হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ হলো উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক সংগঠন, যা ইসলামি অধিকার রক্ষার জন্য পথচলা শুরু করেছিল। হেফাজতের উত্থানের আগে এর পটভূমি জানা দরকার। উপমহাদেশে দেওবন্দ মাদরাসা ইসলামি শিক্ষায় এক বিরাট নাম। ভারতে মুসলিম শাসনের অবসানের পরই ১৮৬৬ সালে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশেষ উদ্দ্যেশ্য নিয়ে। ১৮৫৭ সালে যখন সিপাহী বিদ্রোহে ব্রিটিশরা জয়ী হলো এবং দিল্লীর মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হলো তখনই মূলত ইসলামি আকিদা এবং শিক্ষা প্রচার ও গবেষণার জন্য ছত্তেওয়ালি মসজিদে দেওবন্দ মাদরাসার যাত্রা শুরু হয়েছিল। তখন একজন শিক্ষক এবং একজন মাত্র ছাত্র নিয়ে এর পথচলা শুরু হলেও পরবর্তীতে তামাম জাহানের ছাত্র-শিক্ষকরা এখান থেকে জ্ঞান আহরণ করেছেন এবং করছেন। ব্রিটিশদের হাতে ক্ষমতা হারালেও যাতে ইসলাম না হারায় সেই চিন্তা থেকেই এর উৎপত্তি। এখান থেকেই ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা শিক্ষা নিয়েছেন। ১৯ শতকের শেষের দিকে ইসলামি শিক্ষা প্রচার ও প্রসারের জন্য বাংলাদেশের ভূখন্ডে ১৮৯৬ সালে চট্টগ্রামে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম মাদরাসার যাত্রা শুরু হয়। এটি বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশের তরুণদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কওমি মাদরাসায় শিক্ষা নিয়ে থাকেন। কওমি মাদরাসার বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিন আরাবিয়া বাংলাদেশের অধীনে ঠিক কতটি মাদরাসা আছে এবং এর শিক্ষার্থী সংখ্যা কত তার সঠিক তথ্য এখনো সামনে আসেনি। একটি তথ্য বলছে, বেফাকের অধীনে ৫৪৫১টি মাদরাসা আছে। আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রায় ১৪ হাজার কওমি মাদরাসা আছে এবং এখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ, যা নেহায়েত কম নয়। এখন প্রশ্ন হলো, কোন পথে বা কীভাবে চলছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা নিয়ে আমরা খুব কমই ভেবেছি। যারাও ভেবেছি তারাও আবার কওমি সিলেবাসকে অর্ধনগ্ন করে সেখানে তথাকথিত পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুপ্রবেশের চিন্তা করছি। মূলত কওমি মাদরাসাগুলো দেশি-বিদেশি সাহায্য কিংবা দান-অনুদানে চলে। তাদের জন্য আমাদের শিক্ষা বাজেটে কোনো বরাদ্দ আছে বলে আমার জানা নেই। একশ্রেণির আলেম এখানে সরকারের অনুদান চান না এই ভয়ে যে, সরকার এখানে হস্তক্ষেপ করবে।
বাংলাদেশের কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মতো। তাদের আধুনিক জ্ঞান দেওয়া হয় না। কুরআন-হাদিসের জ্ঞানের পাশাপাশিও যে অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান কিংবা পারিপার্শ্বিক জ্ঞান অর্জন করা জরুরি তা আমাদের আলেম সমাজ বুঝতে চায় না। ফরহাদ মজহার প্রায়ই বলে থাকেন আমাদের ইসলামিস্টরা যেন মার্ক্সবাদ পড়েন। তাতে করে মার্ক্সবাদের সাথে ইসলামের একটা তুলনামূলক আলোচনা করা যাবে। অধ্যাপক চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের অন্ধ বিরোধিতা করার চেয়ে যদি এই বিবর্তনবাদ পড়ে তারপর ইসলামি জ্ঞানের আলোকে ডারউইনের বিবর্তনবাদকে মিথ্যা প্রমাণিত করা যায় তবেইতো ইসলামি জ্ঞানের সার্থকতা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জাদঁরেল অধ্যাপক প্রায়ই বলতেন, মাদরাসায় যেনো বিবর্তনবাদ পড়ানো হয় কিন্তু আমাদের হুজুরেরা বিবর্তনবাদের নাম শুনলেই রাগে বিগড়ে উঠেন।
কওমি মাদরাসায় বর্তমানে সল্প পরিসরে বাংলা-ইংরেজি পড়ানো হলেও তা ১৪ লাখ তরুণের জন্য যথেষ্ট নয়। এদেরকে যদি কওমির পাশাপাশি প্রচলিত শিক্ষা দেয়া যেতো তবে তারা দেশের অর্থনীতিতে অনেক অবদান রাখতে পারতো। কওমিদের বর্তমানে আরবি সাহিত্য এবং ইসলাম শিক্ষা বিভগের অধীনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া হয়। তাদের দীর্ঘ দিনের দাবি এটি। পাশাপাশি তারা চাচ্ছেন যে ইসলাম সম্পর্কিত বিভাগগুলোতে যেনো তাদের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু তা দেয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দিয়ে কেউ চাকরি পেয়েছে বলে শুনিনি। পাবেই বা কীভাবে? আপনি নিয়োগ দেবেন একজন ইমাম আর প্রশ্ন করবেন পিতাপুত্রের বয়স কিংবা পদ্মাসেতুর পিলার সংখ্যা নিয়ে। এটা নিতান্তই দুঃখজনক।
এবার আসা যাক হেফাজতের রাজনীতি প্রসঙ্গে। হেফাজতের উত্থান হয়েছিল শাহবাগের একদল উগ্র নাস্তিক্যবাদী বøগারের বিরোধিতা করে এবং সরকারের নারীনীতির বিরোধিতা করে, যদিও হেফাজত ইসলাম বরাবরই নারী অধিকারের পক্ষে বলে দাবি করে আসছে। প্রথমদিকে ছোট ছোট কর্মসূচি দিলেও ধীরে ধীরে তারা বড় কর্মসূচির দিকে হেঁটেছে এবং সফলও হয়েছে। ২০১৩ সালের ৫-৬ মে হেফাজতের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে কাজ করেছে। এরপরই মূলত দ্রুত প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়।
স¤প্রতি হেফাজতের কর্মকান্ডে অনেক রাজনৈতিক নেতা নাখোশ। তাদের অভিযোগ, হেফাজত এখন অরাজনৈতিক ব্যানারে রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয় দিয়েছে। যদিও এ প্রসঙ্গে মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘যদি হেফাজতের নীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী হয়, ঈমান ও আকিদার যে দাবি-দাওয়া তার সাথে যদি একমত হয় এবং নাস্তিকদের যদি সমর্থন না করে, তাহলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা যেকোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হলেও হেফাজতের সদস্য হতে বাধা নেই। শর্ত শুধু একটিই, হেফাজতে কোনো দলীয় রাজনীতি করা যাবে না।’ আমরা এমন অনেক সংগঠন দেখেছি, যেখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অরাজনৈতিক কার্যক্রম করে থাকে। হেফাজত একটা প্লাটফর্ম। এখানে এসে যদি কেউ ইসলামি আকিদা প্রতিষ্ঠা করতে চায় তবে তা দোষের বলে মনে করি না।
এখন প্রশ্ন হলো, হেফাজতের রাজনীতিকরণের ভূমিকা কাদের? আমরা দেখেছি, হেফাজত সবসময় ভোটের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। আমরা দেখেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আল্লামা আহমদ শাহ শফিকে ডেকে কওমি সনদ দিয়েছেন। হেফাজত তুষ্টির চেষ্টা প্রায় সকল দলই করেছে। হেফাজত তুষ্টির চেষ্টা প্রথম করা হয় প্রায় ১৫ বছর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মাধ্যমে। তিনি ২০০৬ সালে কওমি সনদের প্রস্তাব করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ এরপরপরই ছিলো জাতীয় নির্বাচন। এরপর ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে যখন হেফাজত জমায়েত করেছিল তখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, সারা দেশ থেকে আলেম-ওলামারা এসেছেন তাদের দাবি নিয়ে। সুতরাং তার দলের নেতাকর্মীরা যেনো তাদের পাশে থাকেন। একই সময়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঘোষণা দেন, তার দলের নেতাকর্মীরা যেনো খাবার-পানীয় নিয়ে হুজুরদের পাশে থাকেন। কিন্তু ঘটনার নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগ নিয়ে নেয়। এরপর ২০১৭ সালে ঠিক জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর দেয়া হয় কওমি সনদ, যা নির্বাচনে ভোটের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, হেফাজতের সাথে তাদের কোনো আঁতাত নেই, তবে হাজার হাজার কওমি শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দেয়া যাবে না। বর্তমানে যখন হেফাজতে ইসলাম কোণঠাসা তখন আবার জোনায়েদ সাকি এবং নুরুল হক নুরু হেফাজত বন্দনা করছেন। যদিও হেফাজত বরাবরই বলে আসছে যে, তারা কখনো কাউকে ক্ষমতায় বসাবেও না কিংবা ক্ষমতা থেকে নামাবেও না।
হেফাজতের উগ্রবাদী অবস্থান নিয়ে মিডিয়া সরব এবং এক শ্রেণির সুশীল সমাজ হেফাজতের তীব্র বিরোধিতা করে। অথচ, হেফাজত নিয়ে ডান-বাম নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল যখন খেলায় মত্ত, তখন তারা এই খেলোয়াড়দের সমালোচনা করে না।
হেফাজতে ইসলাম রাজনীতি করবে কি করবে না, সেটা তাদের একান্ত ব্যাপার। হেফাজত কিংবা কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের কথা কোনো সুধী সমাজ বলে না। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক রাজনীতির ইতিবাচক ফলাফল না পেলেও হাস্যকর ফলাফল পাচ্ছি। যারা বলে, ইসলামে রাজনীতি নেই তাদের জ্ঞানের অভাব বোধ করি অনেক। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন একজন রাষ্ট্রনায়ক, তিনিই প্রথম জগতে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রাদায়ের লোকের সহাবস্থান ছিলো। রোমান সাম্রাজ্য দীর্ঘদিন খ্রিস্ট ধর্মের দ্বারা শাসিত হয়েছে, মৌর্য সাম্রাজ্য বৌদ্ব ধর্মের কন্সট্যান্টাইন খ্যাত সম্রাট অশোক দ্বারা শাসিত হয়েছে তখন এসব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলেনি, এখনও তুলে না। সার কথা হলো, আমরা হেফাজতকে নিয়ে খেলা করছি। যেভাবে খুশি নাচাচ্ছি। এ খেলা বন্ধ করতে হবে। হেফাজতকে কুরআন-হাদিসের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।
বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন