বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইউরোপের পথে ভয়ানক মৃত্যুফাঁদ

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০২১, ১২:০১ এএম

গত ২৪ জুন ভূমধ্যসাগরে ভাসমান অবস্থায় ২৬৪ জন বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে তিউনিশিয়ান কোস্ট গার্ড। তারা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি যাচ্ছিলেন। সাগর পাড়ি দেয়ার সময় নৌযান ভেঙে যাওয়ায় তারা পানিতে ভাসছিলেন। তিউনিসিয়া থেকে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির কর্মকর্তা মঙ্গি স্লিম গণমাধ্যমকে বলেন, উদ্ধারের পর তাদের তিউনিশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ জেরবারের একটি হোটেলে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশি ও মিসরীয়রা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালির পথে রওনা হয়েছিলেন। ভূমধ্যসাগরে তাদের ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। এর আগে গত ১০ জুন ১৬৪ জন বাংলাদেশিকে তিউনিশিয়ান উপকূল থেকে উদ্ধার করে দেশটির কোস্ট গার্ড। তারাও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ ছাড়া ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় গত ১৮ মে ৩৬ জন, ২৭ ও ২৮ মে ২৪৩ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে তিউনিশিয়ান কোস্ট গার্ড। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে তিউনিশিয়ায় কমপক্ষে ৭০৭ জন বাংলাদেশি রয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ।

স্বপ্নের ইউরোপ যাওয়ার পথে পথে রয়েছে ভয়ংকর মৃত্যুফাদ! আললো-বাতাসহীন কন্টেইনার, গহীন অরণ্য, গভীর সমুদ্র, তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ভয়ানক স্বপ্নযাত্রায় পা রাখছে অনেক বেকার যুবক। ভয়াবহ এই স্বপ্নযাত্রায় সর্বস্ব বিক্রি করে দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছেন শেষ সম্বল। কেউ কেউ অবৈধ পথে স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছাতে পারলেও অধিকাংশই হন ভাগ্যাহত। কারো কারো সলিল সমাধি হয়। কেউ প্রাণ হারায় অনাহারে-অর্ধাহারে, নানা রোগ-শোকে। এতে বিপর্যস্ত হওয়াসহ পথে বসছে বহু পরিবার, হচ্ছে দেশের দুর্নাম, সরকারের দুর্নাম।

কয়েক বছর আগে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর সময় কয়েক শ’ বাংলাদেশির সলিল সমাধি ঘটলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। একই রকম চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় থাইল্যান্ডের জঙ্গলে শত শত বাংলাদেশির গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার ঘটনায়। অনেক সময় এই রুটে পাচারের শিকার মানুষকে থাইল্যান্ডে আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। সাগরের মাঝপথে বা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে তাদের জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে। অর্ধাহারে-অনাহারে, কখনো গাছের পাতা খেয়েও অনেকে দিন অতিবাহিত করেন। ভাগ্য খারাপ হলে এক গ্লাস পানিও জোটে না। পথে বিভিন্ন কারণে অনেক প্রাণ ঝরে যায়। পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রিয় মানুষটির লাশও পৌঁছায় না অনেক সময়। পাওনা টাকা পরিশোধ করতে না পারলে অনেক সময় দালালদের হাতে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা রোধে আমাদের প্রশাসনিক অগ্রগতি কতটুকু?

করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির কারণে চারদিকে বাড়ছে অভাব আর হতাশা। গত বছরের মার্চে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণার পর কর্মসংস্থান হারিয়ে হাজার হাজার মানুষ নাম লিখিয়েছিলেন বেকারের খাতায়। করোনাকালে বিরাটসংখ্যক নিন্মধ্যবিত্ত তথা স্বল্প আয়ের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। এখন তারা নিঃস্ব, তারা নতুন গরিব। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সংখ্যা আড়াই কোটির মতো। আইএলওর গবেষণার তথ্য হলো, করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজš§। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছেন। গবেষণায় দেখা যায়, তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ। প্রাণঘাতী ঝুঁকি-বিপত্তির পরও অবৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ হচ্ছে না। কারণ হিসেবে সরকারের নীতি ও করণীয় সম্পর্কে স্বচ্ছতার অভাবকে দায়ী করেন পর্যবেক্ষকরা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, অনেক দেশেই বৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ার কারণে অনেকেই নানা অবৈধ উপায়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এতে তারা প্রতারণা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। বিদেশ গমনেচ্ছুদের দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। মৌখিক প্রচারণায় বলা হয় শিপে করে তারা ইউরোপের স্বপ্নের দেশ ইতালিতে পৌঁছবেন। বাস্তবতা হলো, শিপ নয় এ যেন মৃত্যুর এক ফাঁদের নাম প্লাস্টিকের বোর্ড। সব চেয়ে বড় কথা, তারা কোনভাবে ইউরোপে পৌঁছাতে পারলে প্রথম যে কাজটা করবে সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজ দেশের বিরুদ্ধে নানা রকম মিথ্যা, মনগড়া, খারাপ তথ্য দেয়া হয়। যার কারণে ইউরোপের দেশগুলো বৈধভাবেও বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহ দেখায় না। টুরিস্ট ও শিক্ষা ভিসা দিতেও চরম কড়াকড়ি আরোপ করে থাকে। এখনো লোকজনের ধারণা, যে কোনোভাবে ইউরোপে যেতে পারলেই বোধহয় ভালো থাকা যাবে। পরিস্থিতি যে এখন ভিন্ন, ইউরোপ যে এখন আর অবৈধভাবে আসা লোকজনকে আশ্রয় দিতে রাজি নয়, বরং কাগজপত্রহীন মানুষগুলোকে ধরে ধরে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে, এমন তথ্য জানা নেই বহুজনের। ইতিমধ্যে ইউরোপ বলেই বসেছে, অবৈধ লোকজনকে দ্রুত ফিরিয়ে আনা না হলে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা বন্ধ করে দেয়া হবে।

প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় ২২ লাখ ছেলেমেয়ে কর্মবাজারে আসে। তাদের অর্ধেকও নিজের জন্য একটি শোভন কাজ নিশ্চিত করতে পারে না। এই সমীকরণের একটি প্রতিষ্ঠিত সমাধান হলো কর্মপ্রত্যাশীদের একটি অংশকে উদ্যোক্তায় পরিণত করা। সে জন্য শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করা। তথ্যপ্রযুক্তির সুফল তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াসহ নানাবিধ উদ্যোগ আমাদের নিতে হবে। প্রতিবছর কী পরিমাণ গ্রাজুয়েট তৈরি হয়, সংশ্লিষ্ট মহলে জানেন। প্রতিবছর কী পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি হয় তাও জানেন। দেশে মোট বেকার সংখ্যা কত সেটাও সংশ্লিষ্টদের অজানা নয়। উন্নয়নের মহাসড়কে চলমান দেশে চরম বেকোরত্ব এবং সাধারণ চাকরির জন্যও বিশাল পরিমাণ ঘুষ দিতে হয় বলেই তরুণ যুবকেরা আজ দিশেহারা হয়ে দেশত্যাগে ব্যস্ত একথাও সংশ্লিষ্টরা জানেন নিশ্চয়ই। এর বাইরে আমরা একটা কথা বলে থাকি যে, মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে ১৫/২০ লাখ টাকা খরচ না করে দেশেই কোনো ব্যবসা বা উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব! সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও চাকরি না করে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু কিছু করার উদ্যোগ নেয়ার পরিবেশ দেশে কতটা আছে? ব্যবসায়িক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মানুষের প্রথম চিন্তা থাকে পুঁজি নিয়ে। কোন মতে পুঁজি সংগ্রহ করতে পারলেও, পরবর্তীতে ট্রেড লাইসেন্স, এলসিসহ সরকারি পর্যায়ে অনুমোদনের নানা পর্যায়ে হয়রানির কথা চিন্তা করে অনেকেই এক ধাপ এগিয়ে তিন ধাপ পিছিয়ে যান। আর করোনাকালে অর্থাভাবে ভুগছেন অনেকেই। এই সংকটকালে দেশের উদ্যোক্তাদের অগ্রযাত্রাকে গতিশীল করতে বিশেষভাবে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি প্রণোদনা ও সহজভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার সাথে ব্যবসায়ী বান্দব পরিবেশ তৈরি করা।

উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপ যেতে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় পাওয়া ট্রানজিট দেশ লিবিয়া। জীবনের সর্বস্ব বাজি রাখা বেকার তরুণরা উন্নত জীবনের জন্য মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে অবৈধ পথে পৌঁছাতে চায় স্বপ্নের দেশে। এ জন্য তাদের পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ কয়েক হাজার মাইল পথ। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১১ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী লিবিয়া হয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন। গত বছর থেকে এই সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রশাসনিক কিছু অসাধু লোকের অনৈতিকতার কারণে পাচার কমছেই না।

সাগরপথে মানবপাচারের ঘটনায় দেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। শ্রমবাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে বৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার পথ সহজ করতে হবে। সেইসঙ্গে দালালদের দৌরাত্ম্য রোধে প্রশাসনকে কঠোর ভ‚মিকা রাখতে হবে। কর্মসংস্থানের প্রলোভন দিয়ে প্রতিনিয়তই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবপাচার হচ্ছে। বেশিরভাগেরই কপালে জুটেছে নির্মম মৃত্যু। যেখানে যেখানে বাংলাদেশি তরুণরা আটকা পড়েছে, সেখান থেকে দ্রুত তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হোক। পাচারের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মানব পাচারকারীচক্রকে বাংলাদেশ থেকে সমূলে নির্মূল করা হোক। শুধু আইন নয়, আইনের কঠোর প্রয়োগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোর তৎপরতা এবং শক্তিশালী সীমান্ত ব্যবস্থাপনা থাকলেই মানবপাচার বন্ধ করা সম্ভব। অবৈধ পথে বিদেশ যাত্রা রোধ ও বিদেশে নিরাপদ কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার জন্য বৈধ পথে কম খরচে প্রবাসে কর্মসংস্থানের সরকারি উদ্যোগে গতি আনা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মী প্রেরণ নিশ্চিত করা জরুরি।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নব সংবাদ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Dadhack ৩ জুলাই, ২০২১, ১২:৩৮ পিএম says : 0
আজকে আমাদের দেশ যদি আল্লাহর নিয়মে চলতে তাহলে এইসব মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যেত না আজকে আমাদের দেশে কোটি কোটি লোক বেকার অথচ ইন্ডিয়া থেকে অন্য দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ লোক এসে আমাদের দেশে চাকরি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন