শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জাতিজাগরণে নজরুল

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০২১, ১২:০৩ এএম

ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন অবসানের পর ইংরেজ কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই উপনিবেশিক নব্য শাসকদের একটা নীতি হয়ে দাঁড়ায় প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারী, আয়মাদারী, সংস্কৃতি প্রভৃতি সকল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হতে বেছে বেছে মুসলমানদের উৎখাত করে সেসব ক্ষেত্রে ইংরেজ-অনুগত হিন্দুদের বসানো। পলাশী বিপর্যয়ের কয়েক বছরের মধ্যে পূর্বতন ভূমিনীতি বদলিয়ে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামের নতুন ভূমিনীতির মাধ্যমে ইংরেজরা নব্য জমিদার গোষ্ঠী গড়ে তোলে, যার সিংহভাগই ছিল হিন্দু। মুসলমানরাও কিছুতেই বিদেশিদের শাসন মেনে নিতে পারছিল না। পলাশীতে স্বাধীনতা হারানোর পর একশত বছর ধরে মুসলমানরা স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যায়।

এসব সংগ্রামের মধ্যে ছিল মীর কাসিমের লড়াই, মজনু শাহের নেতৃত্বাধীন ফকীর বিদ্রোহ, হাজী শরীয়তুল্লাহ-দুদু মিয়ার ফারায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার লড়াই, মহিশুরের হায়দার আলী, টিপু সুলতানের সংগ্রাম, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর নেতৃত্বাধীন জেহাদ আন্দোলন, রংপুরের নূরুল দীন, ত্রিপুরার শমসের গাজী, স›দ্বীপের আবু তোরাব, নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরের নওয়াব আলী প্রমুখ কৃষকনেতার নেতৃত্বাধীন কৃষক অভ্যুত্থান এবং সর্বশেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ।

কিন্তু এসব সংগ্রাম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের নেতাদের অসহযোগিতার কারণে। সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ায় হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। নানা গদ্য ও পদ্য রচনার মধ্য দিয়ে তারা ইংরেজদের প্রতি তাদের আনুগত্য নিবেদন করেন। বঙ্কিমচন্দ্র, ‘সংবাদ-ভাস্কর’ এ লিখলেন: পাঠকসকল জয় জয় বলিয়া নৃত্য কর। হিন্দু প্রজাগণ দেবালয়ে সকলের পূজা দেও, আমাদের রাজ্যেস্বর শত্রুজয়ী হইলেন।’
কবি ঈশ্বর চন্দ্র লিখলেন :
‘চিরকাল হয় যেন বৃটিশের জয়
বৃটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয়।
এমন সুখের রাজ্য আর নাহি হয়।
শাস্ত্রমতে এই রাজ্য রামরাজ্য কয় ’

কাজী নজরুল ইসলামের পূর্ব পুরুষেরা মুসলিম শাসনামলে বিচারবিভাগের উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন। নব্য শাসকদের অনুসৃত নীতির কারণে তাদের উপর বিশেষভাবে নির্যাতনের স্টিম রোলার নেমে আসে। ফলে তারা দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হন। এভাবেই তারা সর্বশেষ বাসস্থান পাটনা থেকে পালিয়ে এসে বর্ধমানের প্রত্যন্ত অঞ্চল চুরুলিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এখানেই নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খৃস্টাব্দে (বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ্য) জন্ম গ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই নজরুলকে চরম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হয়। জীবিকার জন্য রুটির দোকানে চাকরি করা, লেটোর দলে গান গাওয়া, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমের চাকরি করা- হেন কাজ নেই, যা তাকে করতে হয়নি, এক পর্যায়ে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে হাবিলদার পদে উন্নীত হন।

এতসব প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও নজরুল ইসলাম পরাধীন জাতিকে জাগিয়ে তুলতে এতটুকু ত্রুটি করেননি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের দুই প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম উভয়ই জন্মগ্রহণ করেন বৃটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতবর্ষে যথাক্রমে ১৮৬১ ও ১৮৯৯ সালে। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ১৯৪২ সালে। নজরুল ইসলাম দৈহিকভাবে ১৯৭৬ সালে মৃত্যু বরণ করলেও ১৯৪২ সালে এক দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার কারণে তাঁর কবি-জীবনের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে ঐ ১৯৪২ সালেই। সে নিরিখে তাঁর সৃষ্টিশীল কবি-জীবন সীমাবদ্ধ ছিল মাত্র আড়াই দশক কালের মধ্যে।

এই সীমাবদ্ধ জীবনকালে জাতিকে জাগিয়ে তুলতে তিনি যে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হন, তাতে তাঁর প্রতিভার বিশালতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। একারণে তাঁকে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসনামলে যেমন কারাদন্ড ভোগ করতে হয়, তেমনি তাঁর একাধিক গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়। কিন্তু এতসব করেও বৃটিশবিরোধী রচনা এ অন্যান্য কর্মকান্ড থেকে তাকে নিরস্ত করা সম্ভব হয়নি। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরাধীনতার অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে যে কোনো মূল্যে হিন্দু-মুসলমানদের মিলন ঘটতে হবে। ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ শীর্ষক কবিতা থেকে শুরু করে অসংখ্য রচনায় তাঁর এ প্রয়াস লক্ষ করা যায়। ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতায় তিনি বলেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’ নজরুলের এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে এ প্রশ্নে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতামত জানতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই ‘পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্ন সে হচ্ছে খৃস্টান আর মুসলমান ধর্ম। তারা নিজের ধর্ম পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে নাশ করতে উদ্যত। এই জন্য তাদের ধর্ম গ্রহণ ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোনো উপায় নেই। খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে একটি কথা এই যে, তারা আধুনিক যুগের বাহন। তাদের মন মধ্যযুগের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়।’

যিনি মুসলমানদের ধর্ম সম্বন্ধে এধরনের মত পোষন করেন, তাঁর পক্ষে হিন্দু-মুসলমান মিলনের কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। বরং আধুনিক যুগের বাহন খৃস্টান ধর্মাবলম্বী ইংরেজদের শাসন অধিক গ্রহণযোগ্য।
নজরুল শুধু পরাধীনতার শৃংখল ভাঙার লক্ষ্যে হিন্দু-মুসলমান মিলনের পক্ষপাতী ছিলেন না, নিজে গভীরভাবে ইসলামে বিশ্বাসী হয়েও প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীত রচনার মতো উদারতাও তিনি প্রদর্শন করেন। যেসব এলাকায় তাঁর জমিদারী ছিল, সেসব এলাকা মুসলিম অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ইসলামী ঐতিহ্যের কোন কবিতা রচনা সম্ভব হয়নি। একারণে বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক আবুল মনসুর আহমদ আক্ষেপ করে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের আকাশে কখনো ঈদের চাঁদ উঠতো না।
নজরুল শুধু প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ব্যবহার করে প্রচুর কবিতা ও গান রচনাই করেননি; বিভিন্ন বয়স ও পেশার লোকজনদের জাগিয়ে তুলতেও রচনা করছেন অসংখ্য কবিতা ও গান। সমাজের অর্ধেক মানুষই নারী। তাদের জাগিয়ে তুলতে তিনি ‘নারী’ শীর্ষক কবিতায় বলেছেন :

‘সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’
কুলি-মজুর শীর্ষক কবিতায় কবি ধনিক লোকদের সাবধান করে দিয়ে বলেছেন,
‘আসিতেছে শুভদিন
দিনে দিনে বহু বাড়িয়েছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!’
দেশের দীর্ঘ অবহেলিত কৃষানদের জাগিয়ে তুলতে নজরুল লিখেছেন:
‘ওঠরে, চাষী জন্মদ্বাসী ধর কাস্তে লাঙ্গল।
আমরা মরতে আছি- ভালো করেই মরব এবার চল
আজ জাগরে কৃষান, সব তো গেছে, কিশের বা আর ভয়
ক্ষুধার জোরেই করব এবার ক্ষুধার জগৎ জয়।’
[কৃষানের গান]
একইভাবে নজরুল শ্রমিকদের জাগিয়ে তুলতে লিখেছেন শ্রমিকের গান:
‘ওরে ধ্বংস-পথের যাত্রীদল।
ধর গাইতি তোল কাধে শাবল ’
একইভাবে তিনি দেশের ছাত্রসমাজকে জাগিয়ে
তুলতে লিখেছেন, ‘ছাত্রদলের গান’:
‘আমরা শক্তি, আমরা দল
আমরা ছাত্রদল।
মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান
ঊর্ধ্বে বিমান ঝড় বাদল।
আমরা ছাত্রদল ’
তরুণদের জাগিয়ে তুলতে নজরুল তাদের উদ্দেশ্যে লিখতে ভুলে যাননি ‘তরুণ্যের গান’। যেখানে রয়েছে:
‘যে দুর্দিনের নেমেছে বাদল তারই বজ্র শিরে ধরি।
ঝড়ের বন্ধু, আঁধার নিশিতে ভাসায়েছি মোরা ভাঙাতরী।’

নজরুলের সব জাতি-জাগানিয়া কবিতা ও গান যে লক্ষ্যবিহীন নয়, ইসলামের সাম্যভ্রাতৃত্বের মহান আদর্শের
ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠনই এর চূড়ান্ত লক্ষ্য তা প্রমাণে ১৯৩৭ সালে কলকাতার দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত ‘ঘোষণা’ শীর্ষক কবিতার কিছু অংশ উদ্ধৃত করে আজকের এ লেখার ইতি টানছি:
‘হাতে হাত দিয়ে আগে চল,
হাতে নাই থাক হাতিয়ার।
জমায়েত হও, আপনি আসিবে
শক্তি জুলফিকার

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন