শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

হারামাইন রক্ষায় মুসলমানদের কর্তব্য

প্রকাশের সময় : ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কে. এস. সিদ্দিকী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন সউদি আরব বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এ বিশেষ স্থান কী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সউদি আরবের বাদশাহ ‘খাদেমুল হারামাইনে’র মহান মর্যাদার আসনে আসীন হয়ে আছেন। অন্যান্য বৈষয়িক দিকের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কেবলা পবিত্র খানাই কাবা এবং মহানবী (সা.)-এর রওজা শরিফ মদিনা মোনাওয়ারায় অবস্থিত এবং মসজিদে নববীও সেখানে অবস্থিত। এ দুটি পবিত্র স্থানই হারামাইন শরিফাইন নামে পরিচিত। এ হারামাইন সকল প্রকারের কলুষ ও বিতর্ক হতে মুক্ত রাখা এবং এ দুটি পবিত্র স্থানকে নিরাপদ ও বিদপমুক্ত রাখা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশও এ দায়িত্ব পালনে অংশীদার হতে আগ্রহী, প্রধানমন্ত্রী সেই মনোভাব ও আগ্রহের কথাই ব্যক্ত করেছেন।
আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ। হজরত আদম (আ.)-এরও হাজার বছর পূর্বে ফেরেশতারা বায়তুল্লাহ তওয়াফ করেন বলে জানা যায়। দুনিয়াতে আদম (আ.)-ই প্রথম খানাই কাবা নির্মাণ করেন। হযরত নূহ (আ.)-এর সময় তুফানে কাবা বিধ্বস্ত বা লুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর হজরত ইবরাহিম (আ.)-তার পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে কাবা পুনর্নির্মাণ করেন এ বিবরণ খোদ কোরআনে রয়েছে। কাবা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে কীভাবে মুসলমানদের কেবলা হলো তারও বর্ণনা কোরআনে রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মের ৫৫ কিংবা ৫০ দিন আগে কাবা ধ্বংস করতে গিয়ে খ্রিস্টান রাজা আবরাহা তার হস্তী বাহিনীসহ কীভাবে ধ্বংস হয় সূরা ফিলে সে কাহিনী খোদ আল্লাহ বর্ণনা করেছেন। হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) কাবার ফজিলত তথা মর্যাদা-মাহাত্ম্য সম্পর্কে বহু কথা বলেছেন। উদাহরণস্বরূপ মাত্র কয়েকটি হাদিস নি¤েœ প্রদত্ত হলো :
১. হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : এখন মক্কা হতে হিজরত করার প্রয়োজন আর নেই কিন্তু জেহাদ ও সৎ উদ্দেশ্যে যখন তোমাদেরকে আহŸান করা হয় তখনো তা সওয়াবের কাজ, বের হয়ে আসবে। তিনি আরো বলেছেন : বস্তুত আল্লাহতায়ালা এই শহরকে সেই দিনই সম্মানিত করেছেন যেদিন তিনি আসমানসমূহ এবং জমিনের সকল স্তর সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং তা আল্লাহর পক্ষ হতে কেয়ামত পর্যন্ত সম্মানিত থাকবে। বাস্তবে এ শহরে আমার পূর্বে কারো জন্য যুদ্ধ হালাল (বৈধ) হয়নি এবং আমার জন্যও মাত্র কিছুক্ষণের জন্য হালাল হয়েছিল। অতএব ওই শহর আল্লাহর পক্ষ হতে কেয়ামত পর্যন্ত সম্মানিত থাকবে; তার কাঁটাদার কোনো বৃক্ষ কর্তন করা যাবে না, কোনো শিকারি পশু ভাগানো যাবে না, কোনো পতিত বস্তু উঠানো যাবে না। তবে সেই ব্যক্তি উঠাতে পারবে যে তার ঘোষণা করে মালিক পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। আর সেখানের ঘাষও কাটা যাবে না। এসব কথা শোনার পর ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল। ‘আজখার’-এর অনুমতি আছে কি? কেননা তা লোহারদের (কামার-কুমার) কাজে ব্যবহৃত হয়। লোহা গলানোর কাজে লাগে (ছাদ ইত্যাদি তৈরিতে)। এতে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হ্যাঁ, আজখারের অনুমতি আছে (বোখারি ও মুসলিম)।
২. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট জাবের (রা.) শুনেছেন, তিনি বলেছেন, মক্কায় অস্ত্রধারণ করা তোমাদের কারোর জন্য জায়েজ নয়। (মুসলিম)।
৩. হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করে, রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা সম্পর্কে বলেছেন : তুমি কি চমৎকার শহর এবং তুমি আমার নিকট কতই না উত্তম। আমার কওম তোমাকে ত্যাগ করার জন্য যদি আমাকে বাধ্য না করত তাহলে তুমি ব্যতীত আমি অন্য কোথাও নিবাস স্থাপন করতাম না। (তিরমিজি)
৪. হযরত আইয়াশ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: এই উম্মত কল্যাণকামী হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা মক্কার মর্যাদার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে থাকবে, আর যখন সেই সম্মান প্রদর্শন করবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে। (ইবনে মাজা)
মক্কার মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুরূপ আরও উক্তিতে চিন্তার খোরাক রয়েছে। মদিনা মোনাওয়ারার ফজিলত মাহাত্ম্য সম্পর্কেও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোর কয়েকটি হচ্ছে :
১. হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন : লোকেরা যখন নতুন ফল দেখত, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে নিয়ে আসত। তিনি ফল গ্রহণ করে বলতেন : হে আল্লাহ, আমাদের ফলে বরকত দান কর, আমাদের শহরে বরকত দান কর, আমাদের ‘ছা’য়ে’ এবং মুদ্দে বরকত দান কর (ছা’য়েও মুদ্দ ওজন ও মাপের যন্ত্র)। হে আল্লাহ, ইবরাহিম ছিলেন তোমার বান্দা, তোমার বন্ধু এবং তোমার নবী। আমিও তোমার বান্দা, তোমার বন্ধু এবং তোমার নবী। তিনি (ইবরাহিম) মক্কার জন্য তোমার নিকট দোয়া করেছিলেন, আমি মদিনার জন্য দোয়া করছি তার দ্বিগুণ। অতঃপর রাবী বলেন, হুজুর (সা.) কোনো অজুহাতে ছোট ছোট ছেলেদের ডাকতেন এবং তাদেরকে ওই ফল প্রদান করতেন। (মুসলিম)
২. হযরত আবু সাঈদ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বস্তুত ইবরাহিম (আ.) মক্কাকে মর্যাদদান করেছেন। তাই তাকে সম্মানিত করেছেন এবং আমি মদিনাকে শ্রেষ্ঠত্বদান করেছি, তার দুই সীমান্তের মধ্যে রক্তপাত করা যাবে না, সেখানে যুদ্ধাস্ত্র বহন করা যাবে না এবং সেখানে কোনো বৃক্ষ কর্তন করা যাবে না চারার প্রয়োজন ব্যতীত। (মুসলিম)
৩. হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আমাকে এই জনপদে হিজরত করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যা বিখ্যাত লোকেরা ‘ইয়াসরব’ বলেন। প্রকৃত পক্ষে মদিনা এমন একটি স্থান, যা মন্দ লোকদেরকে এমনভাবে বের করে দেয় যেমন ‘সায়কল’ বা ঘর্ষণ যন্ত্র লোহার মরিচা বিদূরীভ‚ত করে দেয়। (মুসলিম) ও বোখারি)
৪. হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: মদিনার দ্বারগুলোতে ফেরেশতারা মোতায়েন রয়েছেন, সেগুলো দিয়ে তাউন (মহামারী) প্রবেশ করতে পারবে না, দাজ্জালও ঢুকতে পারবে না। (বোখারি মুসলিম)
৫. হজরত ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি হজ করেছেন এবং আমার ওফাতের পর আমার কবর জিয়ারত করেছেন সে ব্যক্তির উদাহরণ ওই ব্যক্তির ন্যায় যে আমার জীবদ্দশায় আমার জিয়ারত করেছেন। (বায়হাকী)
মদিনা শরিফের প্রতি ইমাম-ফকিহগণের যে অগাধ ভক্তি, ভালোবাসা, সম্মান এবং মর্যাদা প্রদর্শনের ঘটনাবলির মধ্যে উদাহরণস্বরূপ হজরত ইমাম মালেক (র.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি মদিনায় কখনো সোয়ারীতে করে বের হননি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলতেন, আমার লজ্জা হয়, যেসব সড়ক-গলিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) চলাফেরা করতেন, সেগুলোতে আমি সোয়ারিতে আরোহণ করে বের হব।
হারামাইনের অবমাননার অতীত ইতিহাসের সাথে প্রধানত ইহুদি-খ্রিস্টানরাই জড়িত, সেই বিবরণ-এখানে প্রদান করার প্রয়োজন নেই। কেননা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের নানামুখী ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের ধারা কোনো যুগেই থেমে যায়নি। সেই ধারা এখনো বিদ্যমান। অভিনব নানা কৌশলে ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনে তাদের কোনো জুড়ি নেই। সেই হিসেবে মুসলমানগণ তাদের জবাব দানে তেমন উদ্যমী নন বলেই মনে করা হয়। তাদের পরিবর্তিত কৌশল অনুযায়ী তারা মুসলমানদেরকে পরস্পর বিরোধ-হানাহানিতে লিপ্ত রেখে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি কি তারই প্রমাণ বহন করে না?
চলমান হিজরি শতকের সূচনা লগ্নের একটি রক্তাক্ত মর্মান্তিক সন্ত্রাসী ঘটনার বহু প্রত্যক্ষ সাক্ষী বাংলাদেশেও রয়েছে। ১৪০১ হিজরি শতকের পয়লা মহররম খানা-ই কাবা আক্রমণ করেছিল মুসলমান নামধারী কিছু সন্ত্রাসী-জঙ্গি। বায়তুল্লাহ শরিফের মর্যাদাও ভ‚লুণ্ঠিত করেছিল ওই সন্ত্রাসী-জঙ্গিরা। আল্লাহর ঘরে নামাজ-জামাত হয়নি ১৭ দিন। রক্তাক্ত ঘটনাবলির পর কাবা সন্ত্রাসীমুক্ত হয়। এ সন্ত্রাসী চক্রকে ইসলামদ্রোহী শক্তি সউদি আরবের ক্ষমতায় বসানোর লোভ দেখিয়ে উসকে দিয়েছিল এবং এ প্রলোভনে উন্মাদ হয়ে সন্ত্রাসী-জঙ্গিরা কাবা আক্রমণ করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
হারামাইন-শরিফাইন অর্থাৎ মক্কা মোকাররম ও মদিনা মোনাওয়ারার নিরাপত্তার বিষয়টি এখন নতুনভাবে সামনে এসেছে। এর কারণগুলোর ঐতিহাসিক দিকের পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন করে না, তবে হিজরি চতুর্দশ শতকের ১ মহররম তারিখে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী-জঙ্গিরা খানা-ই কাবায় যে নির্লজ্জ, কলঙ্ক ও ঘৃণ্য আগ্রাসন চালিয়ে তার মর্যাদা হানি ও ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছিল তার প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে বাংলাদেশের বহু লোক এখনো বেঁচে আছেন। অভিযোগ রয়েছে, ওই রক্তাক্ত ঘটনার নেপথ্যে ইহুদিদের ইন্ধন সক্রিয় ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী তৎপরতার প্রেক্ষিতে হারামাইনের নিরাপত্তার গুরুত্ব আরও অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। খোদাদ্রোহী হারামাইনবিদ্বেষীরা ওঁতপেতে আছে। মুসলিম উম্মাহ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক হলেও ঐক্যবদ্ধ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব অস্বীকার করা যায় না। হারামাইনের নিরাপত্তার বিষয়টি বাংলাদেশের মুসলমানের কাছেও অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে। সউদি সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে শেখ হাসিনার হারামাইন রক্ষার আগ্রহ প্রকাশ সেই মনোভাবেরই প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন