনুমোদন করবে। বাংলাদেশ অনুমোদন করলেও ভারত তা করেনি। ১৯৯০ সালে ভারতীয় উচ্চ আদালত তিন বিঘা করিডোরকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়। দিনের বেলা এক ঘন্টা পর পর মোট ছয় ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তা খুলে দেওয়া হয়। বহুদিন পর ১৯৯২ সালে ২৬শে জুন এই করিডোরটির ইজারা দেয়। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি করলেও ভারত সবসময় তা কার্যকর করেনি। ১৯৯৬ সালে মুজিব-ইন্দিরার চুক্তির সূত্র ধরে বর্তমান সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। ২০১১ সালে সীমান্ত চুক্তির ফলে সই হয় প্রটোকল। মোদী সরকার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ভারতের সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করে। ২০১৫ সালে স্থলসীমান্ত চুক্তি (ছিটমহল বিনিময়) ৩১শে জুলাই ২০১৫ তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ পায় লালমনির হাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারিতে ৪টিসহ মোট ১১১টি মোট ১৭১৬০.৬৩ একর জমি এবং প্রায় এক লক্ষ লোক। ভারত পায় কুচবিহারে ৪৭টি, জলপাইগুড়িতে ৪টি সহ ৫১টি মোট ৭১১০.০২ একর জমি এবং জনসংখ্যা প্রায় ৭০,০০০। অপদখলীয় জমি অর্থাৎ জোর করে দখলে রাখা বাংলাদেশ পায় ২২৬৭.৬৮২ একর এবং ভারত পায় ২৭৭৭.৩৮ একর জমি। তিনবিঘা করিডোর চব্বিশ ঘন্টা সর্বদা খোলা থাকল। দীর্ঘ আটষট্টি বছর পর ঐ ছিটমহলগুলো আজ বাসযোগ্য। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট, ব্রীজ, কালভার্ট, আকাশ সংস্কৃতি, বিদ্যুৎ সংযুক্তিসহ আধুনিক রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা তাদের কাছে স্বপ্ন নয় বাস্তবে দৃশ্যমান হচ্ছে। এই ছিটমহল বিনিময় স্থলসীমান্ত চুক্তি সারাবিশ্বের কাছে আজ রোল মডেল। সদ্য বিলুপ্ত (নতুন মানচিত্র) সীমান্ত চুক্তি কার্যকর হওয়ায় আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ছিটমহলবাসী পহেলা আগষ্ট ২০১৫ সালে থেকে ঐ দিনটিকে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করছে।
লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন