আফতাব চৌধুরী
বাংলাদেশে নদীনালা, খালবিলের অভাব নেই। এসব স্থানে মৎস্য উৎপাদনের প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও নানা কারণে এখনও মৎস্য উৎপাদন সন্তোষজনক নয়। মৎস্য উৎপাদন কমে যাওয়ার নানা কারণ বর্তমান। যেসব চাষিরা বিলে মাছ চাষ করেন, তারা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না যে, কি পদ্ধতিতে চাষ করলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। বছরের পর বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে বিলে মাছ চাষ করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সুতরাং কিভাবে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
সাধারণত বিলের পাড়গুলো উঁচু থাকে না এবং এগুলো প্রধানত অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত। বিলে এত বেশি জলজ আগাছার জন্ম হয় যে, সেগুলোর মড়ক হলে তার পচনক্রিয়ার ফলে কাদার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ক্রমাগত কাদার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় বটে তবে সে কাদা তুলে এগুলোর সংস্কার করার পরিকল্পণা কদাচিৎ গ্রহণ করা হয়। সেই কাদা ক্রমাগত জমে এসব জলাশয়ে গ্যাসের সৃষ্টি হয়। ফলে মাছের বৃদ্ধি হয় না। প্রচুর কাদা থাকার ফলে পানির গভীরতা অনেক কমে যায় এবং বছরের পর বছর ক্রমাগত পানি হ্রাস পায়। শুধুমাত্র বর্ষার সময় পানির গভীরতা সামান্য বৃদ্ধি পায় তবে বছরের অন্য সময় গভীরতা এক রাখা সম্ভব নয়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কীটনাশক ওষুধ ধুয়ে বিলে এসে পড়ে। কখনো কখনো পার্শ্ববর্তী শহরাঞ্চল থেকে অথবা কোন কলকারখানা থেকে দূষিত পদার্থ বিলে এসে পড়ে। তার প্রতিক্রিয়া এ মাছগুলোর উপর পড়ে ফলে বিলের মাছের উৎপাদন কমে যায়। বর্ষার সময় পানি প্রবেশের বিভিন্ন পথ দিয়ে অসংখ্য মৎস্যভুক মাছ বিলে প্রবেশ করে। এগুলো পোনা মাছ ভক্ষণ করে দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এ জলাশয়গুলোর পোনা মাছের সংখ্যা ক্রমশ কমে যায়। অধিকাংশ বিলে মাছে পোনা মজুতের সংখ্যা ঠিক রাখা যায় না। প্রায় সর্বত্র অপেক্ষাকৃত ছোট মাপের পোনা মজুত করা হয়। এ জলাশয়গুলোতে অবস্থিত মৎস্যভুক মাছ থাকার ফলে সেই পোনা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, কাজেই মাছের উৎপাদন কমে যায়। মানে জলাশয়ে অবস্থিত মৎস্যভুক মাছ, সর্প ও বিভিন্ন প্রকারের পাখি ছোট আকারের মজুত করা মাছের পোনা খেয়ে ফেলে, ফলে মাছের উৎপাদন কমে যায়। সব বিলে পানির গভীরতা এক থাকে না। গভীরতা অনুসারে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মজুত করা হয় না। গভীরতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাছের পোনা মজুত হয় না। ফলে কোন প্রজাতিরই মাছের বাড় ভালো হয় না। মাছের উৎপাদন কমে যায়। প্রতিটি বিলে এক দফায় মাছের পোনা মজুত করা হয় না। যতদিন মাছের পোনা পাওয়া যায় দফায় দফায় বিভিন্ন প্রজাতির এবং বিভিন্ন মাপের পোনা বিলে মজুত করা হয়। এর ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট মাপের পোনার ক্ষতি হয়। কারণ ছোট মাপের পোনার সাথে বড় মাপের পোনার খাদ্য এবং বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। তাতে ছোট মাপের পোনার ক্ষতি হয়। সেগুলো খাদ্যাভাবে অপুষ্টিতে ভোগে এবং অবশেষে সেগুলোর মৃত্যু হয়। অধিকাংশ বিল এত বড় হয় এবং এমন স্থানে অবস্থিত হয় যেখানে এসব জলাশয় থেকে মাছ চুরি হয়।
প্রতিকার
(১) বিল থেকে কাদা তোলার খরচ বেশি হলেও পর্যায়ক্রমে বিলের এক একটি অংশের কাদা তুলে ফেলতে হবে। এর জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হবে কয়েক বছর মাছ চাষ করার ফলে সে অর্থ বেরিয়ে আসবে। (২) পাড়গুলো যেন যথেষ্ট মজবুত থাকে। না হলে চাষের উপযোগী পোনা মাছ বাইরে চলে আসবে এবং বাইরের মৎস্যভুক মাছ ও অন্যান্য প্রাণী বিলে ঢুকে পড়তে পারে। (৩) বিলের বিভিন্ন জায়গায় পানি প্রবেশ ও নিকাশের ব্যবস্থা থাকলে সেগুলোর মুখে জাল বসিয়ে দিতে হবে; এতে বিলের মাছ বেরিয়ে যেতে পারবে না, তেমনি মৎস্যভুক মাছও বিলে প্রবেশ করবে না। (৪) যে কেন রকম দূষণ বন্ধ করতে হবে। বিলে যদি পাট পচাতে হয় তবে এ জলাশয়গুলোর এক একটি অংশে পাট পচানোর কাজ করতে হবে। বিলের যে কোন জায়গায় পাট পচানো যাবে না। তাতে মাছের ক্ষতি হয়। কোন কলকারখানা অথবা পার্শ্ববর্তী শহরাঞ্চলের নালা-নর্দমার পানি যেন সরাসরি বিলে প্রবেশ না করে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ যে কোন প্রকার দূষণ মাছের বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকারক। (৫) কিভাবে বিলের পানির গভীরতা ঠিক রাখা যায় সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা আবশ্যক। কাদা তুলে দিলে স্বাভাবিক কারণে বিলের গভীরতা বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী কোন পানিধার থেকে বা পানির উৎস থেকে নিয়মিত পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করা আবশ্যক যাতে সারা বছরই বিলে পানির গভীরতা ঠিক রাখা যায়। (৬) যেহেতু যে কোন বিলে মৎস্যভুক মাছ একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়, সেজন্য মাছের ভালো উৎপাদনের জন্য অপেক্ষাকৃত বড় আকারের মাছের পোনা মজুত করতে হবে। (১০-১৫ সে.মি.) (৭) পানির গভীরতা অনুসারে পোনা মজুতের হার নির্ণয় করতে হবে। পানির গভীরতা কম থাকলে সবকটি প্রজাতির পোনা মাছ চাষ করা যাবে না। তাতে কোন পোনা মাছেরই ভাল ফলন পাওয়া যাবে না। (৮) বিলে সর্বদা এক দফায় মাছের চাষ করতে হবে। তাতে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
প্রকৃতিজাত মৎস্য কমে যাওয়ায় বিলে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত প্রজাতির মাছ স্টক করা প্রয়োজন। বর্তমান অবস্থায় মাছের বীজ স্টক করা সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায়। বেশিরভাগ বিলে দেখা গেছে যে মাছের পোনা মজুত করা হয় না। বিলের কোন সংস্কার করা হয় না। বিল সরকারিভাবে লিজ দেয়া হয়- সেগুলোতে প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদনের উপর পুরো নির্ভরশীল। লিজ বাবদ যে টাকা ধার্য করা হয় সেই টাকা মিলিয়ে যে লাভটুকু থাকল, তাতেই সবাই সন্তুষ্ট।
যতদিন পর্যন্ত না বিলের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে ততদিন মাছের অভাব থাকবেই। বিশ্বব্যাংকের সাহায্যে ০.০৩ হেক্টর থেকে ০.৪০ হেক্টর পর্যন্ত পুকুরে মাছ চাষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হলেও মাছের উৎপাদন তেমন আশানুরূপ বৃদ্ধি পাবে না।
প্রতিটি বিলের সমস্যা এক নয়। বিলের সমস্যা নির্ভর করে জলাশয়ের অবস্থান ও গুণাবলীর উপর। সুতরাং বিলের সমস্যাগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করে কিভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কিছু খরচ অবশ্যই করতে হয়। মাছ চাষ একটি ব্যবসাভিত্তিক উদ্যোগ। সুতরাং এসব খাতে অর্থ লগ্নী করলে বছরের শেষে মাছের উৎপাদন হয়ে সে লগ্নীকৃত টাকা হাতে ফিরে আসবে। বিলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য টাকা খরচ করলে ক্ষতি হবে না বরং মাছের উৎপাদন বাড়ছে, চাষীও লাভবান হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন