বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

বর্ষার রোগ প্রতিরোধ করি

| প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০২১, ১২:০৬ এএম

ঋতু বদলের পালায় এখন বর্ষা মৌসুম। এসময়ে হঠাৎ গরম, আবার হঠাৎ বৃষ্টি। আশেপাশের পরিবেশ বৃষ্টির পানিতে ভেজা থাকে এবং স্যাতস্যাতে অবস্থা বিরাজ করে। এখন করোনার অতিমারি চললেও ভুলে গেলে চলবেনা এসময় অন্যান্য রোগ জীবাণু ছড়ানোর দাপটও চলছে সমান তালে। তাই বর্ষা মৌসুমে একটু বেশী সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। বর্ষার প্রকৃতির বায়ুমন্ডলে জলীয় বাষ্প বেশী থাকে। ঠান্ডা গরম মিশ্রিত আবহাওয়া শরীরের জন্য তেমন আরামদায়ক নয়। এসময় পানিবাহিত রোগ জীবাণু ছড়ায় বেশী। নিম্নে বর্ষার কয়েকটি রোগ নিয়ে আলোচনা করা হলো।

জ্বর ঃ জ্বর, সর্দি, কাশি বর্ষার প্রধান রোগ। বর্ষা মৌসুমে খুবই সাবধানে চলাফেরা করতে হয়, অন্যথায় নানা রোগের আক্রমণে জটিলতা সৃষ্টি করে। যাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা এসব রোগে আক্রান্ত হয় বেশী। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা ভাইরাস সংক্রমণ জনিত রোগে আক্রান্ত হয় এবং পরিবারের একজন থেকে অন্যজনে তা ছড়িয়ে পরে। তাই এ সময়ে ঘরে ঘরে জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তবে মনে রাখবেন জ্বর কোন রোগ নয়, অন্য কোন রোগের লক্ষণ মাত্র। ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হলে হাচি, কাশি, চোখ লাল হওয়া শরীরে ব্যথা হতে পারে। এ অবস্থা ২/৩ দিন থাকতে পারে। তবে জ্বর যদি ৪/৫ দিন স্থায়ী হলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ মতে ঔষুধ খেতে হবে। এ অবস্থায় তরল খাবার ও ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খাওয়া ভালো। বিশেষ করে লেবুর শরবত আম, জাম, আনারস, কাঠাল নিয়মিত খাবেন।

ডায়রিয়াঃ পানিবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম একটি রোগ হলো ডায়রিয়া। দূষিত পানি পান বা ব্যবহার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, অপুষ্টি ও কৃমির আক্রমণে ডায়রিয়া হতে পারে। এতে ঘন ঘন পাতলা পায়খানা, পেট ব্যথা জ্বর থাকতে পারে। এ অবস্থায় প্রচুর পানি ও খনিজ লবণ বের হয়ে যায়। তাই রোগীর শুকিয়ে যায় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থা দেখা দিলে খাবার স্যালাইন কিছুক্ষণ পর পর খেতে হবে। শিশু হলে অবশ্যই তার মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এ রোগ থেকে বাচতে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। রান্না ঘর, থালা বাসন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কোন অবস্থাতে পচা, বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। কোন খাবার গ্রহণের আগে হাত ভালো করে সাবান দিয়ে পরিস্কার করে নিতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করতে হবে। পায়খানা থেকে ফিরে এসে অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। ডায়রিয়া রোগী বমি, মলমূত্র পুকুরের পানিতে ফেলা যাবে না।

আমাশয় ঃ বর্ষা মৌসুমে ব্যাটেরিয়ার আক্রমণে আমাশয় রোগ সৃষ্টি হয়। এতে দিনে ৮/১০ বারের বেশি পায়খানা হয়। কিছুক্ষণ পর পর অল্প পরিমাণে পায়খানা হয়। অথবা শুধু সাদা মিউকাস ফেনাযুক্ত পায়খানা হয়। আবার কোন কোন সময়ে রক্ত মিশ্রিত পায়খানা হয়। এ সময় পেটে ব্যথা দেখা দিতে পারে। যেহেতু দূষিত পানিতে থেকে বা ময়লা যুক্ত খাবার থেকে আমাশয় রোগ দেখা দেয়। সুতরাং বিশুদ্ধ পানি অবশ্যই পান করতে হবে। হাত সাবান দিয়ে খাবার গ্রহণ করতে হবে। পায়খানা থেকে ফিরে এসে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। রোগীকে ডাবের পানি ও খাবার স্যালাইন বার বার খেতে দিতে হবে। নরম ভাতা, মাছ খেতে দিতে হবে। কিন্তু দুগ্ধ জাতীয় খাবার দেয়া যাবে না। পচা বাসী খাবার গ্রহণ করা যাবে না। বাজারে বা রাস্তার পাশে খোলা কোন খাবার গ্রহণ করবেন না। কাঁচা ফলমূল ভালো করে ধুয়ে খাবেন। পুকুর বা নদীর পানি ফুটিয়ে পান করুন। ডাক্তারের পরামর্শ মতে ঔষধ খাবেন।

ডেঙ্গুজ্বর ঃ বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি হয়। এডিস মশাই এ রোগের বাহক। এই মশায় কামড়ালে ডেঙ্গু রোগ দেখা দেয়। এ রোগে জ্বর হয়, শরীরে গীরায় গীরায় ব্যথা হয়। চামড়ায় র‌্যাশ বা লাল লাল দাগ দেখা দেয়। এসব লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এ থেকে বাঁচতে বাড়ি ঘরের আশপাশের ঝোপঝাড় পরিস্কার রাখুন। কোথাও যেন বৃষ্টির পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন। এডিস মশা জমে থাকা বৃষ্টির পরিস্কার পানিতে ডিম পাড়ে। তাই বাড়ি ঘরের আশ পাশের টব, টিনের কৌঠা, বালতি, নারকেলে ছোলায় জমে থাকা পানি ফেলে দিয়ে পরিস্কার রাখুন। দিনে-রাতে ঘুমাবার আগে মশারি ব্যবহার করুন।

টায়ফয়েড ঃ টাইফয়েড পানি বাহিত সংক্রামক রোগ। সালমোনেলা টাইফি নামক এক ধরণের জীবানুর সংক্রমণে এ রোগ হয়। মানুষই টাইফয়েড রোগের জীবাণুর বাহক। সংক্রমিত ব্যক্তির মলমূত্র যেখানে সেখানে ফেলে রাখলে তা পানির সাথে মিশে গিয়ে, আবার আক্রান্ত রোগীর কাপড় চোপড় পুকুরে বা জলাশয়ে ধুলে তা পানির সাথে মিশে গিয়ে, সে পানি ব্যবহার করলে টাইফয়েড জীবাণু ছড়ায়। তাছাড়া মাছি, পিপিলিকা, আরশোলা প্রভূতি কীটপতঙ্গ টাইফয়েড রোগীর মলমূত্র হতে রোগের জীবানু বহন করে এনে খাদ্য এবং পানিতে মিশিয়ে দিলে তা সুস্থ মানুষ খেলে এ রোগে আক্রান্ত হয়। দেহে রোগ জীবাণু প্রবেশের পর ১০/১৪ দিন সময় লাগে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে। জ্বরই এ রোগের প্রধান লক্ষণ। জ্বর দিন দিন বাড়তে থাকে শরীর মেঝ মেঝ করে। প্রচন্ড মাথা ব্যথা হয়। জীহবার মধ্যবর্তী সাদা অংশ শ্লেষ্মায় ঢাকা থাকে এবং পেটে পিটে গোলাপী বর্ণের দানা দেখা দিতে পারে। রোগ লক্ষণ দেখা মাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রতিরোধ ঃ বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করতে হবে। তাজা টাটকা ঘরের তৈরি খাবার খেতে হবে। খোলা বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। বাড়ি ঘর তেলাপোকা, আরশোলা, মাছিমুক্ত রাখতে হবে। খাবার সবসময় ঢেকে রাখবেন।

ম্যালেরিয়া ঃ স্ত্রী এনোফিলিস মশার কামড়ে এ রোগ হয়। শরীর কেপে কেপে নির্দিষ্ট সময় পর পর জ্বর আসে। মাংস পেশীতে ব্যথা ও শরীর দুর্বল হয় এবং খাবার অরুচি দেখা দেয়। জ্বর ৪/৫ দিনের বেশি স্থায়ী হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এসব মশা বদ্ধ জলাশয়ে, বাড়ির আশে পাশে ঝোপঝাড়ে, ঘরের পাশে ফেলা দেয়া টব, বালতি, হাড়ি, পাতিল, বাসন ইত্যাদিতে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে বসবাস করে এবং বংশ বিস্তার করে। তাই এসব অবশ্যই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ঘুমানোর আগে সর্বদাই মশারি ব্যবহার করবেন।

কৃমি সংক্রমন ঃ বর্ষাকালেই কৃমির আক্রমণ বেশী হয়। এসময় পারপাশে পানি আর স্যাতেস্যাতে পরিবেশের মাটিতে মিশে থাকে কৃমির পরজীবী জীবাণু। কৃমির সংক্রমণ হয় মল থেকে মুখে। একজনের মল থেকে খাবার পানির মাধ্যমে অন্যজন সংক্রমিত হয়। সুস্বাস্থ্যের বড় শত্রু কৃমি। কৃমির জীবাণু মাটিতে পানিতে মিশে থাকে। তাই খালি পায়ে হাটলে পায়ের সংস্পর্শে চামড়া ভেদ করে শরীরে প্রবশে করে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কৃমিতে রূপ নেয়। শরীরের রক্ত চুষে খেয়ে বড় হয়। ফলে শরীরে রক্ত শূন্যতা, ক্ষুধা মান্দা, বদ হজম, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া সৃষ্টি করে। এছাড়া চামড়ায় চুলকানি, এপেনডিসাইটিস, জন্ডিস, হাপানি, পেপটিক আলসার ও মহিলাদের সাদা ¯্রাব বের হওয়ার মত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিরোধ: মল ত্যাগের পর, খাবার পরিবেশনের আগে অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। যেকোন ফলমূল খাওয়ার আগে ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। নিয়মিত হাতের নখ কেটে ছোট রাখতে হবে। যেখানে সেখানে পায়খানা করা যাবে না। নির্দিষ্ট জায়গায় গর্ত করে কিংবা স্যানেটারী ল্যাট্রিন ব্যবহার করতে হবে। নিয়মিত গোসল, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন জামা কাপড় ব্যবহার করতে হবে। খালি পায়ে হাটাহাটি না করে জুতা পরে হাটতে হবে। শিশুদের ধুলা বালিতে খেলতে না দেওয়াই ভালো। আধা সিদ্ধ মাছ, মাংস খাওয়া যাবে না। প্রতি ৩ মাস পর পর কৃমি নাশক ঔষদ পরিবারের সবাই একসাথে খেতে হবে। তবে ১ বছরের কম বয়সের শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের কৃমির ঔষধ খাওনো যাবে না। নিজে সচেতন হোন আশে পাশের লোকজনকে সচেতন করুন।

মোঃ জহিরুল আলম শাহীন
শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লেখক
ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
গোলাপগঞ্জ, সিলেট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন