হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেনের মৃত্যুর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, রিমান্ডে নির্যাতনের শিকার হয়েই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাওলানা ইকবাল হোসেনের দুঃখজনক মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনা আবারো দেশের ভাবমর্যাদাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করবে। কারা হেফাজতে প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই। বৃহস্পতিবার রাতেই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে পুলিশি পাহারায় হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেনের লাশ দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। এর আগো মুন্সিপুর ঈদগাহ মাঠে মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, পুলিশি পাহারায় দাফন করা হয়েছে হেফাজতে ইসলামের সোনারগাঁওয়ের নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেনের লাশ। গত বৃহস্পতিবার রাতেই সোনারগাঁও উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের ইকবাল হোসেনের পৈত্রিক বাড়ি মুন্সিপুর গ্রামে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তার বাবার কবরের পাশেই দাফন করা হয়। এর আগে, মুন্সিপুর ঈদগাহ মাঠে নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়।
স্থানীয়রা জানায়, জানাজা ও দাফনের সময় ওই এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ মোতায়েন ছিল। এর আগে সোনারগাঁওয়ে হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডের ঘটনায় সহিংসতার মামলায় গত ১১ এপ্রিল রাজধানীর জুরাইন থেকে গ্রেফতার হওয়া মাওলানা ইকবাল হোসেন কারাবন্দি অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
মাওলানা ইকবাল হোসেনের পারিবারিক সূত্র জানায়, গত ১৫ মে সোনারগাঁও উপজেলা হেফাজতে ইসলামের সহ-সভাপতি ও উপজেলা খেলাফত মজলিসের সভাপতি মাওলানা ইকবাল হোসেন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসার জন্য রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সোনারগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান জানান, রাতে লাশ সোনারগাঁও নিয়ে আসলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পুলিশের উপস্থিতিতে তার গ্রামে দাফন করা হয়েছে।
উল্লেখ, ৩ এপ্রিল সোনারগাঁওয়ে রয়েল রিসোর্টে মাওলানা মামুনুল হকের নারী কেলেঙ্কারি ঘটনা পরবর্তী সংহিসতার ঘটনায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়। সে মামলায় ১১ এপ্রিল রাজধানীর জুরাইন এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব।
হেফাজত মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম: হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বিলুপ্ত কমিটির কারাবন্দি নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেনের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম। গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, হেফাজতের সোনারগাঁ উপজেলার নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেন গতকাল কারাবন্দি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গত ১২ এপ্রিল সোনারগাঁ থানার দুই মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এরপর থেকে রিমান্ড ও কারাগারে ছিলেন তিনি।
হেফাজত মহাসচিব বলেন, আমরা জানতে পেরেছি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার পরেও তাকে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয়নি। উন্নত চিকিৎসা না দিয়েই তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, অনতিবিলম্বে মাওলানা ইকবাল হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হোক। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মাওলানা ইকবাল হোসেনকে নির্যাতন করা হয়েছে কি না, সে বিষয়েও তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে আল্লামা নুরুল ইসলাম সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি মরহুমের রূহের মাগফেরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) : কারাবন্দি হেফাজতে ইসলামের নেতা এবং খেলাফত মজলিশের সোনারগাঁও উপজেলার সভাপতি মাওলানা ইকবাল হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন কারা হেফাজতে মসজিদের ইমামের মৃত্যুর দায় কার?
ববি হাজ্জাজ বলেন, কারা অভ্যন্তরে শারীরিক নির্যাতন না করা এবং বন্দিদের সব ধরনের মানবাধিকার রক্ষা করার ব্যাপারে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, ভিন্নমতকে দমনের জন্য বর্তমান সরকার ধারাবাহিকভাবে রিমান্ডের অপব্যবহার করছে। লেখক মোশতাকের পর এবার কারাগারে মারা গেলেন একজন মসজিদের ইমাম এবং রাজনৈতিক নেতা। আমরা মনে করি, রিমান্ডে নির্যাতনের শিকার হয়েই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাওলানা ইকবাল হোসেনের এই দুঃখজনক মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনা আবারো দেশের ভাবমর্যাদাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করবে। কারা হেফাজতে প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই। সরকারের কাছে আমরা জানতে চাই, কারা হেফাজতে মৃত্যুর মিছিলের দায় কার? সেইসাথে রিমান্ডের অপব্যবহার রোধ করতে প্রধান বিচারপতিকে উদ্যোগ নিতে আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
গণসংহতি আন্দোলন : রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নারায়ণগঞ্জের হেফাজতে ইসলামের নেতা ইকবাল হোসেনের মৃত্যুতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে দোষীদের শাস্তি দাবি করেন। গণসংহতি আন্দোলনের এই নেতা বলেন, রাষ্ট্রের হেফাজতে থেকে যে কারো মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। এই ভোটারবিহীন অগণতান্ত্রিক সরকারের হেফাজতে থেকে নির্যাতনে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এই মৃত্যুর মিছিল আর কোনোভাবেই বাড়তে দেয়া যাবে না।
বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি পুলিশের রিমান্ডে নারায়ণগঞ্জের হেফাজত নেতা ইকবাল হোসেনের মৃত্যুর ঘটনা নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষ দ্বারা বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি দাবি করে গণসংহতি। এতে আরো বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু একটা ভয়ঙ্কর অপরাধ। এটা রাষ্ট্রীয় অপরাধ। এই অপরাধের তদন্ত অভিযুক্ত সংস্থার মাধ্যমে হওয়া ন্যায়বিচারের পক্ষে একটা বড় বাধা। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর তদন্ত বিচার বিভাগের মাধ্যমে নিরপেক্ষভাবে করতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ছাড়া একে কখনোই স্বাভাবিক মৃত্যু বলা যায় না।
হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার কারাবন্দী হেফাজত নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেনের ইন্তেকালে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন হেফাজতের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী।
গতকাল শুক্রবার সংবাদমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে হেফাজত আমির বলেন, মাওলানা ইকবাল হোসেনকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। রিমান্ডে অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসার জন্য হসপিটালে ভর্তি করা হয়। আমরা জানতে পেরেছি, অসুস্থ হওয়ার পরও সঠিক সময়ে তাকে যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়নি। কারাবন্দী অবস্থায় গতকাল হসপিটালেই তার মৃত্যু হয়েছে। মাওলানা ইকবাল হোসেনের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত।
তিনি আরো বলেন, কারাবন্দী অবস্থায় অসুস্থ হলে কয়েদিকে যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেয়ার বিধান রয়েছে। মাওলানা ইকবাল হোসেনকে যথাযথ চিকিৎসা সেবা না দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কারা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট আহবান করছি।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আরো বলেন, গ্রেফতার হওয়া ওলামায়ে কেরামের মধ্যে অনেক বয়োবৃদ্ধ আলেম রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে খবর পেয়েছি। অসুস্থ হওয়া ওলামায়ে কেরামসহ এ পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া সকল আলেমদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করছি।
আমিরে হেফাজত বলেন, মাওলানা ইকবাল হোসেন হেফাজতে ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ একজন দায়িত্বশীল ছিলেন৷ কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা ইসলামের জন্য তাঁর এ ত্যাগ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
মরহুমের শোকাহত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে আমিরে হেফাজত বলেন, মহান প্রভুর দরবারে আমি দু’আ করি আল্লাহ তায়ালা তার সকল দীনি খিদমতকে কবুল করুন, তাকে জান্নাতে উঁচু মাকাম দান করুন এবং পবিবারকে সবরে জামিল দান করুন, আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন