শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

গণতন্ত্রের অর্থবহ চর্চা প্রয়োজন

প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান

এদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বহুবার ঘাত-প্রতিঘাতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ব্রিটিশ প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক জরিপ অনুযায়ী গণতন্ত্র প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৭টি দেশের মধ্যে ৮৫তম। এ ছাড়া অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। ১১ জানুয়ারি (২০১৪) বিখ্যাত ইকোনমিস্টে এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র পচে গেছে’। এতে স্পষ্ট যে, কার্যকর গণতন্ত্র থেকে এখনো অনেক দূর ও ঝুঁকির সম্মুখীন রয়েছে বাংলাদেশ। প্রায় তিন বছর ধরে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল সরকার গঠন পরিচালক প্রক্রিয়ার বাইরে। নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে দলটি সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণই করেনি। ফলে প্রধান একটি দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই যে সরকার দেশটিকে চালাচ্ছে, সেটি কতটা গণতান্ত্রিক, এ প্রশ্ন দেশে-বিদেশের রাজনৈতিক বোদ্ধামহলের। শুধু জাতীয় নির্বাচনে নয়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনদের পেশিশক্তির কাছে হেরে গেছে গণতন্ত্র। এ বছর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, গত বছরের উপজেলা নির্বাচন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণসহ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন দলসহ নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে ২৮টি দল দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুরোধ জানালেও আওয়ামী লীগ সরকার ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানে এগিয়ে যায়। নির্বাচন কমিশন তার সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ না করে সরকারের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ওই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন না ঘটায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেতে ব্যর্থ ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
গণতন্ত্র এমন একটি শাসন ব্যবস্থা, যেখানে নাগরিকের নীতিনির্ধারণ বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার থাকবে। জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি। এ ইচ্ছা সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নৈমিত্তিকভাবে এবং প্রকৃত নির্বাচন দ্বারা ব্যক্ত হবে, যা গোপন ব্যালট অথবা অনুরূপ অবাধ ভোটদান পদ্ধতিতে হবে। গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল হবে বাকস্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা এবং সরাসরি অথবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনস্বার্থবিষয়ক কার্যাবলিতে জনগণের অংশগ্রহণের অধিকার ও সুযোগ থাকবে।
গণতন্ত্রের পুঁথিগত সংজ্ঞা আমরা সবাই জানি। কিন্তু বাস্তবতার সাথে পুঁথিগত সংজ্ঞার যোজন-যোজন ফারাক। তাই গণতন্ত্রের সংজ্ঞাও আজ অদল-বদল। দেশে গণতন্ত্রের নামে রয়েছে নানান ধারা, ধরন ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার অজুহাত। রাজনীতিতে চালাকি বা কৌশল অবলম্বনের সুযোগ থাকলেও যেখানে দেশ ও জাতির কল্যাণ ও অকল্যাণের প্রশ্ন জড়িত সেখানে কৌশল অবলম্বনের কোনো সুযোগ নেই। কারণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের কল্যাণই মুখ্য। যে কোনোভাবে ক্ষমতাই যেখানে মোদ্দা কথা, সেখানে গণতন্ত্র বড়ই অসহায়!
এ কথা সত্যি যে, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও এদেশের জনগণ আজও জানে না গণতন্ত্র মানে কি, গণতন্ত্র আসলে কি? গণতন্ত্র কি শুধু কাগজে -কলমের সংজ্ঞা নাকি একটি অর্থবহ চর্চা? আমাদের বিবেক আজ পদদলিত। পিষ্ট আজকে আমাদের গণতন্ত্র। কেউ আমরা ভাগ্য গড়ি আবার কেউবা ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলি। এরই নাম গণতন্ত্র! কষ্টার্জিত অর্জন আজ স্বার্থের কারণে হাত ছাড়া। বুঝতে অক্ষম এই গণতন্ত্র দিয়ে কী হয়? শুধু দেখা যায় গণতন্ত্রের নামে কেউ আগুন জ্বালায়, গাছ উপড়ে ফেলে, ভাঙচুর করে, একে অপরের মাথা ফাটায়, রাস্তা বন্ধ করে দেয়। আবার গণতন্ত্রের নামে কেউ মানুষ পেটায়, ঘর থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে, বিনা অপরাধে মানুষকে বন্দি করে।
নানা কিসিমের গণতন্ত্রের কথা শুনে শুনে আমাদের কর্ণযুগল বিকল হওয়ার পথে। অথচ প্রকৃত জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্র আমাদের দেশে নেই। নেতৃত্বের বিকাশে কাজ করে রাজনৈতিক দলগুলো, কিন্তু দলগুলো আদর্শের বাইরে সুবিধাকেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো খুব প্রকাশ্যভাবেই দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে ব্যস্ত।
নাগরিক সমাজ সামাজিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটিগুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। নাগরিক সমাজের সরকারের প্রতি দায়িত্ব ও যথার্থ গণতন্ত্রায়নে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যার স্বীকৃতিও দিয়েছে জাতিসংঘ। বা নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে মতবিরোধ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, নাগরিক সমাজ মূলত বড় রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র ও লেজুড়হিসেবে কাজ করে। মজার ব্যাপার হলো, বিরোধী দলে থাকাকালে যে দলটি নাগরিক সমাজের কার্যাবলিকে পূর্ণ সমর্থন জানায়, ক্ষমতায় গিয়ে সে দলটির নীতিনির্ধারকরা নাগরিক সমাজের ওপর খড়গহস্ত হয়। নাগরিক সমাজ গণতন্ত্রের অভিন্ন অংশ হিসেবে কাজ করে এবং গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ন্যায়বিচার, সমতা, প্রতিনিধিত্ব, মত প্রকাশ, সংগঠনের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয় চর্চায় সহায়তা করে। নাগরিক সমাজের কার্যকারিতা ও বিকাশ নিশ্চিতকরণে সহায়তা প্রদানের জন্য জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকারগুলোর প্রতি বরাবরই আহ্বান জানিয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জাতিসংঘের এই শুভেচ্ছা দুনিয়ার নানান স্থানে পড়ে পড়ে মার যাচ্ছে।
abunoman72@ymail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন