শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

অভিমত : ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ

প্রকাশের সময় : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রশ্মি সরকার : কর্মব্যস্ত, কোলাহলমুখর নগর জীবনে যানজট নিত্যদিনের সমস্যা। প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি পর্যন্ত যানজট বিস্তৃত। যানজটে নিশ্চল হয়ে বসে থাকা যানবাহনের সারির দিকে তাকালে গণপরিবহনের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাই বেশি দেখা যায়। তাছাড়া রাস্তার পাশে পার্ক করা গাড়ির কারণে রাস্তার পরিধি ছোট হয়ে যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় যানজট আরো তীব্র আকার ধারণ করে। সুতরাং একথা বলা ভুল হবে না যে, প্রাইভেট কার বা ব্যক্তিগত গাড়ি যানজটের একটি প্রধান কারণ। যানজটের কবলে পড়ে মানুষের কত না মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে! পানি, বিদ্যুৎ, বেকারত্ব, অপুষ্টিসহ অন্যান্য মারাত্মক সমস্যা ছাপিয়ে যানজট সমস্যা এখন প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। অথচ ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে যানজট নিয়ন্ত্রণে আনার কথা কেউ চিন্তা করতে পারেন না। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা সম্ভব, ব্যক্তিগত গাড়ির কারণে আমাদের নগর জীবন কত দিক থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
গাড়ি থাকলে তা রাখতে জায়গার দরকার হয়। শহরের এক টুকরো জায়গা অনেক মূল্যবান। সেখানে একটি প্রাইভেট কার পার্কিংয়ের জন্য প্রায় একশত ষাট বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন পড়ে। আর এই গাড়ি রাখার জন্য যথেষ্ট জায়গার বন্দোবস্তও করতে হয়। এখনকার প্রায় সব বাসা-বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টে নিচতলা সম্পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয় গাড়ি রাখার জন্য। যেখানে দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা যায় না সেখানে গাড়ি রাখার জন্য কী পরিমাণ ভূমি অপচয়! গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরে ব্যক্তিগত গাড়ির মাধ্যমে মাত্র ছয় শতাংশ ট্রিপ সংঘটিত হয়। তাহলে গাড়িকে এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে কেন? একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আমাদের জীবনযাত্রার মান অনেকাংশে আমাদের চারপাশের পরিবেশের উপর নির্ভর করে। নগর জীবন ইট-কাঠের খাঁচার মতো। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি দালান আর রাস্তায় যানবাহনের ভিড়। এখন শহরের প্রতিটি এলাকায় কী সে রকম কোন উন্মুক্ত স্থান দেখতে পাওয়া যায় যেখানে মানুষ পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ, মত বিনিময় করবে, সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করবে, শিশুরা মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা করবে? যদি উন্মুক্ত স্থান থেকেও থাকে সেখানেও দেখা যায় গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়েছে। ফলে অন্য কিছু করার সুযোগ নেই।
বিপণিবিতান, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আশপাশেও একই চিত্র। রাস্তার দু’পাশে লাইন ধরে গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। এর ফলে এখানে আগত মানুষেরাই যে কেবল সমস্যায় পড়েন তাই নয়, পথচলা সাধারণ মানুষেরাও ভোগান্তির শিকার হন। অনেক সময় দেখা যায় রাস্তা বাদ দিয়ে ফুটপাতের উপর মোটরসাইকেল চলছে। এ রকম যখন রাস্তার অবস্থা, তখন নিশ্চিন্তে হাঁটাহাঁটি করার, সাইকেল চালানোর সুযোগ কতটুকু? চলাচল এবং পার্কিংয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তার বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রাখে। রাস্তা জনগণের, এটা কারো ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জায়গা নয়। তাই রাস্তায় মানুষ হাঁটবে, সাইকেল চালাবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা সবাই জানি, শারীরিক সুস্থতার জন্য হাঁটাহাঁটি এবং বাইসাইকেল চালানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাঁটাহাঁটি ও সাইকেল চলাচলে খুব কম জায়গার দরকার হয়, খরচ লাগে না, জ্বালানির প্রয়োজন হয় না, পরিবেশের কোন ক্ষতি হয় না। তাছাড়া যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে হাঁটা, সাইকেল নিরাপদ। কেউ কি কখনো শুনেছেন যে সাইকেল বা রিকশার ধাক্কায় প্রাণহানি ঘটেছে? কিন্তু দ্রুতগামী গাড়ির ধাক্কায় প্রাণহানির ঘটনা অহরহ ঘটছে। অথচ শহরে বর্তমানে উন্নয়নের নামে যে ধরনের অবকাঠামো (ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) তৈরি হচ্ছে তাতে সাইকেল, রিকশা বা গণপরিবহন নয় ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলে সুবিধা বাড়ছে। সবকিছু দেখে মনে হয় গাড়ির জন্যই শহর নির্মিত হয়েছে, সাধারণ মানুষের এখানে কোন অধিকার নেই, তারা অতিথি মাত্র।
গাড়ি তৈরি থেকে গাড়ি চালনা, জ্বালানি সম্পৃক্তকরণ, ব্যবস্থাপনাসহ প্রতিটি পর্যায়ে বায়ু দূষিত হয়। গাড়ি থেকে নির্গত হয় কার্বনডাইঅক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনসহ বিভিন্ন গ্রিন হাউস গ্যাস যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। এই বায়ু দূষণকারী পদার্থসমূহ জন্মগত ত্রুটি, হৃদরোগ, ফুসফুসে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে। গাড়ির কালো ধোঁয়া এমন ধূ¤্রজাল সৃষ্টি করে যার ফলে শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালাপোড়াসহ নানা সমস্যা হয়। গাড়ির হর্ন শব্দ দূষণের জন্য দায়ী। ব্যক্তিগত গাড়ির কারণে রাস্তা এবং ফুটপাতে হাঁটা ও সাইকেল চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে গাড়ির ব্যবহার পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
একটি কথা না বললেই নয়, বৈষম্য শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সমাজ গঠনের পথে অন্তরায়। কেননা সমাজে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার জন্য বৈষম্য অনেকাংশে দায়ী। আর স্বাভাবিকভাবেই গাড়ির বিষয়টি এখানে চলে আসে। গাড়িতে চড়ার মতো আর্থিক সচ্ছলতা সকলের নেই। গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলো গরিব, সাধারণ মানুষের কাছে যেন অন্য জগতের বাসিন্দা। তখন অবচেতন মনে গাড়ি না থাকার জন্য অনেকেই হীনমন্যতায় ভোগেন। ফলে সামাজিক দূরত্ব বেড়ে যায়। যেখানে সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করা জরুরি হয়ে পড়েছে সেখানে গাড়ির ব্যবহার সমাজে বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সুস্পষ্টভাবেই বলা যায়, ব্যক্তিগত গাড়ির ধারণক্ষমতা কম, খরচ বেশি, জায়গা দখল করে বেশি; অপরদিকে গণপরিবহনের খরচ কম কিন্তু ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি, চলাচলে প্রয়োজন অনুযায়ী জায়গা দখল করে। ভেবে দেখুন তো, পঞ্চাশজন ভিন্ন ভিন্ন মানুষ যদি পঞ্চাশটি গাড়ি ব্যবহার না করে একটি গণপরিবহন ব্যবহার করেন তাহলে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অনেক কমে যায়। ফলে যানজট এবং পরিবেশ দূষণও অনেকাংশে হ্রাস পাবে। তাহলে আমরা কেন ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট হবো না?
একথা সত্যি যে সমস্যা যখন থাকে, তার সমাধানও থাকে, প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার। সিঙ্গাপুর, হংকং, পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন শহরে কনজেশন চার্জ, পার্কিং চার্জ, লাইসেন্স ফি, ইমপোর্ট ট্যাক্স প্রভৃতি বৃদ্ধি এবং ফুয়েল ট্যাক্স আরোপ ও বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত যানবাহনকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। গন্তব্যস্থলের দূরত্ব কমিয়ে আনার উপর গুরুত্ব প্রদান করে নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সময় এবং জায়গা কম লাগে এমন যাতায়াত মাধ্যম যেমন : হাঁটা, সাইকেল এবং গণপরিবহনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যানজট হ্রাস, দূষণ হ্রাস, যাতায়াত খরচ হ্রাস এবং গণপরিসর বৃদ্ধি পেয়ে শহরগুলো সকলের জন্য বাসযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে।
প্রাইভেট কারের ব্যবহার না কমালে গণপরিবহন ব্যবস্থার পাশাপাশি হাঁটা এবং সাইকেল চলাচলের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রায় অসম্ভব। যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করে এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ করে একটি মানসম্মত ও কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব। ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সকল মানুষ তো নিশ্চয়ই, গরিবেরা বিশেষভাবে উপকৃত হবে। হাঁটা ও সাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে গেলে এবং গণপরিবহনে সুব্যবস্থা নিশ্চিত হলে বিনা খরচে বা স্বল্প খরচে যাতায়াতের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি গরিবেরা যেহেতু পয়সা খরচ করে নামিদামি পার্ক কিংবা ক্লাবে বিনোদন উপভোগ করতে যেতে পারে না ফলে গাড়ি পার্কিং বন্ধ করে গণপরিসর বা উন্মুক্ত স্থান (কিংবা ছোট ছোট পার্ক) সৃষ্টি করলে সেখানে তারা অবসর সময় কাটাতে পারবে।
শহরের উৎপত্তি আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে আর গাড়ির প্রচলন শুরু হয় একশ বছর আগে। তাই শহরের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে গাড়ির প্রচলন সাম্প্রতিকই বলা চলে। এর আগে মানুষের চলাচলের প্রধান মাধ্যম ছিল হাঁটা। তার মানে শহরে গাড়ি অপরিহার্য নয় কারণ গাড়ি ছাড়াই মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে চলাফেরা করেছে। অথচ এখন আমরা গাড়ি ছাড়া চলতে পারছি না কেন? যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা আধুনিক হতে চাই কিন্তু আধুনিক হওয়া মানে কি গাড়ির মালিক হওয়া কিংবা ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য সাধারণ মানুষের অসুবিধার সৃষ্টি করা? এভাবে কোন দেশ কি উন্নত হতে পারে? নেদারল্যান্ড, জার্মানী, জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোতে গাড়ির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে এনে সাইক্লিং, হাঁটা এবং গণপরিবহন ব্যবহারে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এই দেশগুলো কি আধুনিক নয়? ওরা পারলে আমরাও নিশ্চয়ই পারবো। তাই ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আসুন সবাই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি।
লেখক : গবেষক, দি ইনস্টিটিউট অফ ওয়েলবিয়িং (ওডই)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন