আফতাব চৌধুরী
ভ্রমণও আমার একটা নেশা। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি দেশ বা বিদেশ যেখানেই হোক। তবে দীর্ঘ নয়, স্বল্প সময়ের ভ্রমণই আমার পছন্দনীয়। বিশ্বের অনেক দেশেই আমি গিয়েছি- একবার নয় বহুবার। আমি ১৯৮০ সালে মহামন্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে চীন ভ্রমণ করেছি। এছাড়াও যেসব দেশে ভ্রমণের সুযোগ আমার হয়েছে তার মধ্যে পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, গ্রেটবৃটেন, দুবাই, আবুধাবি, মালেয়েশিয়া, ওমান, বাহরাইন, লেবানন, সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য। দর্শনীয় স্থান বারে বারে দেখার ইচ্ছা হয় আমার। লন্ডনও আমি ক’বার গিয়েছি। শেষবার গিয়েছি ২০১৪ সালের জুন মাসের ১৩ তারিখ। এটাও ছিল আমার স্বল্প সময়ের ভ্রমণ। মাত্র ১২ দিন। নির্দিষ্ট দিনে ঢাকা থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে Boeing 777ER বিমানে চড়ে ঠিক সাড়ে ৯টায় আমার যাত্রা শুরু। বিমান আমেরিকার বোয়িং কোম্পানির তৈরি। অত্যাধুনিক।
ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে প্রথম দুবাই নামলাম ৪ ঘণ্টা পর। দুবাই থেকে লন্ডন হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য অত্যাধুনিক সুবৃহৎ বিমান A380 Airbus Company Emirates কে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী বিমান। বিমানটিতে তিনটি তলা রয়েছে। নিচের তলাতে শুধু মালপত্র বোঝাই করা হয়। একে Cargo Compartment বলা হয়। মাঝের তলাতে সামনের দিকে বড় বড় সুন্দর চেয়ার বসানো থাকে। সেটা হল Executive Class যাত্রীদের জন্য। এর উপরে দোতলাতে First Class & Executive Class-এর জন্য বড় বড় সুন্দর চেয়ার বসানো। সম্মুখ ভাগে পাইলট এবং কো-পাইলটের জায়গা। তাছাড়া সেখানে অসংখ্য যন্ত্রপাতি রয়েছে- যা নিরাপদে ওড়ার জন্য পাইলট ব্যবহার করে থাকেন। বিমানটির প্রতি ডানাতে দু’টি করে চারটি শক্তিশালী জেট ইঞ্জিন লাগানো থাকে। এর সাহায্যে বিমানটি ঘণ্টায় ৫শ’ থেকে ৬শ’ মাইল বেগে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার ফুট অর্থাৎ সাত থেকে সাড়ে সাত মাইল উপর দিয়ে উড়ে চলতে পারে। ক্রমাগত ১১ ঘণ্টা উড়তে পারে কোন বিমানবন্দরে অবতরণ না করেই।
দুবাই থেকে লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছতে ৮ ঘণ্টা লেগেছিল। স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টা। তখনও বিমানবন্দরের বাইরে সূর্যের আলো ঝলমল করছে। কারণ এ সময়ে রাত ১০টার সময় সূর্যাস্ত হয়। আধঘণ্টার মধ্যে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের কাজ শেষ করে বাইরে বেরিয়ে দেখি বন্ধু মোস্তফা ও তার ছেলে গাড়ি নিয়ে আমাকে রিসিভ করতে বাইরে অপেক্ষা করছেন। তারা থাকেন এগাম, হিথ্রো বিমানবন্দরের পাশেই একটি অভিজাত এলাকায়। এগামস্থ বাড়িতেই আমার ক’দিন থাকার কথা। মোস্তফা সাহেবের বাড়িতে থেকেই তার গাড়িতে করেই লন্ডনের বিভিন্ন জায়গা সফর করেছি। সংক্ষেপে হলেও এসব স্থানের কথা এখানে তুলে ধরছি। যুক্তরাজ্য বা ইউনাইটেড কিংডম বা ইউকে চারটি রাজ্য নিয়ে গঠিত। যেমন : ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, নর্দান আয়ারল্যান্ড এবং ওয়েলস। চার রাজ্যের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। ইংল্যান্ডের ভাষা ইংলিশ, স্কটল্যান্ডের ভাষা স্কটিশ, নর্দান আয়ারল্যান্ডের ভাষা আইরিশ এবং ওয়েলসের ভাষা ওয়েলস। আর প্রতিটি রাজ্যের রাজধানীও আলাদা। ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন, স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা, নর্দান আয়ারল্যান্ডের রাজধানী বেলফাস্ট এবং ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ।
যুক্তরাজ্যের মধ্যে প্রসিদ্ধ স্থানগুলো হল : লন্ডন, বার্মিংহাম, গ্লাসগো, এডিনবরা, লিভারপুল, বেলফাস্ট ও কার্ডিফ মহানগরী। এই সব ক’টি মহানগরী এবং তাদের উপকণ্ঠে অবস্থিত আধুনিক শহর ও গ্রামাঞ্চল আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আজকের এই নিবন্ধ শুধু লন্ডন এবং বার্মিংহাম মহানগরী এবং এর উপকণ্ঠে অবস্থিত গ্রামাঞ্চল ও শহর সম্বন্ধে লিখার ইচ্ছা। লন্ডনে অবস্থিত দেখার মতো প্রসিদ্ধ স্থানগুলো হলÑ ইংল্যান্ডের রানীর রাজপ্রসাদ ‘বাকিংহাম প্যালেস’, হাউসেস অব পার্লামেন্ট, লন্ডন টাওয়ার, লন্ডন টাওয়ার ব্রিজ, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি, মাদাম তুসো ওয়াক্স মিউজিয়াম, বিখ্যাত বিগবেন ঘড়ি এবং আরও অনেক অনেক প্রসিদ্ধ জায়গা যা পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। টাওয়ার্স অব লন্ডন বা লন্ডন টাওয়ার্সের অনেক অনেক প্রসিদ্ধ জায়গা আছে যা পর্যটকদের আকর্ষণের স্থান। টাওয়ার্স অব লন্ডন বা লন্ডন টাওয়ার্সের অনেক করুণ কাহিনী রয়েছে। এই সত্য কাহিনীগুলো অতীতের করাল গ্রাসে হারিয়ে গেছে বা হারিয়ে যেতে বসেছে। সেসব কাহিনী বিরহ-বেদনায় ভরা। অতি সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরছি দু’চারটি কাহিনীমাত্র।
টাওয়ার্স অব লন্ডন পাঁচটি একই নমুনায় গড়া টাওয়ার। একটা টাওয়ার অন্য টাওয়ারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। প্রত্যেকটি টাওয়ারের বিভিন্ন নাম আছে। যেমন- White Tower, St. Thomas Tower, বাকিগুলো সব আলাদা নামে পরিচিত। এই টাওয়ারগুলো লন্ডন টাওয়ার ব্রিচের পাশেই অবস্থিত। এই টাওয়ার্স অব লন্ডনের মধ্যস্থলে মুক্ত প্রাঙ্গণের একটি বিষাদগ্রস্ত করুণ কাহিনী এখানে তুলে ধরছি যা Tourist Guide-এর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম। তিনি এই জায়গাটি দেখিয়েছিলেন এবং বলে গেলেন যে king Henry তার চারজন প্রিয়তমা পতœীকে কোন কারণবশত এখানে হত্যা করেছিলেন। সেই স্থানটিতে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে- `king Henry executed his 04 wives in the middle of the compound surrounded by these towers এই বিখ্যাত টাওয়ার্স অব লন্ডনের অনতিদূরে অবস্থিত ‘জুয়েল হাউস’ এবং অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষিত রাখার জায়গা এটাকে আর্মি স্ট্রং রুম বলা হয়। সেখানকার পর্যটকদের স্থানীয় গাইডরা সঙ্গে নিয়ে সবকিছু দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দিয়ে থাকেন। তাছাড়া জুয়েল হাউসে একটি সুরক্ষিত জায়গায় একটি বিশাল গ্লাস কাস্কেটের ভিতর সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে প্রাচীন ও বর্তমান রাজা ও রানীদের সোনার তৈরি মুকুট মুক্তার হার এবং মুক্তা দিয়ে সাজানো প্রচুর ‘ডায়মন্ড-গহনাপত্র। সেই জুয়েল হাউসে সুরক্ষিতভাবে রাখা রয়েছে কোহিনূর ডায়মন্ড যা ভারত থেকে ব্রিটিশরা নিয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে। এই কোহিনূর ডায়মন্ড অতি চমৎকার। এটি দেখার জন্য শত শত পর্যটকের ভিড় প্রতিদিন লেগেই আছে। দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি।
এই টাওয়ার্স অব লন্ডনের পাশেই টেমস নদীর ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে লন্ডন টাওয়ার ব্রিজ। এটা টেমস নদীর দুই তীরকে যুক্ত করে দিয়েছে। এই সেতুটির একটি বিশেষত্ব হল যখন বড় বড় সমুদ্র্রগামী জাহাজ এই নদী দিয়ে যাতায়াত করে তখন ব্রিজের মধ্যস্থল খুলে গিয়ে উপরে উঠে যায়, এতে জাহাজের গতিপথে কোন প্রকার বাধার সৃষ্টি হয় না। সত্যিই দেখার মতো। টেমস নদীর ওপর এই ব্রিজ ছাড়া আরও অনেক ব্রিজ বা সেতু দুই তীরকে যুক্ত করে রেখেছে- যেমনঃ চেলসা ব্রিজ, ভ্যাকলস ব্রিজ, ল্যামবেথ ব্রিজ, ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ, ওয়াটার্লু ব্রিজ, সাউথ ওয়ার্ক ব্রিজ এবং লন্ডন ব্রিজ ইত্যাদি।
লন্ডনের মাদাম তুসো ওয়াক্স মিউজিয়াম না দেখলে লন্ডন সফর বৃথা কারণ সেখানে পৃথিবীর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্রাচীন রাজা-মহারাজা, রাষ্ট্রনেতা ও সিনেমা জগতের প্রখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের- মোমের তৈরী ছবি রক্ষিত আছে। দেখলে মনে হয় তারা জীবন্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পাক-ভারতের বিভিন্ন গুণী ব্যক্তিদের মূর্তিও দেখেছি সেখানে। লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ার মহানগরীর মধ্যস্থলে অবস্থিত। সেখানে প্রতিদিন কোন না কোন আমোদ-প্রমোদের আয়োজন করা হয়। হাজার হাজার দর্শকের ভিড়ে সেই জায়গাটি উল্লোসিত হয়ে ওঠে। ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক ইমারতগুলোর অন্যতম হল ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি। ১০৬৬ সাল থেকে অধিকাংশ ব্রিটিশ রাজা ও রানীকে এই ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতেই আনুষ্ঠানিকভাবে মুকুট পরানো হয়েছিল। এখানেই সমাহিত হয়েছেন অনেক ব্রিটিশ রাজা-রানী ও কবিরা।
লন্ডনের সুবিখ্যাত ‘বিগবেন ঘড়ি’ অতি প্রাচীন ও বিশাল যার বেলের ওজন হল সাড়ে তেরো টন। এখনও ঠিক সময় দিয়ে চলেছে। এসব ছাড়াও লন্ডনে পর্যটকদের দেখার মতো স্থান হল-প্রত্যহ দুপুর ১১টায় বাকিংহাম প্যালেসের সম্মুখভাগে মুক্ত প্রাঙ্গণে গার্ড-বদলের দৃশ্য। এ অতি আকর্ষণীয়। পর্যটকদের জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে দৃশ্যটি উপস্থাপিত করা হয়। মাথায় কালো টুপি এবং পরনে কালো প্যান্ট ও লাল কোট দিয়ে সজ্জিত প্রত্যেক গার্ডকে খুবই সুন্দর দেখায়। রাজপ্রাসাদের সম্মুখে মুক্ত প্রাঙ্গণে এ গার্ড বদলের দৃশ্য দেখার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পর্যটকদের ভিড় জমে উঠে।
লন্ডনের প্রাণবাহী হল টেমস নদী। ২১৫ মাইল অর্থাৎ ৩৪৬ কিমি লম্বা। দিনে দুইবার জোয়ার-ভাটা দেখা দেয়। সে সময় নদীর ঢেউ প্রায় ২৫/২৬ ফুট পর্যন্ত ওঠা-নামা করে। টেমস নদীর উভয় তীরের দৃশ্য অতি মনোরম। প্রধান প্রধান অট্টালিকাগুলো নদীতীরে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। তাছাড়া বিশ্বসেরা ইংল্যান্ডের ইংলিশ চ্যানেল প্রাচীন দিনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মাঝখান দিয়ে গৌরবের ধক্ষজা উড়িয়ে দিবা-রাত্রি বয়ে চলেছে। এই ইংলিশ চ্যানেল, উত্তর সাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরকে যুক্ত করে রেখেছে। এই ইংলিশ চ্যানেলের বিশেষত্ব হল দিনে দু’বার জোয়ার-ভাটা দেখা যায়। জোয়ারের সময় কোন কোন স্থানে স্ফীতি ৩০ ফুট পর্যন্ত ঘটে থাকে। সেই প্রবাহ ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে থাকে। তারপর আবার বিপরীত দিকে পানি প্রবাহিত হয়।
বার্মিংহাম ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় মহানগরী। একে প্রাচীন শিল্পনগরী এবং খালের মহানগরী বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। রেলগাড়ি ও মোটরগাড়ি চলাচলের আগে বার্মিংহাম এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শুধু পানিযান ব্যবহার করা হত। সেজন্য ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বড় বড় স্টিমবোট বা পানিযান চলাচলের জন্য সরকার অনেকগুলো খাল তৈরির কাজ হাতে নেন এবং দুই বছরের মধ্যে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে একটি বড় খাল তৈরির কাজ শেষ হয়। এরপর একে একে আরও অনেকগুলো ছোট-বড় খাল তৈরি করা হয় এবং একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া হয় যাতে অনায়াসে বাধাহীন পথে যাতায়াত করা সম্ভব হতে পারে। আমি স্টিমবোটে অন্যান্য পর্যটকদের সাথে ভ্রমণ করে দেখেছি বার্মিংহাম মহানগরীর প্রসিদ্ধ এলাকাগুলো। খাল তৈরির কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। তখন বার্মিংহাম Canal Navigation নাম দিয়ে আরও ১০/১৫টি বড় বড় খাল তৈরি করা হয়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র যুক্তরাজ্যে যখন শ্রমিক আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তখন বার্মিংহাম মহানগরী ছিল তার কেন্দ্রবিন্দু। বার্মিংহাম মহানগরীর উপকণ্ঠে অবস্থিত অনেকগুলো ছোট-বড় উন্নত শহর রয়েছে-যেমন: Council West Browmivh, Smethwick, Handsworth, Acocksgreen, Wolverhumpton, Broomsgrove, Worcester, Leicester, Coventry I rugby ইত্যাদি। এসব শহরাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ভারতীয়, পাকিস্তানি, শ্রীলঙ্কান এবং বাংলাদেশি, বিশেষ করে সিলেটি লোক দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করছেন এবং অধিকাংশ জনসাধারণ এখন ব্রিটেনের স্থায়ী অধিবাসী হিসাবে গণ্য হয়েছেন।
আমি ক’বার যুক্তরাজ্যের অনেক প্রসিদ্ধ জায়গায় সফর করেছি। যখনই সফর করতে এসেছি, দূর-দূরান্তে গ্রামাঞ্চলের ভেতরে গিয়ে স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলে অনেক কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি। এবারও অনেক স্থানে ঘুরে ঘুরে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি। এসব গ্রামাঞ্চলে যেখানে ৫/৬টা বাড়ি আছে অথবা গ্রাম তৈরি হয়েছে, সেখানে চলে গেছে সুন্দর-মসৃণ পাকা রাস্তা। বিশুদ্ধ পানীয়জল এবং বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা রয়েছে প্রতিটি বাড়িতে। আমাদের দেশের মতো সেইসব দেশের কৃষক সম্প্রদায় মোটেই গরিব নয়। তারা হল বিত্তশালী প্রত্যেকেই। তাদের আছে চাষের জন্য ট্রাক্টর, দুগ্ধ আহরণের জন্য গাভী, মেষ, ঘোড়া ইত্যাদি। তাছাড়া চলাচলের জন্য নিজস্ব গাড়িও রয়েছে। আমাদের দেশে যেমন হাট বসে, সেখানকার গ্রামাঞ্চলে সপ্তাহে দু’দিন শনি ও রবিবার দিন হাট বসে। ওরা বলে ফিল্ড ডেজ। সেখানে তাজা শাক-সবজি, ফুল-ফল ইত্যাদি বিক্রি হয়। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসেন এই ‘ফিল্ড ডেজ’ এ অ্যান্টিক ও দুষ্প্রাপ্য দ্রব্যাদি কিনে নেয়ার জন্য। এসব বেচাকেনা ছাড়াও সেখানে প্রদর্শনীয় দ্রব্যাদির মেলা বসে। গানবাজনা ও বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান পরিবেশন করার ব্যবস্থা রয়েছে। এসবের মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে গড়ে ওঠে এক প্রকার মিলনমেলা।
বার্মিংহাম মহানগরীর অনতিদূরে অনেকগুলো ঐতিহাসিক প্রাসাদ ও দুর্গ রয়েছে। সবকটির মধ্যে প্রসিদ্ধ ক্যাসেল হল Warwick Castle. এই দুর্গ দেখার জন্য প্রত্যহ হাজার হাজার পর্যটক দূর দেশ থেকে আসেন। জনপ্রতি ফি ২০ পাউন্ড দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। আমরা দুই বন্ধু ও তাদের বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে সেই ক্যাসেল দেখে এলাম। উপভোগ করলাম মনোযোগ সহকারে । ১০৬৮ সালে ও ঐতিহাসিক প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন Alfred the great তার প্রিয় সুন্দরী কন্যা এথেল প্লেডাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য। এরপর একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী কেটে গেছে। ১৩২৯ থেকে ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চল্লিশ বছর। ফরাসিদের সঙ্গে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ বিগ্রহ চলতে থাকল। সেই সময়ে Edward-II ছিলেন ইংল্যান্ডের স¤্রাট, তিনি দুর্গের মধ্যে ছোট-বড় অনেক কারাগৃহ, যুদ্ধ বন্দিদের prison Cells, ফাঁসি দেয়ার জায়গা, অস্ত্রশস্ত্র রাখার ঘর ইত্যাদি তৈরি করেছিলেন। তারপর Edward-II এই ক্যাসেলের পুনর্নির্মাণ করে সম্প্রসারিত করেছিলেন। এই ডWarwick Castle অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য দিয়ে সগর্বে আজও দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন ক্লাস নাইন ও টেন-এ হাইস্কুলে পড়তাম, তখন ইংল্যান্ডের ইতিহাসের পাতায় দেখেছিলাম ফরাসি দেশের মেষ পালিকা বীরাঙ্গনা নারী ‘জোয়ার অব আর্কের’ করুণ কাহিনী। তারপর এই বৃদ্ধাবস্থায় এখানে এসে এই প্রাসাদটি যখন দেখতে গেলাম, তখন তার গায়ে ইংরেজি লেখাটুকু পড়ে অতীতের বিস্মৃত কাহিনীটুকু মনে পড়ল এবং মনটি ব্যথায় ভরে উঠল। সেখানে লেখা রয়েছে-১৪১৩ খ্রিস্টাব্দে এই ক্যাসলের মধ্যে Earl of Warwick-এর দরবারে জোয়ান অব আর্কের বিচার হয় এবং তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে ফরাসি দেশের মুক্তবাজারের মধ্যস্থলে জীবন্ত দগ্ধ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। জোয়ান অব আর্কের করুণ কাহিনী ফরাসি দেশের প্রতি গৃহে স্বাধীনতার অমর কাহিনী স্বরূপ আজও বেঁচে আছে।
বার্মিংহাম মহানগরীর অনতিদূরে অবস্থিত একটি প্রখ্যাত জায়গা রয়েছে যার নাম হল-স্ট্রাটফোর্ড আপন অ্যাভেন। এখানে ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন প্রখ্যাত, প্রসিদ্ধ কবি এবং ড্রামাটিস্ট উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। তার পিতার নাম ছিল জন শেক্সপিয়ার এবং মাতার নাম ছিল মেরি আরডেন। স্ট্রাটফোর্ড আপন অ্যাভেন তখনকার দিনে একটি গ্রাম ছিল। বর্তমানে একটি প্রসিদ্ধ শহরে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন শত শত পর্যটক শেক্সপিয়ারের জন্ম স্থান দেখার জন্য সেখানে ভিড় জমান। বর্তমানে এই বাড়িটি Royal Shakespeare Company-র তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে। এখানেও ভিতরে ঢুকতে গেলে জন প্রতি ফি ২০ পাউন্ড দিতে হয়।
বাড়িটির ভেতর একটি বিরাট থিয়েটার হল রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের লেখা ড্রামা পরিবেশন করা হয়। তাছাড়া সুন্দর ফুলের বাগান এবং অন্যান্য দেখার মতো জিনিসপত্র প্রতিটি সাজিয়ে রুমে রাখা আছে। প্রতি বছর ৩২০টি Events পরিবেশন করা হয়। সেই হলের প্রেক্ষাগৃহে ২২৬২টি মনোরম চেয়ার বসানো রয়েছে দর্শকদের জন্য। এই Symphony Hall এর সংলগ্ন ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বড় সেন্ট্রাল লাইব্রেরি রয়েছে। এই লাইব্রেরিতে মনোরম চেয়ারে বসে একদিন বেশ কতক্ষণ বই পড়ে সময় কাটিয়েছি।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন