(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
একইভাবে তাদের চক্রান্তে মদীনায় রোমক হামলার আশংকা দেখা দেয়। ফলে ৮ম হিজরীতে মুতার যুদ্ধ ও ৯ম হিজরীতে সর্বশেষ তাবূক অভিযান সংঘটিত হয়। এমনকি ১১ হিজরীতে মৃত্যুর দু’দিন আগেও রোমক হামলা প্রতিরোধের জন্য রাসূল (সা.) ওসামা বিন যায়েদকে প্রেরণ করেন।
এভাবে দেখা যায়, মদীনায় হিজরতের শুরু থেকে রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু পর্যন্ত অধিকাংশ যুদ্ধের পিছনে ইহুদি চক্রান্ত সক্রিয় ছিল। মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি তাদের সে চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে।
রাসুল (সা.)-এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতা রটনা
কা‘ব বিন আশরাফ ছিল মদীনার সবচেয়ে বড় ইহুদি পুঁজিপতি, কবি ও চরম মুসলিম বিদ্বেষী। বদর যুদ্ধে কুরাইশ নেতাদের চরম পরাজয়ে সে রাগে-দুঃখে ফেটে পড়ে। অতঃপর রাসূল (সা.) ও মুসলমানদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে সে কবিতা বলতে থাকে এবং কুরাইশ নেতাদের কবিতার মাধ্যমে উত্তেজিত করতে থাকে। ফলে রাসূল (সা.)-এর নির্দেশে ৩য় হিজরীর ১৪ রবীউল আউয়াল তাকে হত্যা করা হয় (বুখারী হা/৪০৩৭ প্রভৃতি)।
ইহুদিরা স্থায়ীভাবে লাঞ্ছিত
আল্লাহ বলেন, ‘যেখানেই তারা থাকুক না কেন তাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেওয়া হবে, কেবলমাত্র আল্লাহ্র অঙ্গীকার ও মানুষের অঙ্গীকার ব্যতীত। তারা আল্লাহ্র ক্রোধ অপরিহার্য করে নিয়েছে এবং তাদের উপর পরমুখাপেক্ষিতা আপতিত হয়েছে। এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহ্র আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। কারণ তারা অবাধ্য হয়েছে ও সীমালংঘন করেছে’ (আলে ইমরান ৩/১১২)। এখানে ইহুদিদের স্থায়ী লাঞ্ছনার কথা বলা হয়েছে। তবে তারা বাঁচবে কেবল দু’ভাবে। এক. আল্লাহ্র অঙ্গীকার, আর সেটি হ’ল তাদের নারী-শিশুরা। দুই. মানুষের অঙ্গীকার। আর সেটি হ’ল মুসলমান বা অন্যদের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে। যেমন তারা এখন টিকে আছে কতিপয় পরাশক্তির উপর ভর করে। তাদের স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে তারা তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেবে। এভাবে তারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত লাঞ্ছিত হয়েই থাকবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ক্বিয়ামতের পূর্বে ঈসা (আ.) অবতরণ করবেন (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৫৫০৫) এবং মাহদীর নেতৃত্বে সাত বছর পৃথিবী সুন্দর শাসনে ও সুবিচারে ভরিয়ে দেবেন (আবুদাঊদ হা/৪২৮৫; মিশকাত হা/৫৪৫৪; মুসলিম হা/১৫৬; মিশকাত হা/৫৫০৭)। এসময় মুসলিমগণ তাঁর অনুসারী হবে এবং ইহুদিরা দাজ্জালের অনুসারী হবে (মুসলিম হা/২৯৪৪; মিশকাত হা/৫৪৭৮)। ঈসা (আ.) বায়তুল মুক্বাদ্দাসের ‘লুদ’ নামক দরজার পাশে দাজ্জালকে হত্যা করবেন (মুসলিম হা/২৯৩৭; তিরমিযী হা/২২৪৪; মিশকাত হা/৫৪৭৫)। তখন মুসলমানরা ইহুদিদের ব্যাপকভাবে হত্যা করবে। তারা পাথর ও গাছের পিছনে লুকাবে। সে সময় গাছ ও পাথরগুলি বলবে, এই যে আমার পিছনে একটা ইহুদি লুকিয়ে আছে (মুসলিম হা/২৯২২; মিশকাত হা/৫৪১৪)।
ইহুদি-নাছারা ও কাফেরদের সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি আল্লাহ্র হুঁশিয়ার বাণী
(১) আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি-নাছারাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তারা তাদের মধ্যে গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (মায়েদাহ ৫/৫১)। (২) তিনি বলেন, ‘মুমিন ছাড়া কোন কাফিরকে মুমিনগণ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করবে না। যদি কেউ এটা করে, তবে তাদের সঙ্গে আল্লাহ্র কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি কি-না তোমরা তাদের থেকে কোনরূপ অনিষ্টের আশংকা কর (তবে বাহ্যিক সম্পর্ক রাখা যাবে)। আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজ সত্তার ভয় দেখাচ্ছেন। (মনে রেখ) সবাইকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে’ (আলে ইমরান ৩/২৮)। এ কারণে ইসলাম ও ইসলামী খেলাফতের মৌলিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণকারী বিষয়সমূহ বাদে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি-বাকরি ইত্যাদি বিষয়ে অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলায় কোন বাধা নেই।
ওসমানীয় খেলাফত ধ্বংসের কারণ ছিল ফিলিস্তিন ইস্যু
খেলাফতে রাশেদাহ, খেলাফতে উমাইয়া, আব্বাসীয়, স্পেনীয় ও সর্বশেষ ওসমানীয় খেলাফতের সকল যুগে এরা বাহ্যিকভাবে বন্ধু সেজে ভিতর থেকে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করেছে। ওসমানীয় খেলাফত কালে তারা খৃষ্টান সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় খেলাফত ধ্বংসের কাজে লিপ্ত হয় এবং সেই সাথে ফিলিস্তিন দখলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।
এই সময় আন্তর্জাতিক ইহুদি সংস্থার প্রধান থিওডোর হার্জেল (১৮৬০-১৯০৪ খৃ.) জার্মানী, বৃটেন ও ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেন। তিনি তাদের কাছ থেকে ওসমানীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। এসময় খেলাফতে চলছিল চরম আর্থিক দৈন্য। এটাকে সুযোগ হিসাবে নিয়ে হার্জেল ওসমানীয় খলীফা ২য় আব্দুল হামীদের (১৮৭৬-১৯০৯ খৃ.) দরবারে তার প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। তিনি প্রস্তাব করেন, হে খলীফা! আমরা আপনার আর্থিক সংকট মোকাবিলার জন্য ২০ মিলিয়ন লীরা (তুর্কী মুদ্রা) দান করব। এর মধ্যে ২ মিলিয়ন থাকবে ফিলিস্তিনের জন্য এবং বাকী খেলাফতের ঋণ পরিশোধের জন্য। এছাড়া খলীফাকে প্রয়োজনে আমরা যেকোন ঋণ সহায়তা দেব’। তিনি বলেন, যদি আমরা ফিলিস্তীন পাই, তাহ’লে আমরা তুরস্কের জন্য আরও বহু অর্থ ও উপঢৌকন প্রদান করব’। জওয়াবে খলীফা বললেন, ‘আমি এই পবিত্র ভূমির এক বিঘত পরিমান মাটিও হ্রাস করতে পারব না।...আমি আমার দেহে ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে দেব না, যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি’।
সুলতানের এই কড়া জবাব পাওয়ার পর ইহুদি নেতারা অন্য পথ ধরেন। তারা তুরস্কে তাদের দোসর নব্য তুর্কীদের দিয়ে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও জাতীয়তাবাদের প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তাদের ইঙ্গিতে নতুন সংগঠনের জন্ম হয় ‘জমঈয়াতুল ইত্তিহাদি ওয়াত তারাক্কী’ বা ‘ঐক্য ও উন্নয়ন সংস্থা’।
তারা সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করেন। সাথে সাথে তরুণদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উস্কানী দিয়ে তাদেরকে খলীফার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন। তারা ইসলামী জাতীয়তাবাদের স্থলে তুর্কী জাতীয়তাবাদের স্লোগান ও বিভিন্ন গান তৈরি করেন। বস্তুতঃ এই লোকগুলি ছিল ইসরাইলের গুপ্ত বাহিনী ‘মোসাদ’-এর চর। যারা ইসলামকে মুমিনের জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চায়। অতঃপর তারা খলীফাকে পদত্যাগে বাধ্য করে এবং তাকে গ্রীসের সালানীক দ্বীপে নির্বাসনে পাঠায়। অতঃপর তাঁর ভাই ৫ম মুহাম্মাদকে (১৯০৯-১৯১৮ খৃ.) ক্ষমতায় বসায়।
ইহুদীরা প্রধান সেনাপতি কামাল পাশাকে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে (৪৩৭-৩৯ পৃ.)। অতঃপর তার মাধ্যমে একে একে পরবর্তী খলীফাদের সরিয়ে ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ ‘খেলাফত’ বিলুপ্ত করে। অতঃপর তারা কামাল পাশাকে ‘আতাতুর্ক’ অর্থাৎ ‘তুর্কী জাতির পিতা’ উপাধি দিয়ে ক্ষমতায় বসায়।
এভাবে ওমর (রা.) কর্তৃক ১৫ হিজরীতে ফিলিস্তিন অধিকারের পর থেকে ১৩৪২ হিজরী পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩২৭ বছর ফিলিস্তিন মুসলিম অধিকারে থাকে। যদিও মাঝে ক্রুসেড কালে কিছু সাময়িক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল, যা গাযী সালাহউদ্দীন আইয়ূবীর হাতে শেষ হয়ে যায়। অতঃপর ১৯৪৮ সালের ১৪ মে পরাশক্তিগুলির মাধ্যমে কথিত ‘ইসরাইল’ রাষ্ট্র জন্ম নেয়, যা মূলত তেল সম্পদে সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের উপর ছড়ি ঘুরানোর উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। সূরা আ‘রাফ ১৬৮ আয়াতের মর্ম অনুযায়ী নিশ্চিতভাবেই এটি সাময়িক। কখনোই রাষ্ট্র হিসাবে এটি স্থায়ী হবে না। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত। (সমাপ্ত)
লেখক: আমীর, আহলে হাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন