শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনা মোকাবেলায় কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০২১, ১২:০২ এএম

ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউয়ের মাত্রাকে বহুগুণে অতিক্রম করেছে। সরকারি হিসাবেই প্রতিদিন চার হাজারের বেশি মানুষ করোনায় মারা যাচ্ছে। আক্রান্ত বা শনাক্তের সংখ্যাও প্রতিদিন চার লাখের বেশি। যদিও বেসরকারি ও বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, ভারতে করোনায় প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেশি। ভারতে দিল্লী, মুম্বাইয়ের মত শহরে মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান মিছিল, হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গেপড়া এবং অক্সিজেন সংকটের কারণে অগণিত মানুষের মৃত্যুর হৃদয়বিদারক দৃশ্য পুরো বিশ্বকে হতবাক করছে। সেই সাথে ভারতের আঞ্চলিক পরাশক্তির বড়াই ও ভাবমর্যাদায়ও বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই মুহুর্তে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সারাবিশ্বের জন্য নতুন আতঙ্কের নাম। ইতিমধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট অন্তত ১৭টি দেশে ছড়িয়েছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে। নিকটতম প্রতিবেশি দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ খুবই স্বাভাবিক আশঙ্কা। ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক আকার ধারণ করে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পরও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বন্ধ করে দিতে বেশ দেরি করেছে সরকার। ইতিমধ্যে বাংলাদেশেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে, যা গত বছরের প্রথম ঢেউ থেকে অনেক বেশি সংক্রামক, মারাত্মক ও প্রাণঘাতী। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় যে ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তা ছিল আমাদের জন্য বড় অশনি সংকেত। অক্সিজেনের অভাবে প্রিয়জনের কান্নায় ঢাকায় হাসপাতালের পরিবেশ যখন ভারী হয়ে উঠেছিল তখনি জানা গেলো ভারত বাংলাদেশে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। দেশের বৃহত্তম অক্সিজেন উৎপাদনকারি কোম্পানি লিন্ডের দু’টি ইউনিট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ক্রমবর্ধমান করোনা রোগী, দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনা রোগীরা দ্রæত সিরিয়াস স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে যাওয়া, উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেন নির্ভরতা অনেক বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ভারতের মত সংক্রমণ বেড়ে গেলে এবং ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে চলে এলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে পুরো জাতি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। তবে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কিছুটা কমে আসার তথ্য পাওয়া গেলেও দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের রোগী ধরা পড়ায় জনমনে আশঙ্কা ও আতঙ্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। ঈদকে সামনে রেখে একশ্রেণীর মানুষের শপিংয়ে যাওয়া এবং হাজার হাজার মানুষের একসঙ্গে গাদাগাদি করে করে বাড়ি যাওয়ার প্রতিযোগিতা দেখলে মনেই হয় না দেশে একটি ভয়াবহ মহামারির সংকট ও লকডাউন চলছে।

করোনা পেন্ডেমিকের শুরুতেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যেসব নির্দেশনা জারি করেছিল এখন পর্যন্ত সেসব নির্দেশনাগুলোই করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেই সাথে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরুরী বার্তা ছিল, একদিনে যত বেশি সংখ্যক সম্ভব নাগরিকদের করোনা পরীক্ষা ও শনাক্তকরণ নিশ্চিত করা। আমাদের দেশের বাস্তবতা থেকে বুঝা যাচ্ছে, সরকার করোনা পরীক্ষা বাড়াতে তেমন আগ্রহী নয়। করোনার প্রথম ধাক্কায় দেশে যখন করোনা টেস্ট কিটের সংকট দেখা দিয়েছিল, ঠিক তখনি দেশীয় সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র জাতির এক গৌরবের সংবাদ নিয়ে হাজির হয়েছিল। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা স্বল্পমূল্যের করোনা টেস্টকিট উদ্ভাবন করে যে প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল সরকারের আমলাদের অনীহা এবং অহেতুক জটিলতায় সে প্রত্যাশা খুব দ্রæতই হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। বিদেশ থেকে আমদানি করা কিটে দেশে প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার করোনা টেস্ট হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। অথচ দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে করোনার সংক্রমণ গণহারে ছড়িয়ে পড়া রুখতে হলে প্রতিদিন অন্তত দুইলাখ মানুষের করোনা টেস্ট নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত র‌্যাপিড টেস্ট কিটের মাত্র ১৫ মিনিটেই করোনা টেস্ট করার সক্ষমতা থাকায় প্রতিদিন লাখো মানুষের করোনা টেস্ট করা খুব কঠিন বিষয় ছিল না। করোনা টেস্ট থেকে শুরু করে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, টিকাসংগ্রহ এবং অক্সিজেন সরবরাহের মত বিষয়াবলীর সাথে আমলাতান্ত্রিক পক্ষপাতিত্ব, কর্পোরেট মুনাফাবাজি এবং রাজনৈতিক বিবেচনার খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশের করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ও হতাশাজনক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। আরটি পিসিআর মেশিনের উপর নির্ভরতা ও ব্যয় কমানোর পাশাপাশি দ্রæততম সময়ে করোনা শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া ও খরচ কমিয়ে আনতে অনেক দেরিতে হলেও এন্টিজেন র‌্যাপিড টেস্ট ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হলেও শুধু বিশ্বের প্রথম র‌্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবক হিসেরে গণস্বাস্থ্যের বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তাদের হতাশ করে সেসব টেস্ট কিট বিদেশ থেকে আমদানি করেই কাজ চালানো হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে চললেও এখনো প্রতিদিন ২০-২৫ হাজারের বেশি শনাক্তকরণ সম্ভব হচ্ছে না। করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবা ও করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্যখাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বাড়তি বরাদ্দ খরচ করা হচ্ছে। সেসব খরচের কতটা জনগণের কাজে লাগছে আর কতটা আমলাতান্ত্রিক ও কর্পোরেট স্বার্থের ভাগাভাগিতে চলে যাচ্ছে সে হিসাব খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
বিশ্বের সাড়ে সাতশ’ কোটি মানুষের জন্যই এখন দুর্দিন। করোনা পেন্ডেমিকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও স্বাভাবিক অর্থনৈতিক-সামাজিক, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ও বাণিজ্যিক কর্মকাÐ সীমিত হয়ে পড়ায় এর প্রভাব সবার মধ্যেই পড়েছে। তবে ইতিমধ্যে দেখা গেছে দেশে দেশে কর্পোরেট মুনাফাবাজরা এই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকার বাইরে। এই করোনাকালীন বৈশ্বিক দু:সময়েও তাদের মুনাফার প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে জাতীয় অর্থনীতির কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে সেখানে দেশের কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫০ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আমলাতন্ত্র ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণে তাদের মুনাফাবাজির প্রভাব দেশের করোনাভাইরাস মোকাবেলার ক্ষেত্রেও সরাসরি প্রভাব সৃষ্টি করেছে। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, বেক্সিমকোর মুনাফাবাজির কারণে সরকার বিকল্প উৎস থেকে করোনা ভ্যাকসিন সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে পারেনি। উল্লেখ্য, বেক্সিমকোর মধ্যস্থতায় আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে এস্ট্রাজেনেকার ভ্যাক্সিন কেনার চুক্তি করেছিল। ভারতের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং করোনা অতিমারি ভারতে ভয়াবহ আকার ধারণ করার আগেই সেরাম ইনস্টিটিউট আগাম টাকা গ্রহণ করেও বাংলাদেশে টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশে করোনা ভ্যাক্সিনেশন প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। চুক্তি অনুসারে, প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়ে অগ্রীম টাকা নেয়ার পর গত ৫ মাসে এক কোটি ডোজও সরবরাহ করতে পারেনি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। অথচ বাংলাদেশ যখন চীনের টিকার অনুমোদন দিয়ে চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানীর সাথে চুক্তি করতে যাচ্ছিল, তখন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে উড়ে এসে ভারতের টিকার নিশ্চয়তার কথা শুনিয়ে গিয়েছিলেন। মূলত একটি মধ্যস্বত্বভোগী কোম্পানীকে সুবিধা দিতেই সরকারের আমলারা ভারতীয়দের মিথ্যা আশ্বাসের টোপ গিলেছিল। বাংলাদেশের সাথে ভারতের রাজনীতিবিদদের কমিটমেন্ট ও চুক্তি বারবার লঙ্ঘিত হওয়ায় এখন ভারতের সাথে নতুন কোনো চুক্তির ক্ষেত্রে এসব অভিজ্ঞতা মনে রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বৈশ্বিক মহামারিতে মাত্র কয়েকটা দেশের কোম্পানী বাণিজ্যিকভাবে টিকা উৎপাদন ও বিতরণের দায়িত্ব পালন করছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, আঞ্চলিক, সাম্প্রদায়িক, মুনাফাবাজি ও একদেশদর্শী বিবেচনা বড় ধরণের মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। তবে বাংলাদেশের সাথে প্রতারণামূলক আচরণের পর ভারত নিজেই মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ভারতে সংক্রমিত ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে বর্তমান টিকাও অকার্যকর বলে প্রমাণিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একজন কর্মকর্তা। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে করোনার নতুন ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কার্যকর টিকার জন্য বিশ্বকে হয়তো আরো বেশ কিছুদিন, মাস কিংবা বছর অপেক্ষা করতে হবে। ততদিন আমাদের নিরাপদে থাকার সব প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে।

শুরু থেকেই করোনাভাইরাস অতিমারী মোকাবেলায় বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য আত্মনির্ভরতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। স্বল্পতম সময়ে দেশে উন্নতমানের পিপিই, মাস্ক, সেনিটাইজার উৎপাদন, করোনাভাইরাসের সিম্পটম মোকাবেলায় হাইড্রেক্সিক্লোরোকুইন, ইভারমেকটিন, রেমডিসেভির ইত্যাদি ওষুধ উৎপাদন ও বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। করোনা শনাক্তরণে গণস্বাস্থ্যের র‌্যাপিড টেস্টকিট, নিজস্ব প্রযুক্তিতে বেশ কয়েকটি কোম্পানীর ভেন্টিলেটর উদ্ভাবন এবং দেশীয় ওষুধ কোম্পানী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান গেøাব বায়োটেকের নিজস্ব করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদন প্রকল্পের কথাও করোনার প্রথম ধাক্কার সময়েই জানা গিয়েছিল। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, দেশীয় এসব উদ্যোগের সাথে সরকারের সংশ্লিষ্টদের তেমন উৎসাহিত দেখা যায়নি। বরং এসব ইতিবাচক প্রকল্পকে উৎসাহিত ও প্রণোদিত করার বদলে বিদেশি কোম্পানী ও বিশেষ দেশের বিশেষ গোষ্ঠীর সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের চুক্তিতেই বেশি আগ্রহী দেখা গেছে। সেসব তৎপরতা ইতিমধ্যে জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। করোনা অতিমারী মোকাবেলার একমাত্র মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে টিকা থেকে বঞ্চিত হওয়ার বাস্তবতা যেকোনো জাতির জন্য জীবন-মরণ সংকটের সমতুল্য। বিশেষ রাজনৈতিক স্বার্থ বা কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানের মুনাফাবাজির জন্য যদি জাতিকে এমন মূল্য দিতে হয়, তাহলে সেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দেশের মানুষ কখনো ক্ষমা করবে না। রাষ্ট্রের কাছে দেশের মানুষের নিরাপত্তাই হচ্ছে প্রথম ও শেষ কথা। একটি বৈশ্বিক অতিমারী মোকাবেলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব সেখানে কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠির স্বার্থের গ্যাঁড়াকলে যদি রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ ও নিরাপত্তা চরমভাবে ব্যহত হয়, তার দায় রাষ্ট্র ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের উপরই বর্তায়। জননিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা ব্যতিরেকে এ দায় থেকে মুক্তির কোনো বিকল্প পথ নেই।

এ সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে বাংলাদেশ ও নেপালের করোনা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ বলে আখ্যায়িত করেছে। আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশিদের প্রবেশে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ থেকে স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে, আমাদের অর্থনীতি, বাণিজ্য, বৈদেশিক কর্মসংস্থানসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে করোনা অতিমারী দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সৃর্ষ্টি করতে চলেছে। করোনাভাইরাসের শুরুতেই বিশ্বব্যাপী লকডাউন ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, সীমান্ত, স্থল ও আকাশ যোগাযোগ বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে এমন আশঙ্কা মূর্ত হয়ে উঠেছিল, এই করোনা ভাইরাস সফলভাবে মোকাবেলার উপর আগামীতে জাতিসমূহের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভর করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট বৃটেন, চীন, রাশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু দেশ ইতিমধ্যে করোনা ভ্যাক্সিনেশনের অনেকটা অগ্রগতি অর্জনের মধ্য দিয়ে তারা এই ভাইরাস মোকাবেলায় সাফল্যের প্রথম ধাপ অতিক্রম করতে চলেছে। গত বছর যেসব দেশ হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর মিছিল প্রত্যক্ষ করেছে, সেসব দেশে এখন রিওপেনিং করে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করতে চলেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে পড়ার ধারাবাহিক ঘটনাক্রম বড়ই বিস্ময়কর। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ একই সাথে ভারত ও চীনের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে চলেছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলা এবং সবার আগে সফল ভ্যাক্সিনের বাণিজ্যিক উৎপাদনে চীনের সাফল্য সারাবিশ্বের জন্য ঈর্ষণীয় ও অনুকরণীয় বিষয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের করোনা ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে কোনো একক দেশ বা কোম্পানির উপর নির্ভর করা অনেক বড় বোকামি ও অপরিনামদর্শীতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের সরকার সে কাজটিই করেছে। দেশের কোটি কোটি মানুষকে আধিপত্যবাদী রাজনীতি, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও কর্পোরেট স্বার্থের বলি হওয়ার এক চরম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হল বাংলাদেশে।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের আগে চীনের সিনোভ্যাক বাংলাদেশকে করোনা ভ্যাকসিন দেয়ার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হওয়া সত্তে¡ও সেখানে সরকারি সমর্থন ও অনুমোদন দেয়ার পরও সময় ক্ষেপণ করে শেষ পর্যন্ত সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি করে সিনোভ্যাকসহ অন্যসব সুযোগগুলোকে দূরে সরিয়ে দেয়ার বাস্তবতায় এখন বাংলাদেশের কোভিড টিকাদান কর্মসূচি শুরুতেই হোঁচট খেয়ে থেমে গেছে। এখন উপায়ন্তর না দেখে বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে দেশেই টিকা উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। গত বছরের শুরুতেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হলে বাংলাদেশ এখন ভ্যাকসিনেশনে হয়তো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত। সম্মুখ সারির করোনাযোদ্ধাসহ এরই মধ্যে দেশের অর্ধেক মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে এখন হয়তো নতুন করে লকডাউনের প্রয়োজন হতো না। ভারতের ক্ষমতাসীনদের খুশি রাখতে চীনের সদিচ্ছার প্রতি অবজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় ক্ষতি ডেকে এনেছে। এ ক্ষতি কমিয়ে আনতে এবং করোনা ভ্যাকসিনেশন দ্রæতায়িত করতে এখন চীন, রাশিয়াসহ বিকল্প উৎসগুলো থেকে যথাশীঘ্র ভ্যাকসিন সংগ্রহ নিশ্চিত করতে বাড়তি উদ্যোগ ও তৎপরতা চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্যিক লেনদেন যেন আবারো কোনো বিশেষ গোষ্ঠির স্বার্থের গ্যাঁড়াকলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নিপতিত না হয়। ভারতের ভ্যাকসিন ধোকাবাজির পর এখন আমরা করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের হুমকির মুখোমুখি। এহেন বাস্তবতায় নতুন ধাঁচের করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে দেশের হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত রাখাসহ সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিশ্চিত রাখতে হবে। করোনার ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে সারাবিশ্ব। করোনা তৃতীয় ঢেউয়ের বিপদে পড়ার আগেই বিশ্বকে বাংলাদেশে পাশে দাঁড়ানোর কূটনৈতিক তৎপরতা এখনই শুরু করতে হবে।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন