ফাহিম ফিরোজ
পদ্মার ভাঙন সেই সুদূর অতীত কাল থেকে চলে আসছে। এ যেন কোনোক্রমেই থামছে না। পদ্মার ভাঙনে ভারতের দেয়া ফারাক্কা বাঁধের একটা বৃহৎ ভূমিকা আছে এবং এটা এদেশের সব মানুষই কম-বেশি অবগত। কোনো পূর্ব ঘোষণা না দিয়েই ভারত এবার ফারাক্কার সব স্লুইস গেট খুলে দেয় বিহারকে বাঁচানোর স্বার্থে। এসব খবর গণমাধ্যমে ঢেউ তোলে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এদেশের মানুষের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ এবং হতাশা লক্ষ্য করা যায়।
পদ্মার ভাঙনে এবার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা একটি নতুন প্রশ্ন তুলেছে। আর তা হচ্ছে যেহেতু পদ্মায় মাওয়া পয়েন্টে সেতু নির্মিত হচ্ছে, এ জন্য তীর ঘেঁষে বাঁধও দেয়া হয়েছে। কিন্তু না, কোনো বাঁধেই পদ্মাতীরের ভাঙন রোধ করতে পারে না। পদ্মার দুই তীরের মানুষের একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এবার আর পদ্মার দুই তীর বিশেষ করে ব্রিজলগ্ন কয়েক মাইল আশপাশ আর জনবসতি ভাঙবে না । কিন্তু ভাঙল। প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক, তা হলে দুই তীরে কী বাঁধ দেওয়া হলো? ব্রিজলগ্ন কয়েক মাইল তীরবর্তী স্থানই তো পানিতে ডুবলো,ভাঙলো।
পদ্মা ভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি সবসময়ই ভয়ঙ্কর। মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সরকারি এবং ধর্মীয় স্থাপনা, বাজার এসবই ভাঙনের কবলে পড়ে গভীর পদ্মায় হারিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আর্তনাদ শোনা যায় দুই তীরের বাতাসে। উঁচু ঢেউয়ের গর্জন শুনে মনে হয় এগুলো যেন ভয়ঙ্কর সাপের ফুঁসফুঁসানি। কিন্তু জীবজন্তুর দুরবস্থার কথা কয়জনে ভাবে! মানুষ পদ্মার ভাঙনে পড়লে বা বেশি পানির হাত থেকে বাঁচার জন্য মালামাল নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারে, বিশেষ করে যাদের সামর্থ্য আছে। কিন্তু কুকুর, শেয়াল, সাপ, বাগডাশ এসব জীবজন্তুর আত্মরক্ষার তেমন পথ থাকে না। পদ্মার প্রবল পানিতে দুই তীরে বহু গ্রাম একেবারে তলিয়ে যায়, রাস্তা প্লাবিত হয়। এ সময় কুকুরগুলো স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে না। চারদিকে অথৈ পানি দেখে ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করতে থাকে। কখনো কখনো দুষ্টু প্রকৃতির কিছু মানুষ কুকুরের মাথায় বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। সাপ আশ্রয় নেয় গাছে অথবা উঁচু জায়গায়, পরিত্যক্ত কোনো ঘরে। শিয়াল বাঁচার জন্য আশ্রয় খোঁজে পরিত্যক্ত কোন ঘর বা উঁচু স্থানের কোনো ঝোপঝাড়ে যেখানে পানি পৌঁছাতে পারে না। বাগডাশগুলোর জীবন এসময় আক্ষরিক অর্থেই বিপন্ন হয়ে ওঠে। শুকনো রাস্তায় এ সময় চলাচল করতে গিয়ে টেঁটাধারী লোকদের হাতে অনেক সময় প্রাণ হারায়। পদ্মার জলোচ্ছ্বাসে মুন্সীগঞ্জ জেলা এবং পদ্মার দক্ষিণ তীরস্থ শরীয়তপুর জেলার রাস্তাঘাট প্রতিবছরই কম বেশি মানুষজন ও যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। রাস্তা পেরিয়ে নি¤œাঞ্চলের গ্রামগুলো বর্ষায় কচুরিপানা ও জলজলতা পাতায় ছেয়ে যায়। এ সময় অনেক কষ্টে কচুরি ভেদ করে নৌকা চলাচল করতে হয়। মাথার ওপর আবার ঝুলে থাকে বৈদ্যুতিক তার নামে ভয়ঙ্কর মৃত্যুদূত। খুবই সতর্ক অবস্থায় এ সময় মানুষকে নৌকায় চলাচল করতে হয়।
পদ্মার জলোচ্ছ্বাসের সময় কখনো কখনো কিছু মানুষকে একশ্রেণীর দুষ্ট লোক বেশ বিড়ম্বনায়ও ফেলে। পদ্মা পাড়ের সন্তান হিসেবে এক্ষেত্রে লেখকের অভিজ্ঞতাও কম নয়। মনে পড়ে ক’বছর আগে আনুমানিক রাত ১০টার দিকে এক ব্যক্তি খুব জোরে গলা ফাটিয়ে আরেক গ্রামের একজনের নাম ধরে ডাকে। ওরে লুৎফর, নৌকা দিয়ে নিয়ে যা’। অন্য একজন ডাক শুনে মশকারা করে বলে আইতাছি। অপেক্ষমাণ ব্যক্তি ভাবে সত্যি তারে নৌকায় করে নিতে আসছে। এভাবে তার অপেক্ষায় রাতটাই পার হয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ তাকে নিতে আসে না। আসবে কী করে? এক কিলোমিটার দূর থেকে বড় কচুরি ভেদ করে নৌকা চালানো যে কি কষ্টকর একমাত্র ভুক্তভোগীই তা জানে। পরের দিন চা দোকানে এ নিয়ে কেউ কেউ আবার হাসাহাসি করে মজা পায়।
পদ্মার পানি বৃদ্ধিতে মানুষের রোগবালাইও কম হয় না। জলজলতা ও বুুনো ফুলের পচা দুর্গন্ধ, মরা পাতা-কচুরির পচা বিট বর্ষার পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে ফেলে। পানির রং এ সময় খয়েরি ও কালো বর্ণ ধারণ করে। এ দূষিত পানি পান করলে যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। অতীতে এসব পানি মানুষ বাধ্য হয়ে পান করলেও বর্তমানে টিউবওয়েল ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় মানুষের দূষিত পানি ব্যবহারের পরিমাণও অনেকখানি কমে এসেছে। ঐতিহাসিক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিক্রমপুরের ইতিহাস গ্রন্থ পাঠ করলেই বোঝা যায়, বর্ষায় বিক্রমপুর এলাকা অর্থাৎ মুন্সীগঞ্জ এবং শরীয়তপুর এলাকার পানি কীরকমভাবে অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে।
পদ্মার ভয়াবহ পানি বৃদ্ধিতে চাষের মাছের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে থাকে। যেসব দীঘি পুকুরে মাছ চাষ করা হয় পদ্মার পানি সেসব দীঘি পুকুরে ঢুকে মাছ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মাছ চাষিদের কপালে তখন দুঃস্বপ্নের ভাঁজ পড়ে। ‘নদীর এপার ভাঙে ওপাড় গড়ে এই তো নদীর খেলা’Ñ এটা একটা বিখ্যাত গানের কলি। নদীর ভাঙন নিয়ে লেখা গানের প্রতিটি ছত্রই সত্য। পনের শতকে বিক্রমপুরের বিখ্যাত রাজা কেদার রায়ের [মৃত্যু : ১৬০৪] প্রাসাদ বাড়ি পদ্মা যখন কুক্ষিগত করে অপর পাড় তখন বিপদাপন্ন মানুষের আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং জনবসতিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেদার রায়ের প্রাসাদ বাড়ি পদ্মায় বিলীন হলে তখন তার আর এক নাম হয় কীর্তিনাশা। রাজা রাজবল্লভের বর্তমান শরীয়তপুরস্থ রাজনগরের রাজপ্রাসাদ যখন পদ্মায় বিলীন হয়ে যায় তখন আবার পদ্মা কীর্তিনাশা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এটা ঘটে ১৮৬৯ সালে। পদ্মার ছোবল যে কি ভয়ঙ্কর তা একটি প্রাচীন ম্যাপে আছে।
উত্তর দিক থেকে চিকন একটি নদী থেকে একটি তীরের মতো সুতীক্ষè মাথা চলে গেছে রাজনগরের দিকে। ম্যাপটি দেখে মনে হয় রাজপ্রাসাদটিকে শুধু ধ্বংস করার জন্যই যেন পদ্মা তার দিকে এই জলীয় তীরটি নিক্ষেপ করেছে। পদ্মার ভাঙনের কি বিচিত্র খেলা। পদ্মা কিনা পারে! পদ্মা কিনা গিলে খায় ! জাহাজ, লঞ্চ, মানুষ, বসতভিটা সবই তার উদরে যায়। সে কাউকেই কখনো কিছু ফিরিয়ে দেয় না। পূর্ব পুরুষদের মুখে অন্তত শুনিনি পদ্মায় হারিয়ে যাওয়া কোনো কিছু তারা ফিরে পেয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরা পদ্মার এই দুর্দমনীয় আচরণকে কাল নাগিনীর ছোবলও বলে থাকে।
পদ্মা হচ্ছে তীব্র ¯্রােতবাহী নদী। কোনো কিছু পদ্মায় তলিয়ে গেলে মুহূর্তেই বাহমান তীব্র ¯্রােত তাকে একস্থান থেকে অন্য স্থানে ঠেলে দেয়। এ জন্যই পদ্মায় কোনো কিছু খোয়া গেলে উদ্ধার সম্ভব হয় না। পদ্মার ওপর এখন নির্মিত হচ্ছে দেশের বৃহত্তম আলোচিত পদ্মা সেতু। এই সেতু এবং সেতুর পার্শ্ববর্তী নিমাঞ্চলকে বাঁচানোর জন্য নদীর পাড়ের বাঁধ আরও দীর্ঘ ও সুদৃঢ় করা ছাড়া বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন