শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

দুই সাহাবির অক্ষত লাশ ও নাম-পরিচিতি

প্রকাশের সময় : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কে. এস. সিদ্দিকী
১৩৫০/৫১ সালের ২০ জিলহজ, সোমবার দুপুরের (এপ্রিল, ১৯৩২ সাল) এক বিস্ময়কর ঘটনা। দুজন বিশিষ্ট সাহাবির মাজার (কবর) খোলা হয় এক স্বপ্নের ইশারায়। ২০ জিলহজ কবরদ্বয় খোলার পর দেখা যায়, দুই সাহাবির লাশ অক্ষত অবস্থায় বিদ্যমান। তাদের দেহ-কাফনে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, মনে হচ্ছিল যেন কিছুক্ষণ আগে তাদের দাফন করা হয়েছে। সাড়ে তেরোশ বছর পূর্বে যারা ইন্তেকাল করেন, দাফনের এত শতাব্দী পরও তাদের লাশ এভাবে অপরিবর্তনীয় থাকার এক বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে তখন ইহুদি-খৃস্টানদের বিপুলসংখ্যক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এ ঘটনাও কম অবাক করার মতো নয়। ৮৪ বছর পূর্বের এ বিস্ময়কর ঘটনা মানুষকে চিরকাল ইসলামের সত্যতা ও অনাবিল শান্তির পয়গাম দিতে থাকবে।
আলোড়ন সৃষ্টিকারী বহুল আলোচিত বিষয়টির ওপর আমাদের একটি বিস্তারিত লেখা ইনকিলাবের এই কলামে আড়াই-তিন বছর আগে ছাপা হয়। তাই এখানে তার পুনরাবৃত্তি না করে সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই।
ইরাকের বাদশাহ ফয়সাল স্বপ্নে এক বুজুর্গকে দেখতে পান। তিনি নিজেকে হোজায়ফাতুল ইয়ামান (রা.) বলে পরিচয় দেন এবং বলেন যে, তার মাজারে নদীর পানি এসে গেছে এবং হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)-এর মাজারেও আর্দ্রতা এসে গেছে। তাই তাদের দুজনকে সেখান থেকে সরানো হোক। বাদশাহ লাগাতার তিন রাত একই স্বপ্ন দেখেন। এতে তিনি দারুণ হতভম্ব হয়ে পড়েন। অপরদিকে মুফতিয়ে আজমও একাধারে তিন রাত একই দৃশ্য অবলোকন করেন। বাদশাহ সাহাবার আদেশ অনুযায়ী কেন কাজ করছেন না এরূপ অভিযোগ সৃষ্টি হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নূরী আস-সাঈদ। মুফতিয়ে আজম বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন এবং তার মাধ্যমে বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন। বিষয়টি নিয়ে উভয়ের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর প্রাথমিকভাবে মাজারদ্বয় সরানোর কিছু প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আদৌ কবরে পানি এসেছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় খননকার্য চালানো হয় এবং রিপোর্ট আসে নেতিবাচক। তখন বাদশাহ সাফ বলে দেন, কবর সরানোর কাজে হস্তক্ষেপ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, মুফতি আজম ফতোয়া দিলে তিনি তা শাহী ফরমান হিসেবে জারি করে দেবেন।
মুফতিয়ে আজম মাজারদ্বয় সরানোর পক্ষে ফতোয়া দান করেন, যা শাহী ফরমান হিসেবে প্রচার করে দেওয়া হয় এবং তাতে ঘোষণা দেয়া হয় যে, মাজার দুটি ঈদুল আজহা দিবসে সরানো হবে। এ ঘোষণার খবর বিদ্যুৎ গতিতে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। সময়টা ছিল হজের মৌসুম, মক্কায় তখন লাখ লাখ হাজির বিশাল সমাবেশ। সেখান থেকে এবং দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে বাদশাহ ফয়সালের নিকট টেলিফোন-টেলিগ্রাম ইত্যাদির মাধ্যমে হাজার হাজার অনুরোধ আসতে থাকে সাহাবিদ্বয়ের কবর সরানোর তারিখটি হজ আনুষ্ঠানিকতা ও দূর-দূরান্তের মানুষের সুবিধার জন্য কয়েক দিন পিছিয়ে দিলে তারা সবাই সাহাবিদ্বয়ের এ বিরল জানাজায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। বাদশাহ এসব অনুরোধের প্রতি সম্মানার্থে কবর খোলার তারিখ দশ দিন পিছিয়ে ২০ জিলহজ ধার্য করেন। বাগদাদ থেকে প্রায় পঞ্চাশ কি.মি. দূরে অবস্থিত সালমান পাক নামক ক্ষুদ্র পল্লীটি মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই জনসমুদ্রে পরিণত হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, পল্লীটি বিখ্যাত প্রবীণ সাহাবি (সর্বসম্মতভাবে ২৫০ বছর বয়স) হজরত সালমান ফার্সির (রা.) স্মরণে সালমান পাক নামকরণ করা হয়েছে। মাদায়েনের বিখ্যাত এ ঐতিহাসিক স্থানে মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যে মারাত্মক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিশিষ্ট সাহাবি সেনাপতি হজরত সাদ ইবনে আবি ওক্কাস (রা.) মাদায়েন জয় করেন এবং তার সঙ্গে ছিলেন প্রবীণতম সাহাবি হজরত সালমান ফার্সি (রা.)। সালমান পাক মাদায়েনেরই একটি ক্ষুদ্র পল্লী, এখানেই হজরত সালমানকে দাফন করা হয়। এখানে একটি কবরস্থান গড়ে ওঠে। এ কবরস্থান সংলগ্ন আধুনিক পদ্ধতিতে নির্মিত দুটি কক্ষের একটিতে হজরত হোজায়ফাতুল ইয়ামান (রা.) এবং অপরটিতে হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)-এর অক্ষত লাশ আগের কবর হতে তুলে এনে দাফন করা হয়। বর্তমান স্থান থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে দজলা নদীর তীরে কবর দুটি অবস্থিত ছিল। বর্ণিত আছে যে, পূর্ব তারিখ পিছিয়ে দেওয়া দশ দিনের মধ্যে মক্কা হতে আগত হাজী ও দুনিয়ার নানা দেশ ও স্থান থেকে আগত মুসলিম-অমুসলিমের সংখ্যা ছিল পাঁচ-ছয় লাখ। এ বিশাল জন¯্রােতের উপস্থিতিতে কবর দুটি খোলা হয়। দর্শক সমাবেশ বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে থাকেন লাশদ্বয়ের প্রতি। প্রকৃতই হোজায়ফাতুল ইয়ামান (রা.)-এর কবরে পানি ঢুকে পড়েছিল এবং তার সঙ্গী জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)-এর কবরে আর্দ্রতার চিহ্ন দেখা দিয়েছিল।
অতঃপর এক সৌভাগ্যবতী মহিলার চাক্ষুষ দেখা বর্ণনা শোনা যাক :
মহামান্য বাদশাহ ফয়সাল ইরাকের মুফতিয়ে আজম, তুরস্কের উজির মোখতার, মিসরের যুবরাজ ফারুক এবং ইরাকি পার্লামেন্টের সকল সদস্য হজরত হোজায়ফাতুল ইয়ামান (রা.)-এর লাশ মোবারক কাঁধে নেন এবং অত্যন্ত সম্মানের সাথে লাশ শিশার একটি তাঁবুতে রাখেন। এরপর অনুরূপভাবে হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা)-এর লাশ মোবারক মাজারের বাইরে আনা হয়। দুই মহান সাহাবির কাফন এমন কি দাড়ি পর্যন্ত সম্পূর্ণ সঠিকভাবে ছিল। লাশ দুটো দেখে কিছুতেই আন্দাজ করা যায় না যে, এগুলো তেরোশ বছর আগের লাশ বরং ধারণা হয় যে, তারা ইন্তেকাল করেছেন মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। সর্বাধিক আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে, উভয়ের নয়নগুলো খোলা ছিল এবং সেগুলোতে এমন রহস্যময় ঔজ্জ্বল্যের চমক ছিল যে, অনেকে চেয়েছিলেন যে, তাদের চোখের সাথে তারা চৌখ স্থির করে মিলিয়ে রাখবেন। কিন্তু তাদের দৃষ্টি সেই চমকের কাছে ম্লান হয়ে যায়। ম্লান হবে না-ইবা কেন?
এটি ছিল এক বিস্ময়কর দৃশ্য। প্রখ্যাত বহু ডক্টর ইউরোপের প-িত বর্গ যারা এ অনুষ্ঠানে বিশেষভাবে অংশগ্রহণের জন্য এসেছিলেন এ দৃশ্য দেখে তারা খুবই অভিভূত হন। অতঃপর সাহাবিদ্বয়ের অক্ষত লাশ গ্রহণকারীর যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার এবং ভক্তিসহকারে হজরত সালমান ফার্সির (রা.) কবরস্থানে তা পুনঃ দাফন করেন।
ইতিহাসের এটি এমন একটি বিস্ময়কর চাঞ্চল্যকর ঘটনা, যা প্রত্যক্ষ করে বড় বড় মনীষী-প-িতগণও হতভম্ব হয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলেই একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্মান চক্ষু বিশেষজ্ঞ ঘটনা সংক্রান্ত সকল কর্মকা- গভীর মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তিনি এ দৃশ্য দেখে এতই মুগ্ধ হয়ে পড়েন যে, পবিত্র লাশগুলো তাঁবুতে রাখা অবস্থাতেই সামনে অগ্রসর হয়ে মুফতিয়ে আজমের হাত ধরেই বলে ওঠেন ‘আপনাদের ইসলাম ধর্মের সত্যতা এবং সাহাবায়ে কেরামের বুজুর্গি মর্যাদার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে’? ‘আমি মুসলমান হতে চাই’ এ কথা বলেই উচ্চারণ করেন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।”
এ উপলক্ষে একটি জার্মান সিনেমা নির্মাণ কোম্পানি প্রত্যেক দেশ হতে আগত আগ্রহী দর্শকদের সুবিধার জন্য ব্যবস্থা করে যে, ইরাকি বাদশাহর অনুমোদনক্রমে নিজের খরচে মাজারগুলোর একেবারে সম্মুখ ভাগে ২০০ ফুট উঁচু চারটি ইস্পাতের স্তম্ভের ওপর তিরিশ ফুট দীর্ঘ এবং কুড়ি ফুট প্রশস্থ টেলিভিশন স্ক্রিন লাগিয়ে দেয়। এতে সুবিধা হয় এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তি স্বীয় স্থানে দাঁড়িয়েও পবিত্র মাজারগুলো খোলার সময় হতে শেষ পর্যন্ত সকল কার্যক্রম সুন্দরভাবে দেখতে থাকে। দ্বিতীয় দিবসে বাগদাদের সিনেমা হলসমূহে এ ঘটনার ছবি প্রদর্শন করা হয়। এ ঘটনার পরপরই বাগদাদে হৈচৈ পড়ে যায় এবং অসংখ্য ইহুদি ও খৃস্টান স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে দলে দলে মসজিদসমূহে প্রবেশ করে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষ দর্শীর বর্ণনা অনুযায়ী সাহাবিদ্বয়ের কফিনগুলো নতুন কবরস্থানে অর্থাৎ সালমান পাকে নিয়ে যাওয়ার সময় ইরাকের বিমানগুলো অবনত হয়ে তাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং আকাশ থেকে ফুলের বৃষ্টিবর্ষণ করে। পুরুষদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পালা শেষ করে নারীদেরকেও সুযোগ দেওয়া হয়। তারাও সশ্রদ্ধ ফুলের তোড়া বর্ষণ করেন। এভাবে পথে কয়েকবার কফিন দুটি নিয়ে থামতে হয়। পরম ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা পর যখন সালমান পাকে এসে পৌঁছায় তখন সর্বপ্রথম বাদশাহ ফয়সাল গার্ড অব অনার দেন। অতঃপর প্রতিনিধিবর্গ ফুলের স্তূপ প্রদান করেন। সর্বশেষে যে সৌভাগ্যবানেরা যারা ট্রেচার থেকে মোবারক লাশ দুটো কফিনে রেখেছিলেন তারা কফিন দুটি নবনির্মিত কবরস্থানে নামিয়ে রাখেন। আর এভাবেই কামানের গর্জন, সামরিক বিউগলের ধ্বনি এবং জনতার নারায়ে তকবীরের মধ্য দিয়ে ইসলামের এই জিন্দা শহীদদেরকে মাটির কোলে শুইয়ে রাখা হয়। পরের দিন বাগদাদের সব প্রেক্ষাগৃহে এ দৃশ্যের ছবি প্রদর্শিত হয়। (দাওয়াতুল হক)।
দুই সাহাবির লাশ সরানোর স্বপ্নের নির্দেশ ও সরানোর প্রস্তুতি এবং সর্বশেষ দাফনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপরে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এ সম্পর্কে একটি নতুন বিষয়ের অবতারণা করতে চাই একজন সাহাবির নাম প্রসঙ্গে। আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা দুজন সাহাবিরই পরিচয় সংক্ষেপে তুলে ধরছি। বিখ্যাত সাহাবি হজরত হোজায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিশ্বস্ত সার্বক্ষণিক সঙ্গী। বহু যুদ্ধে বিজেতা হিসেবে তিনি খ্যাত। তিনি খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর পক্ষ হতে মাদায়েনের গভর্নর ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ। তার পক্ষ থেকে হজরত আলী (রা.), হজরত উমর (রা.), হজরত আবু দারদা (রা.) প্রমুখ সাহাবা ও বহু তাবেঈন হাদিস বর্ণনা করেন। হজরত উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের চল্লিশ দিন পর হিজরি ৩৫/৩৬ সাল মোতাবেক ৬৫৬ খৃস্টাব্দে মাদায়েনে তিনি ইন্তেকাল করেন এবং সেখানে তার কবর ছিল, যা পরবর্তীকালে অক্ষত অবস্থায় স্থানান্তরের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনার জন্ম দেয় যে বিষয়টি নিয়ে আমাদের আলোচনা। তার অক্ষত লাশ সরানোর ব্যাপারে কোনো প্রকারের দ্বিমত দেখা দেয়নি যা হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা.)-এর ক্ষেত্রে ঘটেছে।
যে দুজন সাহাবির অক্ষত লাশ প্রায় চৌদ্দশ বছর পর কবর থেকে তুলে অন্যত্র দাফন করা হয় তারা হচ্ছেন হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা.) ও হজরত হোজায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা.)। এ ঘটনা সম্পর্কে এযাবতকাল বর্ণিত সকল তথ্য বিবরণীতে এ দুজন সাহাবির নামই উল্লিখিত হয়েছে, কোনো কোনো পর্যটক প্রথমোক্ত সাহাবির নাম আবদুল্লাহ ইবনে জাবের উল্লেখ করেছেন, যা সঠিক নয়। অনুরূপভাবে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা.)ও নিশ্চিতভাবে সঠিক নয় এ কথা আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি। বিষয়টি আমরা খোলাসা করে বলতে চাই।
যাচাই-বাছাই না করে কথা নকল করা হলে বিভ্রাট-বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে। দুজন সাহাবির অক্ষত লাশ সরানোর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিস্ময়কর ঘটনার মূল প্রতিপাদ্য দুজনের একজন হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা.)-এর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ঘটনাটির বয়স এখন ৮৪ বছর। প্রথম থেকেই নামটি ভুল হিসেবে নকল হয়ে আসছে, তখন থেকেই নামটি কেউ কখনো সংশোধনের কথা ভেবেছেন বলে মনে হয় না। কেননা সকল রিজালশাস্ত্র ও সিরাত গ্রন্থে বলা হয়েছে, হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা.) মদিনায় ইন্তেকাল করেন এবং সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। সুতরাং ইরাকের মাদায়েনে তার কবর থাকার কথা নয়, যেখান থেকে অক্ষত অবস্থায় তার লাশ সরিয়ে সালমান পাকে দাফন করা হয়েছে বলে সকল লেখকই উল্লেখ করেছেনÑ এটা কীভাবে সম্ভব?
বিগত নব্বইর দশকে তিনবার সালমান পাকে স্থানান্তরিত সাহাবিদ্বয়ের কবর জিয়ারতের সৌভাগ্য হয়েছিল, কিন্তু তখন নিরাপত্তার কারণে খুব কাছ থেকে মাজারদ্বয়ের সাইনবোর্ডে কি নাম লেখা আছে তা নোট করার সুযোগ হয়নি। জনশ্রুতি অনুযায়ী দুই নাম সকলেরই জানা হয়ে যায়। মনে পড়ে সে সময় একটি ইরাকি আরবি দৈনিকে বিভিন্ন পবিত্র স্থানের সচিত্র পরিচিতি প্রদান করতে গিয়ে সালমান পাকে অবস্থিত মাজার পরিচিতি ছিল এবং দুজন সাহাবি নামের ক্যাপশনে লেখা ছিল হজরত হোজায়ফার নামের সাথে জুবায়র (জিম বা ইয়া রা) জাবের নয়। তখন নামের তারতম্য যাচাই করার প্রয়োজন দেখা দেয়নি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন লেখায়ও জাবের নাম উল্লিখিত হতে থাকে। আমরাও সেই পদাংক অনুসরণ করে আমাদের লেখায়ও জাবের ইবনে আবদুল্লাহ উল্লেখ করেছি, ফলে নকল ভুলই হয়েছে।
এদেশের কোনো রচনায় আমরা জুবায়র নাম দেখিনি। সবাই লিখেছেন জাবের, যা সম্পূর্ণ ভুল কিন্তু যে জুবায়েরের কথা আমরা উল্লেখ করেছি, অক্ষত লাশ সংক্রান্ত ঘটনায় এ নামের কোনো সাহাবির সন্ধান পাওয়া যায়নি। জুবায়র নামটি জাবের হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। আর এ নামবিভ্রাট গোড়া হতেই চলে আসছে। প্রকৃত নাম যদি জুবায়র হয়ে থাকে তা গবেষণা করে বের করা দরকার।
শুরু থেকে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা.) নামটি বিনা তাহকীক অনুসন্ধানে প্রচারিত হয়ে যাওয়ার ফলে এ বিভ্রাট সৃষ্টি হয়েছে। অপর পক্ষে জাবের ও জুবায়রের মধ্যে বানানের দিক থেকে তেমন পার্থক্য না থাকায় জাবেরের ইন্তেকালের স্থানের বিষয়টি অনেকের মাথায় আসেনি এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। প্রসিদ্ধ সাহাবিদের মধ্যে তিনি ছিলেন এবং অধিক হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে তিনি গণ্য হতেন। বদর এবং ওহোদ যুদ্ধের পর সকল যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন এবং মোট ১৮টি যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। শেষ জীবনে তিনি দৃষ্টিশক্তি হাবিয়ে ফেলেন। তার কাছ থেকে এক বিরাট দল হাদিস বর্ণনা করেন। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের খেলাফত আমলে হিজরি ৭৪ সালে মতান্তরে ৭৮ সালে (৬৯৭ খৃ.) মদিনায় ইন্তেকাল করেন। মদিনায় ইন্তেকালকারী সর্বশেষ সাহাবিও তাকে বলা হয়। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ অনসারী (রা.)-এর সিরিয়া ও মিসরে গমনের কথা জানা যায় এবং জানা যায় তার ইন্তেকালের কথা কিন্তু তার ইরাকের মাদায়েনে গমনের কোনো তথ্য নেই, সেখানে তিনি ইন্তেকাল করেন এবং তথায় সমাহিত হন বলে প্রচার করা হয়।
বর্ণিত আছে যে, ইরাকের নানা স্থানে যেমন বাগদাদ, বসরা, কুফা, মাদায়েন, নজফ প্রভৃতি স্থানে প্রায় দেড় হাজার সাহাবা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তাদের পূর্ণ তালিকা দেখলে তাতে হয়তো সাহাবি হজরত জুবায়ের (রা.)-এর নামও পাওয়া যাবে যার অক্ষত লাশ সালমান পাকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে তার পরিচিতি সন্ধান করা সম্ভব হয়নি। আমরা আবারও বলতে চাই, হজরত জুবায়র (রা.)-এর অক্ষত লাশ সালমান পাকে সরানো হয়েছে। মদিনায় সমাহিত হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা.)-এর লাশ মোবারক নয়। আরো একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ইরাকে বাদশাহ সাহাবির স্বপ্নের নির্দেশ অনুযায়ী যখন কবর খোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেন তখন শাহী ফরমানও জারি করেন, যা প্রচারমাধ্যমগুলোতেও প্রচার হয়। সাহাবিদ্বয়ের নামও তাতে থাকার কথা। তখন জুবায়র নামটি জাবের হয়ে যাওয়া মোটেই বিচিত্র নয়। এরূপ নাম বিকৃত বা বদলে যাওয়ার অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাসে রয়েছে। তবে সত্য উদ্ঘাটিত হওয়ার পর সেটাই গ্রহণ করা উচিত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
শামসুল আলম ১২ মার্চ, ২০২১, ৮:৫৯ এএম says : 0
এই টা আল্লাহ তাআলার কুদরতের কারীশমা আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন আমীন
Total Reply(0)
Ismail ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ২:৫৭ পিএম says : 0
Khub sondor lekhecen zajakallahukhaer Thakik valo korecen Hawala soho bolle arovalo hoto.
Total Reply(0)
Mohshin Hossain ৩০ অক্টোবর, ২০২১, ৬:২৮ এএম says : 0
সুবাহানাল্লাহ আল্লাহ যেন আমাদের কে সর্ব্বোচ্চ ইমানদার হওয়ার তৌফিক দান করেন। আমিন।
Total Reply(0)
MD MAMUN MIA ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ২:০০ এএম says : 0
আল্লাহু আকবার আল্লাহ মহান
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন