চিত্রকররা রংতুলির জাদুতে ফুটিয়ে তুলেন অসংখ্য গল্প, অনুভ‚তি কিংবা ঘটনাপ্রবাহ। রংতুলির আঁচড়ের সেই অভিব্যক্তি দর্শনার্থীদের মাঝে তৈরী করে চোখের প্রশান্তি। আর সেই প্রশান্তির হাওয়া প্রাকৃতিক নিসর্গের লাল ইটের ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে দিতে উদ্যেগ নিয়েছে কয়েকজন তরুণ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম ব্যাচের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ মামুর এই উদ্যেগের মূল কারিগর। তবে তার সঙ্গে আরও যুক্ত আছেন একই বিভাগের অপর্ণ অধিকারি, আবির আর্য, থিন জো মং, বিপিন চাকমা, ফারজাদ দিহান, জাকিয়া রহমান।
নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে তারা শুরু করলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উচুনিচু লাল নোংরা দেয়ালগুলো রাঙানোর কাজ। নিজেদের কল্পনার রাজ্যে বাস করা ছবিটি রংতুলির ছোঁয়ায় জুড়ে দিতে থাকেন দেয়ালের গায়ে। এভাবে একে একে দেয়ালগুলোতে স্থান পেয়েছে ৪০টি মনমাতানো ছবি।
যেসব ছবিতে আমাদের লোকজ নকশা, ছায়াপথ, কার্টুন, বাংলা সাহিত্যের ভালোবাসার তিন দাদা ‘ঘনাদা’ ‘টেনিদা’ আর ‘ফেলুদা’র মত চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া আইরিশ সিনেমা ‘সং অব দ্য সী’ এবং জাপানি সিনেমা ‘মাই নেইবর তোতোরো’র মতো জগৎবিখ্যাত অ্যানিমেশন মুভির বাহারি চিত্রকর্ম।
নানা রঙয়ের এসব চিত্রকর্ম যে কারও মনকে উদ্বেলিত করে তুলে। রাতের অন্ধকারে এসব চিত্র ধারণ করে ভিন্নরূপ। মনোমুগ্ধকর এই রংতুলির কারসাজি থেকতে প্রতিদিনই ক্যাম্পাসে ভিড় জমাচ্ছেন অসংখ্য দর্শনার্থী। ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করে রাখছেন এই বিশেষ দৃশ্যগুলোকে। চমৎকার সব দৃশ্যপটগুলো ক্যাম্পাসের লাল ইটের বিবর্ণ দেয়ালগুলোর সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করেছে শতগুণ। দেয়ালগুলো যেন নতুন কোনো প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। এরফলে জাবি যেন আরেকবার পরিচিত হচ্ছে সবুজের রাজধানী, অতিথি পাখি, লাল শাপলা, পদ্মফুল ও সংস্কৃতির রাজধানীর পাশাপাশি রংতুলির ক্যাম্পাস হিসেবে।
সর্বশেষ তারা রংতুলিতে স্মরণ করলেন বাংলা চলচিত্রের তিন কিংবদন্তিকে। যারা বাংলা চলচ্চিত্র অঙ্গনে দীর্ঘদিন মানুষকে বিনোদিত করেছেন। এটিএম শামসুজ্জামান, হুমায়ূন ফরীদি ও দিলদারের চিত্রকর্ম তুলে ধরা হলো বিশ্ববিদ্যালয়টির ব্যবসায় অনুষদের নিকটবর্তী বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারের জন্য ব্যবহৃত ভবনের দেয়ালে। ভবনের চার দেয়াল জড়ে কাল ও হলুদ রঙয়ে ফুটে উঠেছে কিংবদন্তিদের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
১৯৪৫ সালের ১৩ জানুয়ারি দিলদার জন্মেছিলেন চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহতলী গ্রামে। বাংলা চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতার তালিকা করতে গেলে অপ্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে তিনি থাকবেন সবার উপরে। একটা সময় বাংলা চলচ্চিত্র মানেই দিলদারের উপস্থিতি থাকা বাঞ্ছনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি চিত্রনাট্যকারেরা সিনেমার গল্পে দিলদারকে রাখার জন্য আলাদা ভাবে চিত্রনাট্য লিখতেন এমনটাও শুনা যায়। তিনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যে, তাকে নায়ক বানিয়েই ‘আবদুল্লাহ’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল। ৮০ এবং ৯০ এর দশকে এদেশের প্রতিটি মানুষকে সব থেকে যে মানুষটি হাসিয়েছেন তিনি অবশ্যই দিলদার। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে এই রংতুলির দিলদার আমাদেরকে হাসাতে না পারলেও এই প্রতিচ্ছবি তার কর্মকে স্মৃতির মনসপটে তুলে আনবে আরেকবার।
১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বরে নোয়াখালীতে জন্ম নেয়া আরেক খ্যতিমান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। এবছরের ২০ ফেব্রæয়ারিতে ৭৯ বছর বয়সে আমাদেরকে ছেড়ে চলে যান তিনি। মৃত্যুর আগে অসংখ্য চলচ্চিত্র এবং নাটকে অভিনয় করে মন জয় করে নিয়েছিলেন গোটা দেশের বিনোদন পিয়াসীদের। ছিলেন পরিচালক এবং লেখকও। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন অসংখ্যবার, ভ‚ষিত হয়েছেন একুশে পদকেও। সদা প্রাণোচ্ছল এই মানুষটার অবদান এদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গন ভুলবেনা কখনোই। সেই অবদানকে স্মরণ করে শিল্পির রংতুলিতে জাবির দেয়ালে এখন জীবন্ত প্রতিচ্ছবি তিনি।
১৯৫২ সালের ২৯ মে পুরান ঢাকার নারিন্দাতে জন্মেছিলান হুমায়ূন ফরীদি। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি তাঁর ধানমন্ডির বাসায় পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যান এই শক্তিমান অভিনেতা। মঞ্চ নাটক, টিভিনাটক এবং চলচ্চিত্র; মাতিয়েছেন পুরো বিনোদনজগৎই। পড়াশোনা করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। তাঁর ক্যাম্পাস জীবনের অদ্ভুত সব ঘটনার কথা এখনো বেশ জনপ্রিয় এই ক্যাম্পাসের বর্ণে-ছন্দে-গন্ধে। রংতুলির আচঁড়ে আরেকবার স্মরণ করা হলো বাংলার বিনোদন জগতের এই মাহন অভিনেতাকে।
এই বিষয়ে আবদুল্লাহ মামুর বলেন, ‘হুমায়ুন ফরিদী, এটিএম শামসুজ্জামান ও দিলদারের প্রতিকৃতি আঁকার মাধ্যমে আমাদের এই দেয়াল রাঙানোর কার্যক্রমে বাংলা চলচিত্রকেও জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। বাংলা চলচিত্র নিয়ে আমাদের আরও আঁকার ইচ্ছে আছে।’
ক্যাম্পাসের দেয়ালগুলোতে রঙ দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তরুণ এই চিত্রশিল্পি বলেন, ‘আমি যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি তখন প্রাঙ্গণ ভরা সবুজের মধ্যে লাল দেয়ালগুলো দেখতে বেশ লাগত। তখন এখানকার লাল ইটের দালানেও কেমন যেন একটা প্রাণ ছিল। সবুজের মাঝে লাল যেন চিকমিক করে উঠত, সবুজ টিয়া পাখির গলার লাল মালার মতোই।’
তিনি আরও বলেন, ‘তখন কোনো কোনো দেয়ালে রাজনৈতিক ¯েøাগান চোখে পড়ত, যাকে বলে ‘চিকা মারা’। এ ছাড়া দেয়ালগুলোতে আর তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু বছর না ঘুরতেই খেয়াল করলাম ‘চিকা’র পাশাপাশি দেয়ালগুলো বিসিএস কোচিং, লোকাল হেকিমি দাওয়াখানা, পড়াইতে চাই, ‘মেছ’ ভাড়া হবেসহ নানা বিজ্ঞাপন-পোস্টারে ছেয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হলো আরেকটা বাজে চর্চা। তা হলো দেয়ালে স্প্রে রং দিয়ে ব্যাচের নাম, নিজের নাম লিখে দেয়াল নষ্ট করা।’
‘ঝকঝকে লাল ইটের দেয়ালগুলো চোখের সামনেই আস্তে আস্তে নোংরা হয়ে যেতে দেখলাম। প্রশাসনিকভাবে ক্যাম্পাসের দেয়ালে কিছু লেখা-আঁকার নিয়ম নেই। তারপরও যখন দেয়ালগুলো এভাবে দৃষ্টিকটু বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, ভাবলাম কিছু তো একটা করা দরকার। সেই দরকার থেকে ছবি আঁকার মাধ্যমে দেয়াল রাঙানোর কাজ শুরু করলাম।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন