শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ছিটমহল : ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়

মো. কায়ছার আলী | প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

টি এইচ গ্রিন বলেছেন, ‘শক্তি নয়, ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি’। হবস, লক এবং রুশোর মতে, ‘চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে’। প্রকৃতির নির্মম খেয়াল থেকে বাঁচার এবং একে অপরের জীবন, সম্পত্তি নিরাপত্তার জন্য পারস্পরিক চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। বিশ্ব বিভিন্ন রাষ্ট্র, জাতি, উপজাতি, বর্ণ ও গোত্রে বিভক্ত কিন্তু সকলের মূল পরিচয় মানুষ। তাইতো দেশে-দেশে মানুষে-মানুষে এত ভেদ-প্রভেদ থাকা সত্তে¡ও পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ চিরন্তন। মানবাধিকার, জননিরাপত্তাসহ সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের নির্মমতার শিকার বা মোঘল আমলের রাজন্যবর্গের খামখেয়ালিপনার অথবা ক্ষমতার দ্ব›েদ্বর প্রতীক হলো ছিটমহল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কুচবিহারের রাজা এবং রংপুরের মহারাজা তিস্তার পাড়ে তাসখেলায় বাজি ধরতেন ছিটমহলের মালিকানা নিয়ে। তারা ছিলেন সামন্ত। ছিট শব্দের অর্থ খন্ড বা টুকরা। বিভিন্ন মহলকে এক একটি খন্ডে বিভক্ত করার পরে এর নাম হয় ছিটমহল। ছিটমহল হলো রাষ্ট্রের এক বা একাধিক ক্ষুদ্র অংশ, যা অন্য রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। A Piece of territory surrounded by foreign dominion is Enclave অর্থাৎ বন্দি বা দেশহীন মানুষের আবাসস্থল ছিটমহল। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে মোঘল সম্রাট শাহজাহানের হঠাৎ অসুস্থতার কারণে কুচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ কামরূপের সুবেদার মীর লুৎফুল্লাকে আক্রমণ করে মোঘল সাম্রাজ্যের বেশ কিছু বাড়তি অংশের ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বাংলার সুবেদার মীর জুমলা বিশাল বাহিনী নিয়ে কুচবিহার আক্রমণ করেন এবং অধিকৃত মোঘল সাম্রাজ্যর অংশগুলো পুনরূদ্ধার করে রাজধানী কুচবিহারও অধিকার করে ফেলেন। পরে ইসফান্দিয়ার বেগকে কুচবিহারের দায়িত্ব দেন। রাজা প্রাণনারায়ণ পালিয়ে গিয়ে পরবর্তীতে স্বসৈন্য শক্তি সংগ্রহ করে পুনরায় রাজ্য উদ্ধার করেন। তখন থেকেই মোঘলদের সাথে দফায় দফায় রাজার যুদ্ধ লেগেই থাকত, যা শেষ হয় ১৭৭২ সালে। কুচবিহারের রাজা হন শান্তনুনারায়ণ। তখন খাঞ্জা খাঁ কুচবিহারের বোদা, পাটগ্রাম এবং পূর্বভাগ এ চাকলা তিনটি অধিকার করেন। রাজা বেনামে চাকলা তিনটি ইজারা নেন। অন্য ভূ-সম্পত্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত হলেও মূলত এ তিনটি চাকলার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলোই কুচবিহারের ছিটমহল। পরবর্তীতে বহু বছর ব্যাপী খন্ড খন্ড যুদ্ধের ফলে কুচবিহার রাজ্যের বেশ কয়েকটি ভূ-খন্ডে মোঘলদের দখলদারি কায়েম হয় এবং কালক্রমে এ অংশগুলি রংপুরের জমিদারির অধীনে চলে আসে, যা পরে রংপুরের ছিটমহল নামে পরিচিত। সেই ভূ-খন্ড মূল সম্পত্তির সঙ্গে এক লপ্তে (Stretch) নয় অথচ ঠিকই খাজনা আসত রাজা বা জমিদারের তহবিলে। পলাশী যুদ্ধের পর ১৭৮৯ থেকে ১৮০০ সালে ইংরেজরা কৌশলে কুচবিহারের রাজাকে নিজেদের বশে আনেন। সে প্রেক্ষাপটে প্রথমেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কুচবিহার রাজার নিকট হতে বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্বভাগ এ তিনটি চাকলা অধিকার করে এবং পুনরায় কুচবিহারের রাজার নিকট ফিরিয়ে দেয়। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় সমস্যা বাঁধে কুচবিহারকে ঘিরে। কুচবিহারের রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের কিছু জমিদারি স্বত্ব ছিল বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার আওতাধীন। অপর দিকে রংপুর ও দিনাজপুরের জমিদারদের কিছু তালুক ও জোত ছিল কুচবিহার সীমানার মধ্যে। উভয়পক্ষ সমঝোতায় ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের এবং ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের কিছু এলাকা পড়ে। দেশ বিভাগের মতো এত বড় জটিল কাজটি (৮ জুলাই ১৯৪৭ হতে ১৩ আগস্ট ১৯৪৭) Sir Siril Redclif অখন্ড ভারতের দীর্ঘদিনের স্থল ও নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, সমন্বিত অর্থনীতি ও স্থিতিসম্পন্ন এলাকা ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব-পশ্চিম দুই অঞ্চলের দুটি প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবকে মাঝবরাবর ধরে ম্যাপের ওপর দাগ টেনে ভাগ করেন। সীমারেখা নির্ধারণী Top Sheet এর মূলকপি ১৬ আগস্ট ১৯৪৭ সালে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হলে বিতর্কের ঝড় ওঠে এবং সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় ছিটমহলবাসীর ১৬২টি ছোট-বড় ভূ-খন্ড অনিষ্পত্তি অবস্থায় থাকে যার ফলে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে এই অঞ্চলকে বিধ্বস্ত বলয় (Shattered Belt) বলা হয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল বলেই ছিটমহলবাসীর অবস্থা অত্যন্ত করুণ ও জটিল প্রকৃতির। নাগরিক অধিকার বঞ্চিত, নিপীড়িত অসহায় মানুষগুলো মেয়েদের সম্ভ্রমহানীর ভয়ে সন্ধ্যে হলেই লুকিয়ে রাখত, শান্তিতে ঘুমাতে পারত না, হাসপাতালে গেলে ডাক্তাররা দেখত না, বলত দু’দিন পরে আস এবং গর্ভবতী মহিলাদের সন্তান জন্ম দানের সময় ভর্তি করতো না। রেডক্লিফ রোয়েদাদ, বাউন্ডারি কমিশনের রিপোর্ট, নুন-নেহেরু চুক্তি, ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ইন্দিরা-মুজিব ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও দীর্ঘ ৬৮ বছর (৩টি প্রজন্ম) বিচ্ছিন্ন ভূ-খন্ডের অবহেলিত, নাগরিকত্বহীন মানুষেরা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করেছে। যাকে সোজা কথায় বলা যায়, সভ্য সমাজের এক ‘কলঙ্ক তিলক’। জাতিসংঘ সনদে Protocol to the International Convanant on Civil & Political Right এর ৪.৩ (৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে ‘রাষ্ট্র সকলের আত্মবিকাশের সমান সুযোগ প্রদান করবে’। অন্যত্র জোর দিয়ে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক শিশুর একটি জাতীয়তা লাভের অধিকার থাকবে’। এ কথাগুলো একদিন ছিল কাগজে আর কলমে, বাস্তবে নয়। সরকার ১৯৯৬ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির সূত্র ধরে নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এলে তখন একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে ছিটমহল বিনিময় ও সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিলটি ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ জাতীয় সংসদে পাস হয়। ভারতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় এসে ছিটমহলের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়। ৭ মে ২০১৫ সালে স্থলসীমান্তচুক্তি সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল (ছিটমহল বিনিময়) ভারতের লোকসভায় ৩৩১ জন সদস্যের উপস্থিতিতে এবং সর্বসম্মতক্রমে পাস হয়। অতঃপর বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল (লালমনির হাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারীতে ৪টি মোট ১৭ হাজার ১৬০.৬৩ একর জনসংখ্যা ৩৭৩৮৬ জন) বাংলাদেশ পায় এবং ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল (কুচবিহারে ৪৭টি, জলপাইগুড়িতে ৪টি মোট ৭ হাজার ১১০.০২ একর জনসংখ্যা ১৪০৯০ জন) ভারত পায়। বসবাসরতরা ইচ্ছানুযায়ী যে কোনো দেশের অভ্যন্তরেই থেকে যাওয়ার সুযোগ পায়। এছাড়াও বাংলাদেশ ভারতের দখল করে রাখা ২২৬৭.৬৮২ একর এবং ভারত বাংলাদেশের দখল করে রাখা ২৭৭৭.৩৮ একর জমি যার যা দখলে আছে সে তার মালিকানা পায়। ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের এবং ৫১টি ছিটমহল ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় অর্থ্যাৎ উভয় দেশের মূল ভ‚খন্ডে পরিণত হয়। ফলে ছিটমহলবাসী পায় তাদের নাগরিত্ব এবং যাবতীয় মৌলিক অধিকার।
লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন