শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনাকালে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় আত্মঘাতী প্রবণতা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০২১, ১২:০২ এএম

করোনা পেন্ডেমিকের প্রথম আঘাত লেগেছিল ইউরোপ-আমেরিকা তথা পশ্চিমা দেশগুলোতে। লন্ডন, রোম, মাদ্রিদ, নিউইয়র্কের রাস্তায়-হাসপাতালে মানুষের হাহাকার, স্বাস্থ্যসেবা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন অসহায়, করুণ অবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনো দেখা যায়নি। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ সারিয়ে তোলার কোনো সফল চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো আবিস্কৃত না হওয়ায় শুরু থেকে এর সম্ভাব্য ভ্যাকসিনকেই করোনা অতিমারী থেকে বাঁচার একমাত্র বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ইতিপূর্বে গত শতকে যেসব বৈশ্বিক পেন্ডেমিক দেখা দিয়েছিল, সেসবের সফল টিকা পেতে দশক ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তবে করোনার প্রকোপ যেমন বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সামগ্রিক অগ্রগতির ভীতকে নাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি এর টিকা পেতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র এক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি সফল টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষে বাণিজ্যিক উৎপাদন ও প্রয়োগ শুরু হয়েছে। দেশে দেশে শতাধিক টিকার ট্রায়ালের মধ্যে ৫টি টিকা ইতিমধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিতরণ শুরু হয়েছে। এদের মধ্যে অক্সর্ফোড-এস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, বায়োএনটেক, চীনের সিনোভ্যাক, রাশিয়ার গ্যামালিয়ার টিকা এখন সারাবিশ্বে প্রয়োগ হচ্ছে। করোনাভাইরাসের মত প্রাণঘাতী মহামারী বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বের প্রায় ৮শ’ কোটি মানুষের জন্য একই সাথে টিকার চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। টিকার সফল ট্রায়াল শুরু হওয়ার পর থেকে জাতিসংঘসহ বিশ্বসংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সব মানুষের টিকা পাওয়ার সম অধিকারের ন্যায্যতার কথা বলা হচ্ছিল। টিকা নিয়ে অস্বচ্ছতা ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা বন্ধের ব্যাপারেও বিশ্ব সংস্থাগুলোর তরফ থেকে বলা হয়েছিল। তবে করোনাভাইরাস মহামারী এক বছর পার হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, উৎপাদিত টিকার সিংহভাগ গুটিকতেক ধনী রাষ্ট্রের কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। অনেকগুলো দরিদ্র দেশ এখনো তাদের টিকা কার্যক্রম শুরুই করতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে তাদের চাহিদার চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যক টিকার মজুদ গড়ে তুলেছে। তারা এখন ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি ও রাজনৈতিক খয়রাতি কার্যক্রম শুরু করেছে।
করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে কমপক্ষে ৭০ ভাগ নাগরিককে টিকার আওতায় আনতে হবে বলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকে বলা হয়েছে। যে দেশ করোনা টিকায় পিছিয়ে থাকবে সে দেশ অর্থনৈতিকভাবেও পিছিয়ে থাকবে। করোনাভাইরাসের চলমান বাস্তবতায় দেশে দেশে ধনী আরো ধনী, গরীব আরো গরীব হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। কোটি কোটি মানুষ যখন কর্মহীন হয়ে পড়েছে, শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের আয় রোজগার কমে গেছে, সেখানে গত অর্থবছরে দেশে দেশে কিছু কর্পোরেট কোম্পানী দ্বিগুণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। যেসব দরিদ্র দেশ এখনো করোনা ভ্যাকসিনেশন শুরু করতে পারেনি এবং যারা নাগরিকদের অর্ধেকের বেশি মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে ইতিমধ্যেই সক্ষম হয়েছে, এই দুই পক্ষের মধ্যে যারা পিছিয়ে থাকবে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় তারা নিশ্চিতভাবেই পিছিয়ে থাকবে।
ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের জন্য একটি সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে। একদিকে ভারত ও পশ্চিমা দুনিয়া অন্যদিকে চীন-রাশিয়াসহ দুই পক্ষের প্রভাব বলয়ে বাংলাদেশের চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান থাকায় এর সুফল এ দেশের জনগণ পাওয়ার কথা। করোনা ভ্যাকসিনে বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রথম ধাপেই চীনের সিনোভ্যাকের টিকার সুযোগ গ্রহণের প্রস্তাব পেয়েছিল বাংলাদেশ। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভারতের ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসির ফাঁদে পা দিয়ে প্রথমবারের সে সুযোগ হাতছাড়া করেছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকার জন্য চুক্তি করে তিন কোটি ডোজ টিকার সমুদয় অর্থ আগাম পরিশোধ করেও চরমভাবে প্রতারিত হয়েছে বাংলাদেশ। টাকা গ্রহণ করার পরের দিনই ভারত নিজেদের চাহিদা মিটানোর আগে বাংলাদেশে টিকা রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যেকোনো ভাইরাসঘটিত রোগের টিকাদান কর্মসূচি একটি চলমান প্রক্রিয়া। শতকোটি মানুষের দেশ চীন, রাশিয়া, আমেরিকা বা বৃটেন যদি নিজদেশের চাহিদা পুরণের আগে টিকা রফতানির উপর একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করত তাহলে বিশে সার্বজনীন টিকাদান কর্মসূচি শুরু করতে আরো কয়েক বছর সময় লেগে যেতো।বিশ্বসংস্থাগুলো তরফ থেকে কোভিড-১৯ টিকার উপর কোনো বিশেষ দেশ বা কোম্পানীর একচ্ছত্র মালিকানার গ্রহণযোগ্যতা স্বীকার করা হয়নি। করোনা টিকা নিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা বন্ধের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হলেও ফাইজারের মত ওষুধ কোম্পানী টিকা বিক্রি করে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি মুনাফা করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। কোভিড-১৯ ভাইরাস ভ্যাকসিনের আন্তর্জাতিক বরাদ্দ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ কয়েক কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পাচ্ছে। চলতি বছরের মাঝামাঝি থেকে কোভ্যাক্স ডোজ সরবরাহ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বছরের প্রথম মাস থেকেই সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা কিনে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন শুরু করেছিল বাংলাদেশ। বিশ্বের শতাধিক দরিদ্র দেশ যখন অর্থাভাবে করোনা ভ্যাকসিনেশন শুরু করতেই পারছিল না তখন প্রথম দফায় করোনা ভ্যাকসিনের জাতীয় কার্যক্রম শুরুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার ধাপে অবস্থান করেছিল। সে অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে একটি অনিশ্চিত গন্তব্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঘটনাবলী পুনরুল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করিনা। বৈদেশিক মুদ্রায় শত শত কোটি টাকা নগদ বা আগাম অর্থ পরিশোধ করেও ভারতীয় চানক্যবাদী রাজনীতির কাছে চরমভাবে প্রতারিত হয়ে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। ভারত যেখানে রাশিয়াসহ ভ্যাকসিনের অন্য উৎসগুলো থেকে ভ্যাকসিন প্রাপ্তির জন্য লাইন দিয়েছে সেখানে বাংলাদেশ শুধুমাত্র ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে গাঁটছড়া বেধে ধরা খেয়েছে।
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা, ভঙ্গুরতা ও অব্যবস্থাপনা চরমভাবে ধরা পড়েছে। তবে বাংলাদেশের গবেষক, উদ্যোক্তা ও ওষুধ কোম্পানীগুলো করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বিভিন্ন ফ্রন্টে অপ্রত্যাশিত গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার স্বাক্ষর রেখেছেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বমানের পিপিই, মাস্ক, সেনিটাইজার উৎপাদন, করোনা চিকিৎসার জন্য ট্রাডিশনাল মেডিসিন হাইড্রোক্সিক্লোরকুইন, রেমডিসেভিরসহ বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদনের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষকদের করোনা র‌্যাপিড টেস্ট কিট উৎপাদনের ঘোষণা করোনার বৈশ্বিক যুদ্ধে বাংলাদেশকে উচ্চ মর্যাদার আসন নিশ্চিত করেছিল। যদিও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি অস্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে গণস্বাস্থ্যে টেস্ট কিটের অনুমোদন খোড়া অজুহাত ও সিদ্ধান্তহীনতায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি অনালোচিত রয়ে গেছে, তা হচ্ছে , বাংলাদেশে করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার এক মাসের মধ্যেই দেশীয় গবেষণা সংস্থা গেøাব বায়োটেক কোম্পানী নিজস্ব করোনা ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করে এবং অল্পদিনের মধ্যেই প্রাথমিক সাফল্যের ঘোষণা দিয়ে একটি সফল ভ্যাকসিনের জন্য স্বল্প সময়ে চুড়ান্ত সাফল্যের আশাবাদ প্রকাশ করে। গেøাব বায়েটেকের সেই ঘোষণায় পুরো জাতি গর্বিত ও আশান্বিত হলেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের নিরবতা ও অগ্রাহ্য করার প্রবণতা ছিল চোখে পড়ার মত। তারা বন্ধু রাষ্ট্রের প্রভাব এবং পলিটিক্যাল ডিপ্লোম্যাসির বাইরে যেন কিছুই ভাবতে পারছিল না। সেখানে হোঁচট খেয়ে চীন-রাশিয়ার ফর্মুলায় বাংলাদেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের চুক্তি করা হঔের গেøাব বায়োটেকের ‘বঙ্গভ্যাক্স’ নিয়ে কোনো আগ্রহ উৎসাহ কখনো দেখা তাদের মধ্যে মধ্যে দেখা যায়নি। তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের তালিকায় গেøাব বায়োটেক্রে ‘বঙ্গভ্যাক্স’ অনেক আগেই নিবন্ধিত হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রচলিত ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আবিস্কৃত এম আরএনএ সিঙ্গেল ডোজ ভ্যাকসিনটি এখন এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট আশাবাদ সঞ্চার করছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ‘ভ্যাক্সিন’-এ প্রকাশিত নিবন্ধে বঙ্গভ্যাক্স সম্পর্কে বেশ সাফল্য হিসেবে স্বীকৃত হয়। তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় নিবন্ধিত হওয়ার পরও সেই গণস্বাস্থ্যের র‌্যাপিড কিটের অনুমোদনের মত বঙ্গভ্যাক্সের দ্বিতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল(বিএমআরসি)র টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণের অভিযোগ উঠেছে। এসব দেখে শুনে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, দেশের স্বাস্থ্য বিভাগে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতায় কারা বসে আছে? এরা কি আসলে কি চায়? করোনাকালের নানা ঘটনাবলী, দুর্নীতি. ব্যর্থতা, অস্বচ্ছতা ও দেশকে পিছিয়ে দেয়ার বাস্তবতায় এদেরকে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো পক্ষের এজেন্ট বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এখনো ভ্যাক্সিনই হচ্ছে একমাত্র উপায়। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দেয়ার আগ পর্যন্ত অর্থনৈতিক কার্যক্রমে পূর্বের গতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। গত ১৫ মাস ধরে দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কোটি কোটি শিশু-কিশোর তরুনের শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চরম অনিশ্চয়তা ভর করেছে। দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার কথা বলে দেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি চালু রাখা হলেও দেশের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কোনো উপায়ে কোটি কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনার পক্ষে তথাকথিত আমলা-মন্ত্রীদের যেন তেমন ভ্রæক্ষেপ নেই। হাজার হাজার শ্রমিক নিয়ে চাুল রাখা রফতানিমুখী গার্মেন্ট কারখানা চালু রাখায় কোথাও করোনা মহামারীর বিস্তার ঘটেছে এমন কোনো নজির এখনো পাওয়া যায়নি। একইভাবে অনেক কওমি মাদরাসাও চালু রয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ নানা ধরণের আসক্তি, স্বাস্থ্য ও মনস্তাত্তি¡ক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের নামে অতিমাত্রায় মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও গেজেটে ডুবে থাকায় তাদের মধ্যে ভিডিও গেম ও মোবাইল আসক্তির কুপ্রভাব লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। ভিডিও গেম, টিকটকসহ নৈতিকতা ও আমাদের সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী বিভিন্ন অ্যাপের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে কিশোরদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। এই করোনালকডাউনেও কিশোর গ্যাং কালচার বিস্তার লাভ করছে। লাখ লাখ শিশু কিশোরের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়া এবং সামাজিক-মনস্তাত্তি¡ক বিভ্রাটের যে ক্ষতি তা করোনার আর্থিক ক্ষতির চেয়েও অনেক বেশি। করোনাকালের বাস্তবতায় দেশের স্বাস্থ্য খাত এবং শিক্ষাব্যবস্থার নীতি নির্ধারকদের অপরিনামদর্শীতা, বালখিল্যতা এবং আত্মঘাতী প্রবণতা জনসম্মুখে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। নামি দামি বলে কথিত এক শ্রেণীর বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিক-পরিচালকরা নামকাওয়াস্তে অনলাইন ক্লাস চালিয়ে পুরো টিউশন ফি আদায়ে চাপ সৃষ্টি করছে। অথচ করোনায় অর্ধেকের বেশি অভিভাবক তাদের আয়-রোজগারের পথ হারিয়েছে অথবা আয় অর্ধেক কমে গেছে। করোনাকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রণোদনা ও উদ্ধার তহবিল ঘোষণা করা হলেও ননএমপিও বেসরকারি শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অক্ষুন্ন রাখতে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই!
করোনাভাইরাস অতিমারী শুরু হওয়ার আগে ২০১৮ সালে জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্যা প্যাসিফিক(এসকাপ)’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়া হয় বাংলাদেশে। স্বাস্থ্যখাতে গত অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ ছিল জিডিপির একভাগেরও কম। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হলেও দেশে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়িত অর্থের ৬৪ ভাগ সাধারণ মানুষকে নিজ পকেট থেকে বহন করতে হয়। স্বাস্থ্যখাতে ব্যক্তিগত খরচের এ হিসেবে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। সরকারি হাসপাতালে কোটি কোটি টাকার ওষুধ, যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, চুরি, অপচয় ও অব্যবহৃত রেখে সাধারণ মানুষকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে টাকা খরচ করতে বাধ্য করা হয়। সরকারি হাসপাতালের এক শ্রেণীর ডাক্তার ও কর্মচারী বেসরকারি হাসপাতালের এজেন্ট ও দালালের ভূমিকা নিয়ে কমিশন ভাগাভাগিতে লিপ্ত থাকার অভিযোগও নতুন নয়। স্বাস্থ্য খাতে হাসপাতাল পরিচালনা ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ের পুকুর চুরির মত দুর্নীতির তথ্যগুলো প্রায়শ টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিনত হতে দেখা গেলেও এসব চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির সাথে জড়িত কারোই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। কোনো মন্ত্রী বা সচিবকেও কখনোন দায় বহন করতে হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে সরকারি হাসপাতালে ১০-১৫ হাজার টাকার পর্দা ৩৬ লাখ টাকা ক্রয়ের তথ্য স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির ‘টেক্সটবুক এক্সাম্পল’-এ পরিনত হয়েছে। এমন আরো অনেক উদাহরণ ইতিমধ্যে গণমাধ্যমের রিপোর্টে উঠে এসেছে। এ সপ্তাহে ঢাকার নিউরো হাসপাতালের কেনাকাটায় সাম্প্রতিক দুর্নীতির যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাতে সহজে বোঝা যাচ্ছে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দাকন্ডের মত অস্বাভাবিক-অভাবনীয় দুর্নীতি-লুটপাটের ঘটনা স্বাস্থ্য খাতে অব্যাহত রয়েছে। নিউরোসায়েন্সের কেনাকাটায় দেখা যায়, বাংলাদেশের বাজারে ২৫০ টাকা মূল্যের বিশেষ সুঁই কেনা হচ্ছে ২৫ হাজার টাকায়, ৪০০ টাকার টিস্যু ফরসেপ ২০ হাজার টাকায়, ৪০০ টাকা দামের বাঁকানো কাঁচি কেনা হচ্ছে সাড়ে ১০ হাজার টাকায়, বেশিরভাগ পণ্য ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি দামে কেনা হচ্ছে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কেনা কোটি কোটি টাকা যন্ত্রপাতি অযতœ-অবহেলায় ফেলে রাখা হচ্ছে এবং অল্পদিনের মধ্যেই সে সব যন্ত্র বিকল ঘোষণা করে সাধারণ মানুষকে বেসরকারি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে যেতে বাধ্য করার নজির সর্বত্র দেখা যাচ্ছে।
দেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য ভারতে যাচ্ছে। এখাতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। অথচ দেশে বিশ্বমানের ডাক্তার ও হাসপাতাল রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি দুর্নীতি, অপচয় ও লুটপাট বন্ধ করা গেলে দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ভোগান্তিসহ সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হতো না। সরকার কোটি কোটি টাকা দিয়ে সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি কিনে দিচ্ছে, সে সব যন্ত্রপাতি বিকল রেখে দরিদ্র মানুষকে সহায়সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ মেটাতে বাধ্য করার চিত্র আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ও নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে দু:খজনক ব্যত্যয়। বর্তমান অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন বরাদ্দের বিশাল অংশ ব্যয় করতে পারেনি। অথচ এ সময়ে করোনাকালীন বাস্তবতায় হাসপাতালে শত শত শয্যা বৃদ্ধি, আইসিইউ ইউনিট সম্প্রসারণের মত প্রস্তাবনাগুলো পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা হয়েছে। মনে হচ্ছে, দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত রাখতে কোনো একটি বিশেষ শ্রেণীর এজেন্ট স্বাস্থ্য বিভাগে সক্রিয় রয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তারা দেশে উৎপাদিত বিশ্বমানের র‌্যাপিড করোনা টেস্ট কিট ব্যবহারের অনুমোদন দেয়ার চেয়ে বিদেশি কোম্পানীর কিট কিনে গোপণ কমিশন বাণিজ্যের ভাগিদার হতে চেয়েছে বা হচ্ছে, তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে করোনা ভ্যাকসিন সংগ্রহের বদলে ভারতের সাথে চুক্তিতে বেশি আগ্রহী। তারা দেশীয় কোম্পানী গেøাব বায়োটেকের সিঙ্গেল ডোজ করোনা ভ্যাক্সিন উন্নয়ণের তথ্যে বিব্রত ও নাখোশ। অন্যদিকে করোনার বিধিনিষেধের মধ্যে দেশের সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম, গার্মেন্ট কারখানাসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রিতভাবে চালু রাখা হলেও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর বন্ধ রেখে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চায়। যে ভাবে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরী, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহণ চালু রাখা হয়েছে সে ভাবে বিশেষ ব্যবস্থা ও সতর্কতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু রাখার কথা কেন যেন সংশ্লিষ্টদের মাথায় ঢোকে না!
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Dadhack ২ জুন, ২০২১, ৬:১১ পিএম says : 0
আল্লাহর আইন দিয়ে দেশ চালালে অনেক ধরনের সমস্যার সমাধান হয়ে যায়... ইসলাম হচ্ছে সমস্যার আগেই সমাধান দিয়ে দেয়....
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন