মোঃ তোফাজ্জল বিন আমীন
ঈদের প্রাক্কালে টঙ্গির বিসিক শিল্প নগরীর টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড নামের কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে সৃষ্ট ভয়াবহ অগ্নিকা-ে যে মানবিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা বর্ণনাযোগ্য নয়। আগুনে চারতলা ভবনের প্রায় পুরোটাই ধসে পড়ে। কারখানা ছাপিয়ে আশপাশের বাসাবাড়ি ও কারখানায় ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। অগ্নিকা- ও ভবন ধসে নারী ও শিশুসহ সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ৩৪ জন নিহত এবং শতাধিক লোক আহত হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে অনেকে। উদ্ধার কাজ এখনো চলছে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে শনিবার অফিস শেষে বেতন ও বোনাস দেয়ার কথা ছিল। শ্রমিকরাও ছিল বেশ খোশ মেজাজে। ঈদের বেতন আর বোনাস নিয়ে প্রিয়জনের কাছে ছুটে যাওয়ার প্রহর গুণছিল তারা। কিন্তু ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা তাদের সকল আশা ও স্বপ্নকে ভেঙ্গে দুঃস্বপ্নে পরিণত করে দিয়েছে। তাদের স্বপ্ন ছিল প্রিয়জনের সাথে ঈদ উদযাপন করার কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তারা অকালে চলে গেল না ফেরার দেশে। এই দুর্ঘটনায় যারা প্রিয়জনকে হারিয়েছে তাদের সান্ত¦না দেবার ভাষা পৃথিবীর কোন অভিধানে নেই।
নিষ্ঠুর, মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক শব্দগুলো এখন আর কাউকে আলোড়িত করে না। কারণ, প্রতিনিয়ত নিষ্ঠুরতার বীভৎসতার ছবি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি ও কারখানায় মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনার ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত কারখানার শ্রমিকের শরীর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও মৃত্যুর মিছিলের রাস টেনে ধরা যাচ্ছে না। দিন যতই যাচ্ছে ততই উদ্বেগ ও যাতনা বাড়ছে। কোথাও যেন এতটুকু জায়গা নেই যেখানে নির্বিঘেœ দাঁড়িয়ে বলা যায়, ভালো আছি।
আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। আর ভুলেই বা যাব না কেন আমরা তো জোয়ার ভাটার দেশের মানুষ। শিল্প ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা। ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সকাল নয়টায় সাভার মোড়ে অবস্থিত রানা প্লাজা ধসের শিকার হয়। রানা প্লাজা ধসে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের ক্ষতি অপূরণীয়। যেসব পরিবার তাদের প্রিয়জন হারিয়েছে সেই ক্ষতিপূরণ করাও সম্ভব নয়। অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের এখনও খুঁজে পায়নি, তাদের সান্ত¦না দেয়া অসম্ভব
বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে বয়লার বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা নতুন নয়। কারখানাগুলোতে অনিরাপদ বয়লার ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে বহুবার। তারপরেও সংশ্লিষ্ট মহলের ঘুম ভাঙ্গেনি। একটি দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর শুধু কমিটি আর তদন্তের মধ্যে সবকিছু আটকে যায়। যদিও বয়লারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে রয়েছে সরকারের একটি বিভাগ। শিল্প প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে নিরীহ শ্রমিকেরা। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। রাজা প্লাজা দুর্ঘটনার কথা মনে হলে আজো গায়ের পশম শিউরে ওঠে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব কারখানা আগুনে পুড়েছে তার কিছু চিত্র পাঠকের জ্ঞাতার্থে পেশ করছি। নিকট অতীতে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগেছিল। কারখানাটিতে প্রায় দুহাজার শ্রমিক কাজ করতো যাদের অধিকাংশই নারী। আগুনের লেলিহানে ১২৪ জন শ্রমিক নিহত হয়। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার তিন মাস আগে ২৬ জানুয়ারি ২০১৩ সালে স্মার্ট এক্সপোর্ট কারখানায় অগ্নিকা-ে প্রাণ হারায় ৭ জন। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসে আগুন লেগে প্রাণ হারায় ১১৩ জন। ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির রাতে গাজীপুরের গরীব এন্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকা-ে মারা গেছে ২৫ জন। ১৫ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে ঢাকাস্থ হা মীম গ্রুপের দ্যাটস ইট স্পোর্টস কারখানায় অগ্নিকা-ে মারা গেছে ২৪ জন। ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের কেটিএস কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলে আগুন লেগে মারা যায় ৯১ জন। ওই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুরের যমুনা স্পিনিং মিলে অগ্নিকা-ে মারা যায় ৬ জন। ২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল সাভারের বাইপাইলে স্পেকট্রাম গামেন্টস ধসে মারা যায় ৭৪ জন। একই বছরের ৭ জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের একটি গামেন্টস কারখানায় আগুন লেগে মারা যায় ২২জন। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে নরসিংদীর শিবপুরে গামেন্টস কারখানায় অগ্নিকা-ে ৪৮ জন মারা যায়। ওই বছরের ৩ মে মিসকো সুপার মার্কেট কমপ্লেক্সের এক গামেন্টসে আগুন লেগে মারা যায় ৯ জন। শ্রমিকের অসহায় মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। আমরা আশা করবো, কারখানা বা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে আর যাতে অগ্নিকা- না ঘটতে পারে, সে জন্য সরকার ও শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে সমন্বিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। নিহত শ্রমিকদের পরিবারসমূহকে যাতে পথে বসতে না হয়, সে জন্য উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছাড়াও তাদের পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সবার আগে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। টাম্পাকো ফয়েলস দুর্ঘটনায় শ্রমিক মৃত্যুকে ¯্রফে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। এটাকে দুর্ঘটনা বলে এই মৃত্যুর দায় এড়ানো যাবে না। আমরা নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। পাশাপাশি আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার জন্যে সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন