গৌরব, সাফল্য, প্রত্যাশা ও অপূর্ণতায় ১৫ বছর পেরিয়ে ১৬ বছরে পা দিচ্ছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি)। ২০০৬ সালের ২৮ মে দেশের ২৬তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হয় কুবির। প্রতিষ্ঠার ষোলো বছরে এসেও নানা-সংকট অপূর্ণতার বেড়াজালে আটকে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। অপ্রতুল আবাসিক ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবার দূর্বলতা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, অপরিসর গ্রন্থাগার,পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবসহ নানা সংকটে আবদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
তবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি’র সভায় অনুমোদন পাওয়া ১৬৫৫ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প স্বপ্ন দেখাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের। এ প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন করে ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণসহ ক্যাম্পাসের সম্মুখে দৃষ্টিনন্দন ফটক নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পেই ১৫ বছরের সংকটের আক্ষেপ ঘুচবে বলে অভিমত বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের।
প্রতিষ্ঠার ইতিহাস: ৭ম-৮ম শতাব্দীর দিকে জ্ঞানচর্চার আঁতুড়ঘর ছিল ময়নামতি শালবন বিহার। প্রাচীন বাংলার ‘সমতট’ রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল ‘লালমাই-ময়নামতি’। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী থেকে (কারও কারও মতে সপ্তম শতাব্দী) দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ওই রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ৫০০ মাইল। সপ্তম শতাব্দীতে চন্দ্রবংশীয় রাজা ভবদেব এখানে আনন্দ বিহার বা শালবন বিহার প্রতিষ্ঠা করেন।
৬০ এর দশক থেকে কুমিল্লাবাসীর দাবি ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার। সে প্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালে কুমিল্লায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা থাকলেও সেটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ পায়। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে কুমিল্লায় একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু পরে ২০০৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কুমিল্লায় এক জনসভায় কুমিল্লাবিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেন। এরপর ২০০৬ সালের ২৮ মে ২৬তম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এর ঠিক এক বছর পরে ২০০৭ সালের ২৮ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়।
বাস্তবায়নের পথে ২০০ একর মেগা অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প: বিশ্ববিদ্যালয় অধিকতর উন্নয়নপ্রকল্পের আওতায় নতুন করে ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ পর্যায়ে। এ প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন বিগ্রেডের সাথে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
ভূমি অধিগ্রহণসহ এ প্রকল্পের আওতায় চারটি একাডেমিক ভবন নির্মাণ,চারটি দশতলা আবাসিক হল, শিক্ষকদের একটি দশতলা আবাসিক ভবন, একটি দশতলা ডরমেটরি ভবন, ছয় তলা স্কুল বিল্ডিং, পাঁচ তলা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, তিন তলা মিলনায়তন, ইন্টারন্যাশনাল কমপ্লেক্স নির্মাণ,মেডিকেল ও ডে কেয়ার সেন্টার, স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড করা হবে।
আক্ষেপ ঘুচলো দৃষ্টি নন্দন ফটকের: প্রতিষ্ঠার পর হতেই বিশ্ববিদ্যালটির শিক্ষার্থীদের অন্যতম আক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসের সামনে নেই কোন সুদর্শন ফটক। এবার সে আক্ষেপ ঘুচলো শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দৃষ্টি নন্দন একটি মূল ফটকের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।
আবাসিক হলের সংকট: প্রতিষ্ঠার ১৬ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি বিভাগে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। কিন্তু তার বিপরীতে আবাসিক হল রয়েছে ছেলেদের জন্য তিনটি এবং মেয়েদের জন্য একটি। এ চার হলের স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতা আট থেকে নয়শত শিক্ষার্থীর। শিক্ষার্থীর সাথে পাল্লাদিয়ে আবাসিক হলের সংখ্যা না বাড়ায় বর্তমানে প্রায় ৮৫ ভাগ শিক্ষার্থীই আবাসিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মেয়েদের জন্য নতুন করে শেখ হাসিনা হল নির্মাণ এবং ছেলেদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সম্প্রসারণ কাজ চললেও তা চলছে ধীর গতিতে। এদিকে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য যে আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে তাও অপ্রতুল।
খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা, নেই আবাসিক ডাক্তার: প্রশাসনিক ভবনে অপরিসর একটি কক্ষে কোনরকমে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের কার্যক্রম। মেডিকেল সেন্টারটিতে জনবলের অভাব রয়েছে। আবাসিক চিকিৎসক না থাকায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কিংবা রাতে কোন শিক্ষার্থী অসুস্থ হলে পড়তে হয় বিপাকে। পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্ধের অভাবে মেডিকেল সেন্টারটি হতে যে ঔষধ সরবারহ করা হয় তা খুবই নগন্য।
অরক্ষিত ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা সংকট: বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ হতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল সংলগ্ন বিশাল অংশে নেই কোনো নিরাপত্তা প্রাচীর। আগে তারাকাটার বেড়া থাকলেও বর্তমানে সেখানে শুধু খুঁটি রয়েছে। এতে রাতের আঁধারে ক্যাম্পাসের পিছনের অংশে বহিরাগতসহ মাদকসেবীদের আনাগোনা বাড়ে।
এছাড়াও সংকট রয়েছে নিরাপত্তা কর্মীর। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নজরদারীর জন্য সিসি ক্যামেরার সংখ্যাও অপর্যাপ্ত, যেগুলো রয়েছে সেগুলোও ত্রুটিপূর্ণ। সম্প্রতি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দূর্বলতার সুযোগে ক্যাম্পাসের মূল ফটকের নির্মাণের জন্য আনা রড চুরির ঘটনা ঘটেছে।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী দৈনিক ইনকিলাব’কে বলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন একটি যুগে পদার্পণ করতে যাচ্ছে শীঘ্রই। প্রধান ফটকের মাধ্যমে তা দৃশ্যমান হচ্ছে। ৫০ একরের ক্যাম্পাস ২৫০ একর হচ্ছে। এই মেগা প্রকল্প যথাযথভাবে শেষ করতে পারলে আগামী ৫০ বছরও বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোন চাহিদা থাকবে না। নিঃসন্দেহে দেশের অন্যতম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে কুমিল্লাবিশ্ববিদ্যালয়।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন